ঊনবাঙালের আয়োজনে গত সপ্তাহে জ্যামাইকার হিলসাইডে অনুষ্ঠিত হলো তিন দিনব্যাপী একুশের বইমেলা। এই মেলার একটা বিশেষত্ব ছিল এখানে প্রকাশক নয়, লেখক নিজেরা নিজেদের বই নিয়ে স্টল দিয়েছিলেন। একজন মহিলা কবি স্টল দিয়েছিলেন তার একটিমাত্র প্রকাশিত কবিতার বই নিয়ে। একসময় একটি টেলিভিশনের নিউইয়র্ক প্রতিনিধি তার কাছে মাইক্রোফোন নিয়ে এলেন একুশে ফেব্রুয়ারি এবং বইমেলা নিয়ে কিছু কথা বলার জন্য। বাঙালি মহিলা, বাংলা কবিতা বইয়ের লেখক, একুশের মাসে, বাংলা বইমেলায় ঝরঝরে ইংরেজিতে বাংলাভাষার মাহাত্ম্য নিয়ে কথা বললেন।
বইমেলায় স্টল ছিল বিশিষ্ট সাংবাদিক অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মন্জুর। তিনি অনুবাদ সাহিত্যের একজন দিকপাল। বিশ্বখ্যাত লেখকদের প্রায় ৭০টির বেশি বই তার প্রকাশিত হয়েছে। এবার ঢাকায় একুশের বইমেলায় তার নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে হাফ ডজনেরও বেশি। নিউইয়র্ক বইমেলায় ছিল তার অনুবাদ করা জালালুদ্দীন রুমির কবিতার বাংলায় অনূদিত বেশকিছু বই। দ্য সোল অব রুমি’, ‘এ ইয়ার উইথ রুমি’, ‘আমি এবং রুমি।’ ‘কারণ আমি ঘুমাতে পারি না’ ইত্যাদি।
একজন মহিলা কবি তার স্টলে এসে রুমির অনুবাদ করা বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে থাকেন। একসময় তিনি বলতে থাকেন, এখন রুমি অরিজিনাল পড়ি তো, তাই অনুবাদ পড়ে আর ‘মজা’ পাই না। উল্লেখ্য, রুমির মূল বই ফরাসিকে লিখা। তার এই মন্তব্য শুনে হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছিলাম না।
তুলনাহীন নিউইয়র্ক
নিউইয়র্ক সিটির সঙ্গে কোনো কিছুরই তুলনা হয় না। এর আইকনিক আকর্ষণ, বিশ্বমানের খাবার এবং অন্তহীন বিনোদন সারা বিশ্বের মানুষকে আকৃষ্ট করে। আমরা অনেকেই জানি না নিউইয়র্ককে একসময় আমস্টারডাম বলা হতো। এটি ছিল একটি উপহার, যা রাজা দ্বিতীয় চার্লস তার ভাই ডিউক অব ইয়র্কে দিয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত এই নিউইয়র্কের কুইন্সে এবং এটি রকওয়ে বিচ। নিউইয়র্ক সাবওয়েতে আপনি যে সংগীতশিল্পীদের দেখতে পান তারা, কিন্তু অপেশাদার নয়। পাতাল রেলে গান গাইতে হলেও কিন্তু একটি নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই সংগীতশিল্পীদের অনেকেই ভূগর্ভে যাওয়ার আগে বিখ্যাত মঞ্চে পারফর্ম করেছেন। একথা সত্য যে, নিউইয়র্ক সিটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ব্যয়বহুল সিটি। স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে এ ধরনের ব্যয়বহুল একটি সিটিতে বসবাস করা কঠিন। এমনকি মাঝারি আয়ের অনেক লোকজনও এই সিটিতে বসবাস করতে হিমশিম খায়। অর্থনৈতিক সাধ্যে কুলায় না বলে প্রতি বছর বহু নিউইয়র্কবাসী স্বল্প ব্যয় সম্পন্ন সিটিতে চলে যায়। তা সত্ত্বেও অধিকাংশ নিউইয়র্কবাসী এই সিটি ছেড়ে যাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারেন না। এর অন্যতম কারণ ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও নিউইয়র্ক সিটিতে যে সুযোগসুবিধা বিদ্যমান তা আমেরিকার অন্য কোনো স্টেট বা বড় সিটিতে পাওয়া যায় না।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, যোগাযোগব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বয়স্ক সেবার সুবিধা তো আছেই; সর্বোপরি বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে আগত জনগোষ্ঠীর বিপুল সমাবেশের কারণে যে কোনো কমিউনিটি নিউইয়র্ক সিটিতে তাদের দেশীয় আমেজ পায়। তারা অবাধে এখানে তাদের দেশীয় খাবার খেতে পারে, দেশীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির চর্চা করতে পারে।
