জুলাইয়ের বিপ্লব চলাকালীন যারা গণহত্যার মদদদাতা ছিল এবং যারা এ গণহত্যার অংশ ছিল, সবাইকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। গত ২২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় জ্যাকসন হাইটসের ইটজি রেস্টুরেন্টে এক সংবাদ সম্মেলনে আমরা বাংলাদেশ স্টুডেন্ট এবং অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করে ইউছুপ আলী। বক্তব্য রাখেন, আল আমিন রাসেল। মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন সারমিন আক্তার, বাইজিদ কামাল, নুমায়ের হোসেন, অবনী শরিফ ও মুজাফ্ফর আহমেদ।
এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন এস এম ফয়সাল, জি এম ফজলে রাব্বী, ইসলাম মোহাম্মদ সাইমন, মোহাম্মদ আহসান জাহিদ, সাবরিনা মাহমুদ, সাঈদ সাবতাহী, আদিবা হোসেন দিয়া, তামজীদ তাহসীন, সায়মাতুন শিপা, জেরিন তাসনিম, জেনিফার রশিদ তাসমিয়া, জাবেদ হোসেন, মোনাফ মিয়া প্রমুখ।
লিখিত বক্তব্যে ইউছুপ আলী বলেন, প্রথমেই স্মরণ করছি ৫ আগস্ট আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে যে অভ্যুত্থান হয়ে গেছে, সে অভ্যুত্থানের রূপকার সব শহিদ ভাইবোনকে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, যারা আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন এবং পঙ্গুত্ব বরণ করে এখনো হাসিমুখে দেশকে নিয়ে আগামীর শুভদিনের স্বপ্ন দেখছেন। শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা তাদের সবার পরিবার-পরিজনের প্রতি, যারা ধৈর্য ধরে আছেন এবং এ পুরো সময়টা সব রকম সহায়তা দিয়ে গেছেন। দেশের প্রতিটি মানুষ যারা নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে শেষ মুহূর্তে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। দিয়েছেন খাবার, অর্থ, ওষুধ, সাহস এবং ভরসা; সেসব মানুষকে জানাই বিপ্লবের লাল সালাম। আপনারা-আমরা আজ সবাই একই কাতারে একই উদ্দেশ্যে সফল।
তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশ স্টুডেন্ট এবং অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, দেশের যে কোনো ক্রান্তিলগ্নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, দেশের জন্য কাজ করতে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণ সহায়তা, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশের নিরীহ জনতা এবং ছাত্রদের প্রতি আমাদের একাত্মতা এবং সংহতি বরাবরের মতোই ছিল। আমরা সংহতি প্রকাশ করেছি, ইউএন অফিসের সামনে, বাংলাদেশ কনস্যুলেট অফিসের সামনে, এমনকি জনমত গঠন করে আন্দোলন করেছি জ্যাকসন হাইটস, হিলসাইড এবং টাইমস স্কয়ারের মতো জায়গাতে। নিয়মিত সোচ্চার থেকেছি বেশকিছু টেলিভিশনের নিয়মিত টকশোতে এবং সে ধারাবাহিকতায় আমরা আজকে এখানে উপস্থিত হয়েছি অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রতি কিছু দাবি তুলে ধরতে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসকে অভিবাদন এবং অভিনন্দন জানাই। সেই সঙ্গে শুভেচ্ছা জানাই উপদেষ্টা পরিষদের সব সদস্যকে। দেশের প্রতি একনিষ্ঠতার সঙ্গে আপনারা দায়িত্ব পালন করে দেশকে একটা অবকাঠামোগত সংস্কারের সূচনা আপনাদের হাত ধরে আসবে এইটা দেশের সব মানুষের প্রত্যাশা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ আমাদের সবার কাছে একটি কমন ইমোশন। আদর্শিক বা মূল চিন্তাধারা সবার এক না হলেও আমরা সবাই জানি দীর্ঘমেয়াদি সরকারব্যবস্থা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছিল। উন্নয়নের বুলি দিয়ে ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে, মানুষের মৌলিক অধিকার এবং মানবাধিকারকে। আমরা যে বাংলাদেশকে ছোট থেকে অসাম্প্রদায়িক বলে জেনে এসেছি, সেই দেশে ডিভাইড অ্যান্ড রুল জারি করে ধীরে