০২ অক্টোবর ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ০৮:২৬:৫৮ অপরাহ্ন


প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন ভ্রমণের সুখস্মৃতি
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-০৭-২০২৫
প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন ভ্রমণের সুখস্মৃতি ভ্রমণে যাওয়া প্রতিনিধিরা


২০ বছর বিশ্বের অন্যতম সুন্দর দেশ অস্ট্রেলিয়া থাকার সুবাদে এবং বিশ্বজুড়ে জ্বালানি পরামর্শক হিসেবে কাজ করার সুবিধায় দুনিয়ার অনেক নয়ন মনোহর সুন্দর স্থান পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছে। কিন্তু মায়ের দেশ বাংলাদেশের বেশকিছু স্থান আমার অনেক অনেক প্রিয়। প্রতিবার বাংলাদেশে সফরকালে ঘুরে দেখি দেশ প্রান্তর। ২০১৬ থেকে বেশ কয়েকবার কক্সবাজার, সুন্দরবন, কুয়াকাটা, দিনাজপুর, সিলেট ভ্রমণ করেছি। ২০২৪ ফেব্রুয়ারি মাসে কক্সবাজার ভ্রমণের একপর্যায়ে দুদিনের সংক্ষিপ্ত সফরে গেলাম সেন্ট মার্টিন। বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দীপ সেন্ট মার্টিন সফর নানা কারণে আমার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। জানিনা সেন্ট মার্টিন নিয়ে বর্তমান টানাপড়েনের কারণে আমাদের পক্ষে আদৌ আর কখনো পরিদর্শনে যাওয়া সম্ভব হবে কি না। 

আমি এখন বাংলাদেশ সফরকালে আমার বুয়েট সহপাঠীর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রকৌশলী সংসদ লিমিটেডের পরামর্শক হিসেবে কাজ করি। পিএসএল প্রতি বছর কর্মকতাদের পারিবারিক বিনোদনের জন্য ঢাকার বাইরে প্রোগ্রাম করে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন পরিচালক এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে ২০২৪ শুরুতে একসঙ্গে বাংলাদেশে থাকায় সিদ্ধান্ত হয় ১০০ জনের একটি গ্রুপ কক্সবাজার এবং সেন্ট মার্টিন ভ্রমণের। আমরা ৬ জন বিশেষ আয়োজনে বিমানে ঢাকা থেকে কক্সবাজার গেলেও বড় গ্রুপটি যায় দীর্ঘ বাস ভ্রমণে। এই সুযোগে আমি পিএসএল পরিচালকদের নিয়ে কক্সবাজার মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেই।

পরিকল্পনা অনুযায়ী সকালে বিমানে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পৌঁছে মাতারবাড়ী কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের পাঠানো মাইক্রোবাস আমাদের জলযানে মাতারবাড়ী পৌঁছে দেয়। যাত্রাপথে আমাদের সুযোগ হয় সাগরে বিস্তৃত হতে থাকা নির্মাণাধীন কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে এবং কুরুশ্কুল বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র দেখার। মাতারবাড়ী অত্যাধুনিক কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্র, কোল টার্মিনাল দেখে এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালন বিষয়ে কারিগরি কর্মকর্তাদের বিশেষায়িত দক্ষতা আমাদের মুগ্ধ করে। আমরা বুঝতে পারি মাতারবাড়ী একমাত্র স্থান যেখানে পর্যাপ্ত ড্রাফট থাকায় কয়লা পরিবাহী বড় জাহাজ এবং এলএনজি, এলপিজি ক্যারিয়ার আনা সম্ভব। এখানেই গড়ে তোলা হবে ভূমিতে এলএনজি টার্মিনাল, গভীর সমুদ্রবন্দর। দীর্ঘসময় কাটিয়ে পরিতৃপ্তি নিয়ে ফিরে আসলাম কক্সবাজার।

পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বিকালটা কাটে নবনির্মিত ঝিনুক আকৃতির কক্সবাজার রেল স্টেশনে। অনুজ বুয়েট প্রকৌশলী ম্যাক্স গ্রুপ নির্মিত রেলস্টেশনটির দায়িত্বে থাকায় আমাদের আধুনিক স্টেশনটির ডিজাইন, নির্মাণশৈলী বর্ণনা করেন। ব্যস্ত দিনশেষে ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরে পরদিন টেকনাফ হয়ে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করি। বলাবাহুল্য, সামুদ্রিক মাছ এবং নানা উপাদেয় খাবার ছিল ডিনারে। 

সেন্ট মার্টিন সফর 

আমাদের বড় দলটি ঢাকা থেকে রাতে রওয়ানা হয়ে বাসযোগে সরাসরি টেকনাফ খেয়াঘাটে পৌঁছে আমাদের অপেক্ষায় ছিল। আমরা কক্সবাজার থেকে মাইক্রোবাসে কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ দিয়ে ১০টা নাগাদ পৌঁছে যাই। যাত্রাপথে বাহারছড়ায় যেখানে আমার ছেলের স্কুল বন্ধু মেজর সিনহাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল সেখানে ক্ষণিকের জন্য দাঁড়িয়ে ব্রিসবেনে থাকা ছেলে শাহরিয়ারকে লাইভ করে দেখাই। আমি নিজেও কিছুটা আবেগাপ্লুত ছিলাম।

টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন কেয়ারি সিন্দাবাদ জাহাজযোগে ৪ ঘণ্টার সমুদ্রযাত্রা ছিল সফরের অন্যতম মূল আকর্ষণ। বাংলাদেশ মায়ানমার প্রান্তসীমায় এ যাত্রার প্রতিটি মুহূর্ত ছিল অনাবিল আকর্ষণের। জাহাজ থেকেই খুব কাছেই আমরা মায়ানমারের কয়েকটি শহর দেখতে পাচ্ছিলাম। পিএসএল সহকর্মীরা গান-নাচে সফরটি স্মরণীয় করে রেখেছিল। আমরা দুপুর নাগাদ সেন্ট মার্টিন পৌঁছলাম। বলতে দ্বিধা নেই প্রথম দর্শনেই নারিকেল কুঞ্জ প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের প্রেমে পড়ে গেলাম। আমাদের হোটেলটি ছিল দ্বীপের সেরা সাগরঘেঁষা শান্তির নীড়। পেট্রোবাংলার প্রাক্তন সহকর্মী মাহবুব আমার রুম সঙ্গী ছিল। দুপুরে সামুদ্রিক মাছ, ভর্তা-ভাজির উপাদেয় খাবার ছিল। বিকালে সবাই সাগরপাড়ে প্রবাল দেখলাম, সূর্যাস্ত দেখলাম। দেখলাম অযত্ন-অবহেলায় প্রবালগুলো মরে যাচ্ছে। সাগরের বালুকা বেলায় পড়ন্ত বিকালে ঘুড়ি উড়িয়েছি। গোল্ড কোস্টের খুব কাছে থাকি। অনেকের জানা প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ে গোল্ড কোস্ট দুনিয়ার অন্যতম সেরা পর্যটন স্থান। আমাদের থেকে জগতখ্যাত গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ খুব দূরে নয়। আপেল টু আপেল তুলনা করবো না। তবে যত্ন নিলে সেন্ট মার্টিনকে অনেক পর্যটনবান্ধব করা যেতে পারে। 

রাতে খাবারের পর হাউজি জকি ছিলাম। সবাই উপভোগ করেছে। রাতে অনেকেই আবার সাগরপাড়ে সময় কাটিয়েছে। আমরা স্থানীয় বাজার থেকে পরিজনের জন্য কিছু উপহার কিনেছিলাম। 

পরদিন সকালে উঠে নামাজ পড়ে খেয়াঘাটে সূর্যোদয় দেখতে গেলাম। দেখলাম, জেলেরা সাগর থেকে মাছ ধরে ফিরছে। আমাদের দুপুরের খাবারের জন্য তাজা মাছ কেনা হলো। হোটেলে ফিরে ভুনা খিচুড়ি দিয়ে সকালের নাশতা। এরপর সবাই মিলে বাংলাদেশের প্রান্তসীমায় তিনটি ছোট ছেঁড়া দ্বীপ পায়ে হেঁটে দেখা। বলাবাহুল্য, আমার পায়ে ব্যথা ছিল, তবুও অদম্য উৎসাহে তিনটি দ্বীপের দুটি পর্যন্ত যেতে পেরেছিলাম। এই তিনটি ক্ষুদ্র দ্বীপ পর্যটকদের অসতর্কতায় অস্তিত্বের হুমকিতে। ইদানীং শুনেছি সেন্ট মার্টিনে পর্যটন নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। যদি ভূরাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে সাধুবাদ জানাবো। একমাত্র প্রবাল দ্বীপ পরিবেশ রক্ষার যে কোনো কার্যক্রম প্রশসংনীয়। তবে যেন এই মনোরম দ্বীপটি কোনো কারণেই ভূরাজনীতির লীলাভূমিতে পরিণত না হয়।

দ্বিতীয় দিন বিকাল সন্ধ্যা কেটেছে সাগরপাড়ে সূর্য অস্ত দেখে। এবার ডিসেম্বরে সিডনি হারাবার আর মার্চে কফস হার্ভারে ছিলাম। আমাদের সবেধন নীলমনি সেন্ট মার্টিনেও আমরা কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনায় পর্যটকবান্ধব করতে পারি। রাতে আমাদের কেটেছে সংগীত অনুষ্ঠান আর আনন্দ আয়োজনে। পরদিন ফিরতি যাত্রা। ভাঙলো মিলনমেলা। কেয়ারি সিন্দাবাদযোগে ফিরতি যাত্রাও ছিল অনাবিল আনন্দের। 

জানি না, আবার কখনো সেন্ট মার্টিন যাওয়ার সুযোগ আসবে কি না। বন্ধুর প্রতিষ্ঠান পিএসএলের সবাইকে অভিনন্দন। টুকরো স্মৃতিগুলো অম্লান থাকবে বহুদিন।

শেয়ার করুন