নিউইয়র্ক সিটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ইমিগ্র্যান্টবান্ধব সিটি বলে এর বাসিন্দার মধ্যে ২৩ শতাংশই ইমিগ্র্যান্ট। শুধু সিটি নয়, নিউইয়র্ক স্টেটের জনসংখ্যারও প্রায় এক-চতুর্থাংশ ইমিগ্র্যান্ট এবং স্টেটের শ্রমশক্তি এক-চতুর্থাংশের বেশি ইমিগ্র্যান্ট। ইমিগ্র্যান্টরা নিউইয়র্ক সিটির অপরিহার্য অংশ। মজুরির পরিমাণ যেমনই হোক না কেন, নিউইয়র্ক সিটিতে অদক্ষ, স্বল্প দক্ষ ও দক্ষ এবং অশিক্ষিত ও শিক্ষিত নির্বিশেষে যে কোনো বয়সের মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের যে সুযোগ রয়েছে, তা দেশটির আর কোথাও নেই। যাতায়াতব্যবস্থার জন্য মেট্রোপলিটন ট্রানজিট অথরিটি বা এমটিএর সাবওয়ে ও বাস নেটওয়ার্ক এতো বিস্তৃত যে, সিটির দূরপ্রান্ত থেকে দিন ও রাতের যে কোনো গ্রহের যে কারো পক্ষে তাদের কর্মস্থলে যাতায়াত করা সম্ভব। সেজন্য দেখা যায়, স্বল্প আয়ের লোকজন যে নিউইয়র্ক সিটি ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবে না, তার প্রধান একটি কারণ যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধা। তারা স্বল্প ভাড়ায় শহরতলিতে থাকে এবং এমটিএর সাবওয়ে বা ট্রেন ব্যবহার করতে পারে।
হোটেল ও ফুড সার্ভিসে নিয়োজিত রয়েছে ৫ লক্ষাধিক লোক। খুচরা ব্যবসায়ে ৩ লাখ, শিক্ষাক্ষেত্রে আড়াই লাখ, পরিবহন ও ওয়্যার হাউসে আরো প্রায় ৩ লাখ। প্রতিটি ক্ষেত্রে ইমিগ্র্যান্ট শ্রমজীবীর অংশ ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। সিটির ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৫৪৭ জন ইমিগ্র্যান্ট ব্যবসায়ী সিটির সেলফ-এমপ্লয়েড শ্রমশক্তির ৩৪ শতাংশ, যাদের বার্ষিক ব্যবসায়িক আয় ৮ বিলিয়ন ডলারের অধিক।
নিউইয়র্ক সিটির পাবলিক স্কুল শিক্ষাব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের অনেক স্টেটের চেয়ে অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক। নিউইয়র্কে রয়েছে নয়টি স্পেশালাইজড পাবলিক হাইস্কুল, যে স্কুলগুলোতে সন্তানদের ভর্তি করানোর জন্য অভিভাবকরা উদগ্রীব থাকেন এবং তাদের ওই স্কুলগুলোতে ভর্তি করানোর জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করেন। স্পেশালাইজড স্কুল থেকে উত্তীর্ণদের অধিকাংশ যুক্তরাষ্ট্রের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বৃত্তিসহ ভর্তির সুযোগ লাভ করে। শিক্ষার সুযোগ অভিভাবকদের নিউইয়র্ক ছেড়ে যেতে বাধা দেয়।
জাজা জাপান : নিউইয়র্কে হালাল জাপানি রেস্টুরেন্ট
হিবাচি রেস্টুরেন্টের সঙ্গে আমাদের অনেকেরই পরিচয় আছে। চারদিকে বসার আয়োজন মাঝে টেবিলে শেফ খাবার রান্না করে পরিবেশন করছে। অনেকেই সে খাবার উপভোগ করেন। কিন্তু হালাল-হারাম প্রশ্ন যাদের মনে উদয় হয়, তারা ইচ্ছে থাকলেও সেই হিবাচি রেস্টুরেন্টের মজাদার খাবার গ্রহণ থেকে বঞ্চিত থাকেন। তবে তাদের জন্য সুখবর!
