০৩ অক্টোবর ২০২৫, শুক্রবার, ৬:৪২:০৮ পূর্বাহ্ন


শুল্ককর বাড়ানোর ফলে জনজীবনে অস্বস্তি
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৫-০১-২০২৫
শুল্ককর বাড়ানোর ফলে জনজীবনে অস্বস্তি প্রতীকী ছবি


বাংলাদেশের জনগণ মুদ্রাস্ফীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অগ্নিমূল্য, ভঙ্গুর অর্থনীতি, জ্বালানি সংকটের কারণে দুঃসহ জীবনযাপন করছে। জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছে। কিন্তু সেই সরকার শুল্ক ব্যবস্থার জনবান্ধব সংস্কার না করে সম্প্রতি ১০০ পণ্যের শুল্ক বৃদ্ধি করে জনগণকে হতাশ করেছে। এ অনাকাক্সিক্ষত কাজের প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের জীবন আরো দুর্বিষহ হবে সন্দেহ নেই। সরকার কিন্তু দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া কোটি কোটি টাকা ফিরিয়ে আনা, শীর্ষস্থানীয় দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনা, অসংখ্য কর ফাঁকিবাজদের কর কাঠামোর আওতায় আনতে পারেনি। কর আদায় বৃদ্ধি করতে পারেনি। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধির জন্য মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় কেন শুল্ক মূল্য বাড়িয়ে পূর্বসূরি সরকারগুলোর মত শুল্ক বৃদ্ধির বোঝা জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া? যা এক রকম ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’। এতে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তরা। বিত্তশালীদের এটুকু গায়েই লাগবে না। শ্রমিকশ্রেণির দরিদ্র, হতদরিদ্রদের কাজের মূল্য তারা নিজেরা বাড়িয়ে নেবেন। কিন্তু বিপাকে পড়ে যাবে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তরা। 

যে ১০০ পণ্য এবং সেবার ওপর ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে তার মাঝে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ইন্টারনেট, ওষুধ, তরল পানীয় এবং সিগারেট অন্তর্ভুক্ত আছে। আর্থিক বছরের মধ্য সময়ে শুল্ক মূল্যবৃদ্ধি স্বাভাবিকভাবেই এসব পণ্য এবং সেবার মূল্যবৃদ্ধি করবে। মোবাইল ফোনের ওপর সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি কল এবং ইন্টারনেট সেবার খরচ বাড়িয়ে দেবে। রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া, পরিধানের বস্ত্র ক্রয় এবং সংশ্লিষ্ট অনেক ক্ষেত্রেই মূল্যবৃদ্ধি ঘটাবে। ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অর্ডিন্যান্স ২০২৫ এবং শুল্ক ও সল্ট (সংশোধন) অর্ডিন্যান্স ২০২৫ হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অর্ডিন্যান্স জারি করে এগুলো অবিলম্বে কার্যকর করার পাশাপাশি এগুলোর প্রয়োগ বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) কর্তৃক প্রদত্ত শর্ত পালনের জন্য শুল্ক বৃদ্ধি করে কর কাঠামো যুক্তিযুক্ত করা হয়েছে। উপদেষ্টা কাউন্সিলের অনুমদোনের পর, আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা এবং প্রেসিডেন্টের অনুমোদনের পর অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়েছে।

হোটেল বার, রেস্টুরেন্টে মদ পানের ওপর শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা সাধারণ মানুষের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু পট্যাটো ফ্লেক্স, কর্ন ফ্লেক্স, হাতে অথবা মেশিনে তৈরি বিস্কুট, আচার, চাটনি, টম্যাটো পেস্ট, ক্যাচআপ, আম, আনারস, পেয়ারা, কলার পাল্প, ট্রান্সফরমার অয়েল, লুব্রিক্যান্ট, এলপি গ্যাস আমদানিকৃত পেট্রোলিয়াম দ্রব্যাদি, বিটামিনের ওপর সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি সর্বসাধারণের জীবন ধরনের ব্যয় ব্যাপক বৃদ্ধি করবে।

বর্ধিত শুল্ক বিআরটিএ থেকে প্রদেয় লেমিনেটেড ড্রাইভিং লাইসেন্স, কঠিন শিলা, ফেরো-মাঙ্গানিজ, ফেরো-সিলিকা, ফেরো-সিলিকন এলোয়, সিআর কৈল, এইচ আর কৈল, জিপি শিট, জিআই তার, ৫ কেভিএ-২০০০ কেভিএ রূপান্তর যোগ্য বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, প্লাটিক এবং ধাতব আই গ্লাস ফ্রেম, রিডিং গ্লাস, নারকেল দড়ির তৈরি ম্যাট্রেস ইত্যাদির ওপর প্রযোজ্য হবে। এগুলোর শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।

