মার্কিন ভিসা
ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট এ বছর এখন পর্যন্ত প্রায় ৮০ হাজার নন-ইমিগ্র্যান্ট ভিসা বাতিল করেছে। বাতিলকৃত ভিসাগুলোর মধ্যে ৮ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী ভিসা রয়েছে। ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন এই ভিসা বাতিল কার্যক্রম শুরু করে, যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানিয়েছে, অপরাধমূলক কার্যকলাপ ও জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকি প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, ড্রাইভিং আন্ডার দ্য ইনফ্লুয়েন্স (ডিইউআই) বা মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোয় প্রায় ১৬ হাজার, আক্রমণ বা অ্যাসল্ট মামলায় ১২ হাজার এবং চুরির অভিযোগে আরো ৮ হাজার ভিসা বাতিল করা হয়েছে। এই তিন অপরাধই মোট ভিসা বাতিলের প্রায় অর্ধেকের জন্য দায়ী। পাশাপাশি ৬ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী ভিসা বাতিল করা হয়েছে ওভারস্টে, আইনভঙ্গ এবং কিছু ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদে সমর্থনের অভিযোগে।
ট্রাম্প প্রশাসন জানিয়েছে, বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে যারা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, সরকার, সংস্কৃতি বা সংবিধানের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করে, তাদের ভিসা বাতিলের আওতায় আনা হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আমরা এমন কোনো বিদেশিকে যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে দেবো না, যারা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা বা জনগণের স্বার্থের জন্য হুমকি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রমিস মেইড, প্রমিস কেপ্ট তাহলো আমরা আমেরিকান জনগণের নিরাপত্তাকে সর্বদা অগ্রাধিকার দেবো। এ কঠোর নীতির ফলে সামাজিকমাধ্যমে সক্রিয় অনেক বিদেশির ভিসাও বাতিল হয়েছে। সম্প্রতি রাষ্ট্রদফতর জানিয়েছে, রক্ষণশীল রাজনৈতিক কর্মী চার্লি কার্কের হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রশংসা বা সমর্থনসূচক মন্তব্য করা অন্তত ছয় বিদেশির ভিসা বাতিল করা হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের সমালোচকরা বলছেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত, তবে প্রশাসন বলছে, বিদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রে এমন পদক্ষেপ নিরাপত্তাজনিত প্রয়োজন।
এ পদক্ষেপের ফলে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী সম্প্রদায়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার্থীদের সামাজিক মাধ্যম কার্যক্রম ও রাজনৈতিক মন্তব্য নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর শিক্ষার্থীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধ নিয়ে মন্তব্যের কারণেও তাদের ভিসা বাতিল হতে পারে। অনেক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তাদের অনলাইন পোস্টের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছে। রাষ্ট্রদফতরের নতুন নির্দেশনায় বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশি দূতাবাসগুলোকে আবেদনকারীর সামাজিক মাধ্যম, রাজনৈতিক কার্যক্রম ও ব্যক্তিগত মতামত খতিয়ে দেখতে হবে। আবেদনকারীর অনলাইন উপস্থিতি ও মন্তব্যগুলো পর্যবেক্ষণ করে বোঝার চেষ্টা করতে হবে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব পোষণ করছেন কি না। এমনকি আবেদনকারীদের সাক্ষাৎকারেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যাচাই করা হবে।
একজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আমরা এখন কেবল অপরাধী বিদেশিদের নয়, বরং যারা আমাদের মূল্যবোধ ও নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে- তাদের সম্পর্কেও কঠোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। তিনি বলেন, ভিসা কোনো অধিকার নয়, এটি একটি সুযোগ। আমরা কেবল তাদের দিই, যারা আমাদের আইন ও মূল্যবোধকে সম্মান করে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের এই পদক্ষেপ একদিকে যেমন জননিরাপত্তা নিশ্চিতের উদ্যোগ, অন্যদিকে এটি রাজনৈতিক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর নতুন এক চাপ সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই নীতি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত অনেক শিক্ষার্থী বলছেন, তারা এখন সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের মতামত প্রকাশে ভয় পাচ্ছেন, কারণ একটি মন্তব্যই তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করে দিতে পারে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য যান। নতুন এই নীতির কারণে তাদেরও ভিসা বাতিলের ঝুঁকি বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, শিক্ষার্থীরা যেন যুক্তরাষ্ট্রের আইন ও নীতিমালা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখেন এবং সামাজিক মাধ্যমে মতপ্রকাশের সময় সতর্কতা অবলম্বন করেন।
২০২৫ সালে ট্রাম্প প্রশাসনের এই ভিসা বাতিল কার্যক্রমকে অনেকে অভিবাসন নীতির পুনর্জাগরণ হিসেবে দেখছেন। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে থাকা বহু বিদেশির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। রাষ্ট্রদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেছেন, এটি এক নতুন যুগের সূচনা। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থই হবে ভিসা নীতির একমাত্র ভিত্তি।
এ নীতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ইতিমধ্যে বেশকিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, ট্রাম্প প্রশাসনের এ পদক্ষেপ বিদেশিদের মধ্যে ভয় ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মানবিক ও উদার ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সব মিলিয়ে, ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা বাতিলের এই রেকর্ড সংখ্যক ঘটনা কেবল অভিবাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও মানবাধিকার নীতির দিকেও এক নতুন বিতর্কের সূচনা করেছে।