ধীরে বাইনারি রাজনীতি কায়েম করা হয়েছে এবং এ বাইনারি রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকে। একটি রাজনৈতিক দল ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের মতো মহান অর্জনকে নিজের দলের স্বার্থে ব্যবহার করে দেশের সাধারণ মানুষকে ঠেলে দিতো একটি চরমপন্থী পরিচয়ের দিকে এবং গণতান্ত্রিক সরকারের ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার প্রথম ধাপ ছিল এটা। আমরা চাই বাংলাদেশে এমন বাইনারি রাজনীতি আর থাকবে না। আমরা বিএনপি বনাম আওয়ামী লীগ, হিন্দু বনাম মুসলিম, জামায়াতি বনাম বামাতি, প্রগতিশীল বনাম প্রতিক্রিয়াশীল দেখতে চাই না।
তিনি বলেন, শিক্ষাব্যবস্থায় যে পরিমাণ অযৌক্তিক পরিবর্তন আমরা প্রতি বছর দেখি, স্কুল পর্যায়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে দুর্বল করে দেওয়ার খুবই সূক্ষ্ম পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়ে আসছে। সিলেবাস, বই, পরীক্ষা কিংবা ক্লাস কারিকুলাম হাতের মোয়া না যে, আমরা প্রত্যেক বছর ইচ্ছা হলেই পরিবর্তন করে নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্ট করবো। আজকে শর্ট সিলেবাস কালচার আর অনুকরণীয় শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আমাদের স্কুল এবং কলেজের কারিকুলামে যৌক্তিক বিষয়ের ওপর পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, মব জাস্টিসের যে ধারাবাহিকতা এইটা আসছে রাজা-বাদশাহদের আমল থেকেই। ইংরেজরা এই মব জাস্টিসের ফায়দা নিয়ে বহু মানুষকে নির্যাতন করেছে এবং এ বর্তমান সময়ে এসেও আমরা নিত্যদিন দক্ষিণ এশিয়ার কোনো না কোনো দেশে এ বিচারবহির্ভূত মব জাস্টিস দেখতে পাই। অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারব্যবস্থায় যে জেনারেশনাল একটি পরিবর্তন এসেছে, আমরা বিশ্বাস করি এখনই উত্তম সময় এ মব জাস্টিস, তথা বিচারবহির্ভূত বিচারব্যবস্থা থেকে বের হয়ে নির্বাহী, তথা শাসন বিভাগ আর বিচার বিভাগকে ঢেলে সাজাতে হবে। নির্বাহী বিভাগকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করে আমাদের জনগণ এবং জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ধর্মীয় উৎসব বা জাতীয় উৎসবে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ সামাজিক যে কোনো অপরাধ, বাজার নিয়ন্ত্রণ, সাইবার ক্রাইম রোধে আমাদের শাসন বিভাগের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিতকরণ আবশ্যিক। বিগত দিনের অহেতুক জনগণকে হয়রানিসহ যারা সরকার কর্তৃক গুম, খুন, হত্যার সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাদের বহিষ্কারসহ দলীয় লেজুড়বৃত্তিক সদস্যদের ইস্তফা দিয়ে দেশপ্রেমিক এবং দায়িত্ববান সদস্য নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হতে হবে জনবান্ধব। নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত এবং সুপ্রিম কোর্টকে স্বাধীন করতে হবে। কনস্টিটিউশনাল ল’কে সংস্কার করতে, ব্রিটিশ শাসনের শিখিয়ে যাওয়া নানান অসংগতিপূর্ণ বিচারব্যবস্থা থেকে বের হয়ে সবার জন্য সমান আইন নিশ্চিত করতে। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত, জনগণের টাকায় চলা জনপ্রতিনিধিকে প্রোপার এডুকেটেড হতে হবে। সেটা সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট থেকে লোকাল গভর্নমেন্ট পর্যন্ত। মিনিমাম একটি লেভেল পর্যন্ত শিক্ষা না থাকলে তারা প্রতিনিধিত্ব করার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। সেই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে হতে হবে নির্ভীক এবং প্রত্যেক টার্ম শেষে ফেয়ার ইলেকশন নিশ্চিত করতে হবে। ভোট ডাকাতি, রাতের ইলেকশনের মতো টার্ম বিলুপ্ত করতে হবে এবং ইলেকশন সম্প্রচারের এক্সেস ইজি করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি গার্মেন্টসের পরই কৃষি। আমাদের দেশের কৃষক-শ্রমিকদের অবস্থা বোধ করি এখন সবচেয়ে খারাপ। দেশের জিডিপি ২৬৮৮.