রেস্টুরেন্ট এবং ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোর ওপর শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।

কিচেন তোয়ালে, টয়লেট টিস্যু। ন্যাপকিন টিসু, ফেসিয়াল টিসু, হ্যান্ড তোয়ালে, সান গ্লাস, ননএসি হোটেল, মিষ্টির দোকান, শোরুম এবং ব্র্যান্ডেড আপারেল ভ্যাট ৭.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।

এছাড়া বৈদ্যুতিক খুঁটি, মোটর গ্যারেজ, ওয়ার্কশপ, ডকইয়ার্ড, প্রিন্টিং হাউজ, ফিল্ম স্টুডিও, সিনেমা, ফিল্ম পরিবেশক, রিপেয়ার এবং সার্ভিসিং ওয়ার্কশপ, স্বয়ংক্রিয় করাত মিল, স্পোর্টস এবং ইভেন্ট অর্গানাইজার, ট্রান্সপোর্ট ঠিকাদার, বোর্ড মিটিং সরবরাহকারী, দর্জির দোকান, ভবন রক্ষণাবেক্ষণ কোম্পানি, সামাজিক এবং স্পোর্টস ক্লাব এগুলোর ওপর ট্যাক্স ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।

বর্তমানে বার্ষিক ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি আয় অর্জনকারী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে টার্নওভার ট্যাক্স দিতে হয়। পরিবর্তিত ব্যাবস্থায় ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ আয় করা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকেও টার্ন ওভার ট্যাক্স দিতে হবে। ৫০ লাখের ওপর বার্ষিক আয়ের প্রতিষ্ঠানকে গুডস এবং সার্ভিসেসের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রদান করতে হবে। ফলের রস আমদানির ক্ষেত্রে সম্পূরক ট্যাক্স ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ, তামাক জাতীয় পদার্থ ৬০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০০ শতাংশ এবং পান ৩০ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশ করা হয়েছে। 

বিমান টিকেটের ওপর শুল্ক কর বাড়ানো হয়েছে। অভ্যন্তরীণ রুটে ৫০০ টাকা বাড়িয়ে ৭০০ টাকা, সার্ক দেশসমূহে বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা, এশিয়ান দেশসমূহে ২ হাজান টাকা থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং ইউরোপ ৩ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার টাকা করা হয়েছে।

ওপরে বর্ণিত ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করার অশুভ প্রতিক্রিয়া সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের জন্য মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দেবে। নানা সংকটে এমনি জনজীবন অতিষ্ঠ। সরকার দেশে কোটিপতি সচ্ছল মানুষগুলোকে কর কাঠামোর আনতে সফল হচ্ছে না। সরকারি ব্যয় সংকোচনের উদ্যোগ দৃশ্যমান নেই। অথচ আইএমএফ শর্ত অনুযায়ী, ভ্যাট এবং শুল্ক বৃদ্ধির বাড়তি বোঝা জনগণের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এমন একটা পরিস্থিতি যে জনগণের প্রতিবাদের জন্য পরিবেশ নেই। বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্র্ধ্বগতি সেই করোনাকালীন সময় শুরু হয়। এরপর থেকে বাড়ছেই। কখনো নিম্নমুখী হয়নি। সে থেকেই সাধারণ মানুষ পিষ্ট। বিগত সরকারকে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার অন্যতম এক কারণ ছিল দ্রব্যমূল্য কন্ট্রোল করতে না পারা। লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে বিগত সরকার ছিল চুপ। মানুষ ধীরে ধীরে তেতে উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বড় দাবি ছিল সিন্ডিকেট ভেঙ্গে বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণের। কিন্তু সেখানে জনগণ পাচ্ছে বাড়তি শুল্ক কর। এটা কতটা পীড়াদায়ক হতে পারে এ নিয়ে চলছে বিশ্লেষণ। 

 রাজনৈতিক দলগুলো বা সামাজিক সংগঠনগুলো এগুলো বিষয়ে খুব মাথা ঘামাচ্ছে বলে মনে হয় না। সরকারে থাকা দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরা কীভাবে এগুলো দেখছেন জানতে ইচ্ছা করে...। 

শেয়ার করুন