১৫ অক্টোবর ২০১২, মঙ্গলবার, ০৯:৫৫:১০ অপরাহ্ন


১০ বছর নিষিদ্ধ হওয়ার শঙ্কায় আওয়ামী লীগ
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৫-০৯-২০২৪
১০ বছর নিষিদ্ধ হওয়ার শঙ্কায় আওয়ামী লীগ


কঠিন এক শাস্তির মুখে পড়তে যাচ্ছে টানা ১৬ বছর সরকারে থাকা ও গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো শেখ হাসিনার নেতৃত্বাদানকারী প্রাচীনতম দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। জুলাই আগষ্ট মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নির্বিচারে দমন পীড়ন চালাতে যেয়ে যে ধ্বংসলীলা করেছে ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার সরকার। এতে সহস্রাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, পঙ্গুত্ব বরণসহ অন্ধ হয়ে গেছে আরো শত শত। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সাধারণ মানুষ ও ছাত্রদের উপর এমন দমনপীড়ন বিশ্বের ইতিহাসে নজির স্থাপন করেছে। 

শেখ হাসিনা দীর্ঘদিনের ইতিহাস ব্রেক করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে গেছে। এদিকে জুলাই আগষ্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আসছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। এছাড়া শতাধিক হত্যা মামলাও হয়েছে শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রীবর্গের গুরুত্বপূর্ণদের বিরুদ্ধে। যেহেতু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ আসছে, তাই এর পরিপেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন নিয়ে মতবিনিময় সভা করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।

আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় গুম ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা যুক্ত করার বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। পাশাপাশি কোনো রাজনৈতিক দল যদি এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করে, তাহলে সে দলকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটিসহ আইনে পাঁচটি ধারা-উপধারা সংযোজন এবং তিনটি ধারা সংশোধনের খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাবের বিষয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘যেসব নেতা বা যেসব ব্যক্তি এখানে (ট্রাইব্যুনালে) বিচারের সম্মুখীন হবে, তাঁদের যাঁরা সমর্থক আছেন, তাঁদেরও যেন মনে হয় সত্যি উনি (ওই নেতা) অন্যায় করেছেন বা অন্যায় করেননি, তাঁরাও যেন কনভিন্সড (সন্তুষ্ট) থাকেন। আমরা এই সমাজে আর ক্ষত চাই না। বিভাজন চাই না। বিচারের মধ্য দিয়ে একটা রিকনসিলিয়েশন (পুনর্মিলন) প্রসেসের (প্রক্রিয়া) শুরু করতে চাই। সবাই যেন একমত হয় বিচারটা যেটি হয়েছে, বিচারে যে শাস্তি পেয়েছে, যদি পায়-এটা অবশ্যই তার প্রাপ্য ছিল।’

যত হতাশা থাক, যত ক্রন্দন থাক, ক্ষোভ থাকুক, বিচার অবশ্যই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। কোনো প্রতিশোধ কিংবা প্রতিহিংসা নয়, সুবিচার নিশ্চিত করতে চান বলে জানান দেন আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, সবাই দেখেছে, কী ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে (জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ড)। একটা দেশের বৃদ্ধ প্রজন্ম একটা তরুণ প্রজন্মকে উন্মত্তভাবে খুনের নেশায় নেমেছিল। বুকের ভেতর যত কষ্ট থাক, যত হতাশা থাক, যত ক্রন্দন থাক, ক্ষোভ থাকুক, বিচার অবশ্যই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেন, যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটি চূড়ান্ত নয়। আরও আলাপ আলোচনা চলবে। তারপর আইনটাকে পরিপূর্ণ করা হবে।

আলোচনার মধ্য দিয়ে আইনটি সমৃদ্ধ হবে বলে মনে করেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। তিনি বলেন, সব দিক বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা সম্মিলিতভাবে হয়েছে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো (জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ড) চায়, বিচার যেন নিশ্চিত হয়। কনসালটেশনের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সামনে আসবে।

কী আছে খসড়া প্রস্তাবে 

সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো: গোলাম রব্বানী। তিনি বলেন, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করা অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান বৈশ্বিক পটভূমিতে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও বিচারব্যবস্থার মানদণ্ডের আলোকে আইনটি সংশোধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

