০৩ অক্টোবর ২০২৫, শুক্রবার, ০২:৪৪:১৭ পূর্বাহ্ন


ট্রাম্প প্রশাসনের মুসলিম নিষেধাজ্ঞা প্রতিরোধে নতুন নন ব্যান বিল উত্থাপন
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-০২-২০২৫
ট্রাম্প প্রশাসনের মুসলিম নিষেধাজ্ঞা প্রতিরোধে নতুন নন ব্যান বিল উত্থাপন যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস


এবারও ট্রাম্প প্রশাসনের মুসলিম নিষেধাজ্ঞার পরবর্তী পর্ব শুরু হতে চলেছে, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতিতে মুসলমানদের প্রতি একটি নতুন সংকট দেখা দিতে পারে। মুসলিম এবং অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের বৈষম্যমূলক নিষেধাজ্ঞা আরোপকে প্রতিরোধ করতে কংগ্রেসম্যান জুডি চু (ক্যালিফোর্নিয়া) এবং ইউএস সিনেটর ক্রিস কুনস (ডেলওয়ার) সম্প্রতি পুনরায় ন্যাশনাল অরিজিন-বেজড অ্যান্টিডিসক্রিমিনেশন ফর নন-ইমিগ্র্যান্টস (নন ব্যান) অ্যাক্ট গত ৭ ফেব্রুয়ারি উত্থাপন করেছেন। এই বিলটি মার্কিন অভিবাসন ও জাতীয়তা আইনের অধীনে ধর্মীয় বৈষম্য প্রতিরোধ নিশ্চিত করবে এবং ভবিষ্যতে কোনো প্রশাসন যদি ধর্মীয় ভিত্তিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চায়, তবে তার জন্য নির্দিষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণের প্রয়োজন হবে।

২০১৭ সালে ট্রাম্প প্রশাসন মুসলিম নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে এক বিপর্যস্ত সময় শুরু করেছিল। এ আরোপিত মুসলিম নিষেধাজ্ঞা অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্যাপক আলোচনা তৈরি করেছিল। নতুন এই বিলটি রিপ. চু, সিনেটর কুনস এবং অন্যান্য ডেমোক্রে‍টিক নেতাদের নেতৃত্বে এ বিতর্কিত পদক্ষেপকে আইনগতভাবে প্রতিরোধ করতে চায়। বিলের মাধ্যমে কংগ্রেসের সঙ্গে পরামর্শ এবং যথাযথ প্রমাণের ভিত্তিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি আরো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, যাতে এ ধরনের বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ ভবিষ্যতে আর না হতে পারে।

এই বিলে শুধু ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা প্রতিরোধ নয়, আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে ‘একসেস টু কাউন্সিল অ্যাক্ট’ নামে একটি আইনপ্রস্তাব করা, যা অভিবাসী গ্রিনকার্ডধারী এবং মার্কিন নাগরিকদের বন্দরে আটক থাকার সময় আইনজীবীর সহায়তার অধিকার নিশ্চিত করবে। কংগ্রেসম্যান রিপ. চু এবং তার সহকর্মীরামার্কিন অভিবাসন ব্যবস্থায় ন্যায়বিচারের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে এই বিলটি উত্থাপন করেছেন। এটি এমন একটি সময়কালে প্রস্তাবিত হচ্ছে যখন ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে আরো কঠোর অভিবাসন নীতি গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, যা দেশটির অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং আন্তর্জাতিক মহলে সৃষ্ট বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে।

কংগ্রেস সদস্য জুডি চু (ক্যালিফোর্নিয়া-২৮) এবং সিনেটর ক্রিস কুনস (ডেলওয়ার) পুনরায় ন্যাশনাল অরিজিন-বেজড অ্যান্টিডিসক্রিমিনেশন ফর নন-ইমিগ্র্যান্টস (নন ব্যান) অ্যাক্ট উত্থাপন করেছেন, যা ট্রাম্প প্রশাসনের মুসলিম বা অন্য কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ভবিষ্যতের নিষেধাজ্ঞা প্রতিরোধ করবে। এই বিলটি অভিবাসন ও জাতীয়তা আইনের (ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্ট) সুরক্ষা জোরদার করবে, যাতে ধর্মের ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য করা না হয়। এই আইনের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণের প্রয়োজন হবে এবং কংগ্রেসের সঙ্গে যথাযথ পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। প্রতিনিধি পরিষদে এই বিলটি কংগ্রেসম্যান নাডলার (নিউইয়র্ক-১২), ডন বেয়ার (ভার্জিনিয়া-০৮), ইলহান ওমর (মিনেসোটা-০৫), আন্দ্রে কারসন (ইন্ডিয়ানা-০৭) এবং রাশিদা তালিব (মিশিগান-১২) সহ-নেতৃত্বে রয়েছে।

ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম দিন একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেন, যেখানে সরকারকে ৬০ দিনের মধ্যে সেসব দেশ চিহ্নিত করতে বলা হয়, যাদের অভিবাসন ও স্ক্রিনিং প্রক্রিয়া এতোটাই দুর্বল যে, তাদের নাগরিকদের প্রবেশ আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হতে পারে। এ আদেশ মূলত মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর অভিবাসনের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের ভিত্তি তৈরি করছে।

এ আইনটি নিম্নোল্লিখিত উপায়ে ট্রাম্পের মুসলিম নিষেধাজ্ঞা বা অন্যান্য বৈষম্যমূলক ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রতিরোধ করবে-অভিবাসন ও জাতীয়তা আইনের (ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্ট) অধীনে ধর্মীয় বৈষম্য প্রতিরোধ নিশ্চিত করা হবে। যে কোনো ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা নির্দিষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে আরোপ করতে হবে এবং তা অবশ্যই কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্বার্থরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় হতে হবে। কংগ্রেসকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অবহিত করতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময় পরপর প্রতিবেদন প্রদান করতে হবে।

এছাড়াও কংগ্রেসম্যান প্রমিলা জয়পাল (ওয়াশিংটন-০৭) এবং সিনেটর অ্যালেক্স পাডিলা (ক্যালিফোর্নিয়া) একসেস টু কাউন্সিল অ্যাক্ট পুনরায় উত্থাপন করেছেন, যা রিপ. চু সহ-সমর্থন করেছেন। এই বিলটি নিশ্চিত করবে যে মার্কিন নাগরিক, গ্রিনকার্ডধারী এবং অন্যান্য বৈধ অভিবাসীরা যদি বন্দরে আটক হন, তবে তারা একজন আইনজীবী, আত্মীয় বা অন্যান্য আগ্রহী পক্ষের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারবেন। ট্রাম্পের ২০১৭ সালের মুসলিম নিষেধাজ্ঞার সময় বহু মানুষ দীর্ঘসময় আটকে ছিলেন, অনেকেই আইনজীবীর সহায়তা পাননি। এই বিলটি প্রথমবার ২০১৭ সালে ট্রাম্পের মুসলিম নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় উত্থাপিত হয়। আদালত প্রথমে নিষেধাজ্ঞাটি অবৈধ ঘোষণা করলেও পরে সুপ্রিম কোর্ট ৫-৪ ভোটের একটি সংশোধিত সংস্করণ বহাল রাখে। এর ফলে বহু পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়, দম্পতিরা আলাদা থাকতে বাধ্য হয় এবং অনেক সম্প্রদায় গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোতে একত্রিত হতে পারেনি।