আমি আপনাদের সে মনোকষ্ট দূর করতে এ সপ্তাহে নিয়ে যাবো একটি হালাল হিবাচি রেস্টুরেন্টে। তার আগে চলুন জেনে নিই, হিবাচি কি? জাপানে ‘হিবাচি’ শব্দের অর্থ ‘আগুনের বাটি’। এটি একটি গোলাকার ধারকসহ একটি গ্রিলিং ডিভাইসকে বোঝায়। এর কথায় হিবাচিকে বলা যায়, জাপানি স্টাইল কুকিং। তবে কুকিংয়ের স্টাইলটি ভিন্ন। একটি হিবাচি গ্রিল বুফে রেস্তোরাঁর গ্রাহকরা বসে শেফকে খোলা আগুনের গ্রিলে খাবার রান্না করতে দেখেন।
লং আইল্যান্ডের জা জা জাপান নামের হিবাচি রেস্টুরেন্টটি একটি এশিয়ান বিস্ট্রো অ্যান্ড স্টিক হাউস। (Asian Bistro & Steak House) এদের হালাল সার্টিফিকেট আছে এবং নিউইয়র্কে আমাদের বাংলাদেশি অথবা মুসলিম গ্রোসারিগুলোতে যারা মাংস সরবরাহ করেন এই জা জা জাপান সেসব প্রতিষ্ঠান থেকেই মাংসের সরবরাহ নেন।
আমি তাদের ম্যানেজ্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি সেসব সার্টিফিকেট আমাকে দেখতে দিয়েছেন, যা আমি কপি করে এনেছি। যারা হালাল হিবাচি বা জাপানি খাবার খেতে চান, তারা সন্দেহাতীতভাবে এই রেস্টুরেন্টের খাবার টেস্ট করতে পারেন।
রেস্টুরেন্টটিতে খাবারের ভ্যারাইটি চয়েজ রয়েছে। সুসি এপিটাইজার, নানা রকম চিকেন, বিফ আইটেম, স্যুপ, সালাদ, নুডুলস, রাইস, আইসক্রিম, চিজ কেক, সিসিমি চিকেন, সি ফুড, শ্রিম্প, পাইন আপন ফ্রায়েড রাইস, ভেজিটেবল, গ্রিন স্যালাড, রেড লবস্টার, স্যালমন, কালামারি ইত্যাদি।
বলা হয় জাপানি খাবার মানেই স্বাদ আর স্বাস্থ্যের মেলবন্ধন। সেই সঙ্গে যদি ‘হালাল’ শব্দটা যোগ হয় তাহলে তা হবে সোনায় সোহাগা। হিবাচি জাপানি খাবারের একটা স্টাইল হলেও জাপানি অন্যান্য খাবারগুলো কিন্তু সুন্দরভাবে পরিবেশন করা হয়।
জাপানে একটি প্রবাদ আছে তাহলো, ‘খাদ্য, একজন ব্যক্তির মতো, একটি শালীন সমাজে নগ্ন অবস্থায় উপস্থিত হতে পারে না।’ জাপানে জনসংখ্যার খুব অল্প শতাংশই স্থূল প্রকৃতির। কারণ জাপানিদের বেশির ভাগই তাজা ফলমূল, শাকসবজি এবং সামুদ্রিক খাবার পছন্দ করে। জাপান চারদিকে সমুদ্র এবং মহাসাগর দ্বারা বেষ্টিত। এজন্য তাদের পক্ষে মাছ এবং আরো অনেক সামুদ্রিক খাবার তৈরি করা সহজ হয়। আর এসব খাবার তৈরিতে তারা বিশেষভাবে দক্ষও। জাপানিরা বিভিন্নভাবে মাছ রান্না করতে পারে। বলা হয় তারা দুই শতাধিক পদ্ধতিতে মাছ রান্না করতে পারে। তারা রান্নায় বিভিন্ন মাছ, যেমন- স্কুইড, অক্টোপাস, শেলফিশ, চিংড়ি, কাঁকড়া, গলদা চিংড়ি এবং আরো অনেক ধরনের মাছ ব্যবহার করে। যেজন্য জাপানি রেস্টুরেন্টগুলোতে মাছের ভ্যারাউটি পদ পাওয়া যায়।
তাই ইঙ্গ-বঙ্গ মিলিয়ে প্রিয়জনদের নিয়ে আপনার পছন্দের খাবারটি উপভোগ করতে ঘুরে আসুন ‘জা জা জাপান’ থেকে। তবে যাওয়ার আগে ফোন করে টেবিলটা হুকুম করে নিন। তাহলে এখানে গিয়ে আর অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে না।
ঠিকানা
জা জা জাপান
৪০০০ জেরিকো টার্নপাইক
ইস্ট নর্থ পোর্ট, নিউইয়র্ক-১১৭৩১
ফোন: ৬৩১ ৪৯৯ ৩৯৩৯