আইনের খসড়া প্রস্তাবগুলো তুলে ধরেন আইন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব আশফাকুর রহমান। এতে বলা হয়, এই সংশোধনীর মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় গুম, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, যৌন দাসত্ব, জোর করে যৌনকর্ম, জোর করে গর্ভধারণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা আগের আইনে ছিল না। এ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল যদি এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করে, তাহলে সে দলকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। খসড়া প্রস্তাবের বিষয়ে আরও বলা হয়, বিচার কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে ট্রাইব্যুনাল চাইলে শুনানি সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবেন। অভিযুক্ত চাইলে তাঁর পক্ষে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারবেন বলেও খসড়া প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়।

সভায় অ্যাটর্নি জেনারেল মো: আসাদুজ্জামান বলেন, সংশোধনীর যে প্রস্তাবগুলো আনা হয়েছে, আসামিদের স্বার্থ ও অধিকার সুরক্ষার বিষয়টি খসড়ায় যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) আন্তর্জাতিক আইনজীবী আনতে চাইলে আনতে পারবেন, সেই বিধানও থাকা দরকার।

ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, সবার মতামতের ভিত্তিতে এই আইন এমনভাবে সংশোধন করা হোক, যার মাধ্যমে ভুক্তভোগী এবং আসামি-দুই পক্ষই যাতে মনে করে ন্যায়বিচার হয়েছে।

সভায় নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, চার ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। একটা হলো মানবতাবিরোধী অপরাধ। আরেকটি হলো ফৌজদারি অপরাধ। যারা গুম করেছে, খুন করেছে বিচারবহির্ভূত হত্যা করেছে। তৃতীয় হলো আর্থিক দুর্নীতি, লুটপাট, ব্যাংক লুট ও বিদেশে টাকা পাচার। আরেকটি হলো নির্বাচন ব্যবস্থা সংক্রান্ত অপরাধ। যারা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে, নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে।

মতবিনিয়ময় সভায় আরও বক্তব্য দেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, অধিকারকর্মী ডেভিড বার্গম্যান, সাবেক জেলা জজ ইকতেদার আহমেদ, আইনজীবী শামীম হায়দার পাটোয়ারী ও জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদুর রহমান প্রমুখ।

সোহেল তাজের ক্ষোভ 

শেখ হাসিনা আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল। ৫ আগষ্টের পর থেকে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার এ সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর সোমবার যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত সাংবাদিক কনক সারোয়ারের ইউটিউব চ্যানেলে এক আলাপচারিতায় অংশ নিয়ে সেখানে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। দীর্ঘ আলাপের এক পর্যায়ে সোহেল তাজ বলেন, দায়িত্ব (স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) নেওয়ার সময় আমি ইন্সপায়ার্ড ছিলাম যে বাংলাদেশে একটি গুণগত চেঞ্জ আসবে। একটা সিস্টেমিক চেঞ্জ আসবে। আমি সেই বিশ্বাস থেকে ইলেকশন করেছিলাম। প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলাম।

তাজ বলেন, বাট আই ফিল কমপ্লিটলি বিট্রেইড। আমি আস্থা রেখেছিলাম আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ওপর। শি বিট্রেইড মি, শি বিট্রেইড দ্য পার্টি, আওয়ামী লীগ, শি বিট্রেইড বাংলাদেশ। বিকজ আমরা যে দিনবদলের সনদ, যেটা আমরা মানুষের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম করব সেটা করতে হলে প্রথম ছয়মাসেই সেই চিত্র পাওয়া যেত। কিন্তু আমরা তো সেদিকে যাইনি, বরং গতানুগতিক পলিটিক্যাল কালচার মেইনটেন করে আমরা সেটাকে আরও ধ্বংসের পথে।

আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি কথা বলেছেন জেলহত্যা নিয়ে, বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে, আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, বদলি বাণিজ্য, ক্ষমতার বাইরে থাকলে এক হাসিনা, ক্ষমতায় গেলে হাসিনার বদলে যাওয়া, জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যার পরও নিজের বোনের আওয়ামী লীগে থাকা এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা প্রসঙ্গে সোহেল তাজ বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে না; হত্যা, গুম-খুন-দুর্নীতির সঠিক বিচার হলে এমনিতেই আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব ধ্বংস হয়ে যাবে।

শেয়ার করুন