কংগ্রেসম্যান ওমর বলেন, ‘আমি নিজেই নিষিদ্ধ দেশগুলোর একটি থেকে এসেছি। মুসলিম নিষেধাজ্ঞা আমাদের জাতির ধর্মীয় স্বাধীনতার মূলনীতির পরিপন্থী।’ কংগ্রেসম্যান আন্দ্রে কারসন বলেন, ‘আমি একজন মুসলিম কংগ্রেস সদস্য হিসেবে দেখেছি, কীভাবে এ নিষেধাজ্ঞা আমাদের সম্প্রদায়কে আঘাত করেছে। এটি শুধু অভিবাসন নীতি নয়, এটি আমাদের মৌলিক মূল্যবোধের প্রশ্ন।’ কংগ্রেসম্যান রাশিদা তালিব বলেন, ট্রাম্পের মুসলিম নিষেধাজ্ঞা ইসলামোফোবিয়া ও বর্ণবাদকে উসকে দিয়েছে। লক্ষ লক্ষ মুসলিম এই নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমাদের অবশ্যই এটি প্রতিরোধ করতে হবে। মুসলিম অ্যাডভোকেটসের সিনিয়র পলিসি কাউন্সেল সুমাইয়া ওয়াহিদ বলেন, ট্রাম্পের মুসলিম নিষেধাজ্ঞা অসংখ্য পরিবারকে বিচ্ছিন্ন করেছে। নতুন নন ব্যান আইন প্রেসিডেন্টদের নির্বাহী ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করবে। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন'র ডেপুটি ডিরেক্টর নওরিন শাহ বলেন, নন ব্যান আইন আমাদের মৌলিক মূল্যবোধ রক্ষা করার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা। এই আইনটি ইতিমধ্যে কেয়ার, এসিএলইউ, ন্যাশনাল ইমিগ্রেশন ল সেন্টার এবং আরো বহু মানবাধিকার ও অভিবাসন সংগঠনের সমর্থন পেয়েছে। এই আইন পাস হলে, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনবে এবং ভবিষ্যতে কোনো প্রেসিডেন্ট ধর্মের ভিত্তিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবেন না।

কংগ্রেসম্যান রিপ. চু বলেন, মুসলিম নিষেধাজ্ঞা আমাদের জাতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে এটি চালু করেছিলেন, যা ঘৃণা ও ইসলামোফোবিয়াকে উসকে দিয়েছে এবং অসংখ্য পরিবারকে বিচ্ছিন্ন করেছে। দুঃখজনকভাবে, ট্রাম্প ইতিমধ্যে তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে কাজ শুরু করেছেন এবং প্রথম দিনেই একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন, যা ভবিষ্যতে আরো বিস্তৃত মুসলিম নিষেধাজ্ঞার ভিত্তি স্থাপন করতে পারে। তাই আমরা সিনেটর কুনস এবং অন্যান্য ডেমোক্রে‍টিক সহকর্মীদের সঙ্গে মিলে নন ব্যান আইনটি আবারও উত্থাপন করছি, যাতে ভবিষ্যতে কোনো প্রেসিডেন্ট শুধু ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে না পারেন।

সিনেটর কুনস বলেন, ট্রাম্পের মুসলিম নিষেধাজ্ঞা ছিল অগণতান্ত্রিক, অন্যায্য এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের মর্যাদা ক্ষত্নু করেছে। এখন ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে পুনরায় ভয় ও ধর্মীয় বৈষম্যের ভিত্তিতে অভিবাসন নীতি পরিচালিত করছেন এবং নতুন মুসলিম নিষেধাজ্ঞার ভিত্তি তৈরি করছেন। নন ব্যান আইন এখন আগের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যাতে কোনো প্রশাসন বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ নিতে না পারে এবং আমরা ধর্মীয় স্বাধীনতা ও আইনের সমতার প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করতে পারি। নতুন ন্যাশনাল অরিজিন বেজড অ্যান্টিডিসক্রিমিনেশন ফর নন-ইমিগ্র্যান্টস (নন ব্যান) অ্যাক্ট ট্রাম্প প্রশাসনের মুসলিম নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করে মার্কিন অভিবাসন ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনগত পদক্ষেপ। এই আইনটি ধর্মীয় বৈষম্য প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে এবং কোনো প্রশাসনকে ধর্মীয় ভিত্তিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধের আওতায় আনবে। বিলে অভিবাসন এবং জাতীয়তা আইনের সুরক্ষা জোরদার করা হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণের দাবি করে। এছাড়াও ‘একসেস টু কাউন্সিল অ্যাক্ট’ এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে অভিবাসীদের জন্য আরো ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে। এটি সেই সময়ের মধ্যে প্রস্তাবিত হচ্ছে, যখন মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিতর্কের সম্মুখীন। তাই এই আইনটি শুধু অভিবাসন নীতিতে নয়, মার্কিন সমাজের মৌলিক ন্যায়বিচারের প্রতি দেশের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শেয়ার করুন