৩১ টাকা। যেখানে কৃষকরা সামান্য সারটুকু কিনতে হিমশিম খায়। আমাদের পাটকল, চিনিকল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের চা-শ্রমিকরা নামমাত্র মজুরি পাচ্ছে। শিল্পকারখানায় বেতন আটকে রাখা হচ্ছে। দেশের সরকার যদি এনার্জির সাপ্লাই সবচেয়ে বেশি দিয়ে থাকে, তবে সেটা শিল্পকারখানায়। গ্যাস-বিদ্যুৎ এবং ভর্তুকি এসব কিছু নিয়ে ক্যাপিটালিস্ট শ্রেণি অধিক মুনাফা অর্জন করেই যাচ্ছে আর এসবের পেছনে গরিব শ্রমিকশ্রেণি এখনো দিনের নায্য মজুরিটুকু পাচ্ছে না। এটা বন্ধ করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আজকে দেশের এই দুরবস্থার জন্য দায়ী যদি কাউকে করতেই হয়, তবে সেটা ক্যাপিটালিস্ট ব্যবসায়ী, ফ্যাসিস্ট সরকার এবং পাহাড়ি সেটেলারদের দিতে হবে। আপনি নিজের দেশীয় পণ্য বাদ দিয়ে যখন অন্য দেশের পণ্য কিনবো, তখন সেই প্রোডাক্ট যে দেশ উৎপাদন করছে, তাদের সফট কলোনিতে আপনি রূপান্তরিত হচ্ছেন। না হলে কোনো দেশকে বয়কট করার পর আপনাকে অল্টারনেটিভ দেশীয় পণ্য খুঁজতে হতো না। আজকে দেশীয় পোশাক থেকে শুরু করে, খাবার এবং সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমরা অন্য দেশ থেকে আমদানি করছি এবং সেই সঙ্গে ঐতিহ্য হারিয়ে বিলুপ্ত হচ্ছে আমাদের দেশীয় পণ্য এবং যারা এসব উৎপাদনব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারাও কাজ হারিয়ে হচ্ছেন নিঃস্ব। দেশের সরকার যদি এ সেক্টরে আলোকপাত না করে, তবে দিনদিন আমরা বাংলাদেশি সব ঐতিহ্য হারিয়ে পরনির্ভর একটি দেশে পরিণত হবো। আজকে আমরা দেখছি ইউরোপসহ বিশ্বের সব দেশ ফুয়েল এনার্জি থেকে বের হয়ে নেভার এন্ডিং সাস্টেইনেবল এনার্জির দিকে ধাবিত হচ্ছে। সেখানে আমাদের কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনসহ অধিক মূল্যে কেন বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে হচ্ছে, এই প্রশ্নের উত্তর সবার অজানা। সোলার প্যানেল থেকে জলবিদ্যুৎ এবং উইন্ডমিল, একটা প্রোপার প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমে জ্বালানি বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অবকাঠামোগত সংস্কার এবং উন্নয়নের জন্য যে রাস্তায় আমাদের হাঁটা দরকার, সেই রাস্তা অনেক লম্বা। স্বাধীনতার অর্ধশত পার করেও আমরা হয়তো বুঝিনি, বুঝছি না, কিংবা ইচ্ছা করেই বুঝতে চাইছি না। আমরা মুখ খুলি না, কথা বলি না। আমরা বিগত বছরগুলোতে দেখেছি, যাদের দায়িত্ব ছিল ‘কথা বলা’ তারা কেবল চাটুকারিতা করে গেছে। আমরা এই লজ্জা আর চাই না। আমরা চাই গণমাধ্যম উন্মুক্ত হোক, গণমাধ্যম কথা বলুক। আপনারা প্রশ্ন করলে দুর্নীতিবাজ দুর্নীতি করার আগে দুইবার ভাববে। ঘুষখোররা, ভেজালকারীরা, চাঁদাবাজরা, যে কোনো অন্যায়কারীরা অন্যায়ের আগে দুইবার ভাববে। তাই বিগত বছরগুলোতে আপনাদের যেমন কুক্ষিগত করে রাখা হয়েছিল, সেই দশা থেকে বের হয়ে এই মুক্ত বাতাসের স্বাদ নিন। স্বাধীনতা থেকে শান্তিময় আর কি হতে পারে?
তিনি বলেন, আমাদের সব দাবির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবিটি এখন আমরা তুলে ধরবো-জুলাইয়ের বিপ্লব চলাকালীন যারা গণহত্যার মদদদাতা ছিল এবং যারা এ গণহত্যার অংশ ছিল, সবাইকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। যারা দেশত্যাগ করেছে, তাদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের আন্ডারে দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তির সম্মুখীন করতে হবে। নিহতের পরিবারের পুনর্বাসন, আর্থিক সহায়তা এবং আহতদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।