(দ্বিতীয় পর্ব )
যারা আমাকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনেন, জানেন তারা অবহিত আছেন দেশের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করাকে আমি উপাসনা মনে করতাম। মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্মের একজন হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে নিবেদিত থেকে বাংলাদেশের জ্বালানি সেক্টরের উন্নয়নে ১৯৭৮-২০০৫ সাদ্য সামর্থ্যরে সবটুকু নিবেদন করে অবদান রেখেছি। দেশের সার্বিক স্বার্থের সঙ্গে নিবেদিত থেকে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সফলভাবে নির্দিষ্ট সময়ে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য অন্যতম ভূমিকা পালন করেছি। অনেকের জানা আছে ১৯৯০-২০০৫ নয় দায়িত্বের অতিরিক্ত অনেক জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছি। জ্বালানি খাতকে দুর্নীতি মুক্ত রাখার জন্য আপসহীনভাবে লড়াই করেছি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান সরকারের সময় তিতাস গ্যাসে শুরু করে খালেদা জিয়া নেতৃত্বের বিএনপি জামাত সরকারের সময় পর্যন্ত জ্বালানি সেক্টরের অনেক মাইলস্টোন প্রকল্প বাস্তবায়নে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছি। দেশব্যাপী স্থাপিত জাতীয় গ্যাস সঞ্চালন গ্রিড এবং বিতরণ নেটওয়ার্কের নিউক্লিয়াস সৃষ্টিতে অবদান রাখার সৌভাগ্য হয়েছে। দেশের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক চুক্তি নেগোসিয়েশনে সক্রিয়ভাবে নেগোসিয়েশন করেছি। ২০০৫ যখন দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বিধানে সৃষ্ট জাতীয় গ্যাস সঞ্চালন গ্রিডকে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর গতিশীল কোম্পানিতে পরিণত করার সংগ্রামে ছিলাম তখন ২৫ আগস্ট ২০২৫ অশুভ সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্রে আমাকে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়া চাকরিচ্যুত করা হয়। মহান আল্লাহর কৃপায় অস্ট্রেলিয়া প্রতিষ্ঠান আমাকে চাকরি দিয়ে সরাসরি আমার পরিবারসহ অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যায়।
সেই থেকে গত ২০ বছর থাইল্যান্ড, আফগানিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, মধ্য প্রাচ্য, আফ্রিকার নানা দেশে জ্বালানি পরামর্শক হিসাবে কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করেছি। অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হয়ে অস্ট্রেলিয়া সরকারের অর্থায়নে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কাজে অংশগ্রহণ করেছি। বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বিষয়ে পত্রপত্রিকায় পরামর্শমূলক রিপোর্ট লিখেছি। মিডিয়ায় কথা বলেছি। এখন সিনিয়র অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হিসেবে প্রিভিলেজড নাগরিক হিসাবে অবসর যাপন করলেও মাঝেমধ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহে পরামর্শক হিসেবে কাজ করছি।
পূর্ববর্তী লেখার ধারাবাহিকতায় লিখছি গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস অবকাঠামোর অবর্তমানে দেশের গ্যাস নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে শুরু করলে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ১৯৯০-এর মধ্যভাবে আশুগঞ্জ থেকে বাখরাবাদ গ্যাসক্ষেত্র পর্যন্ত ৩০ ইঞ্চি বাসের ৫৮ কিলোমিটার উচ্চচাপ গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। আর এ দায়িত্ব দেওয়া হয় সদ্য সৃষ্টি করা গ্যাস সঞ্চালন কোম্পানির ওপর। সবাই জানে পেট্রোবাংলার দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়িত উত্তর দক্ষিণ গ্যাস এবং কনডেনসেট পাইপলাইন নির্মাণে নানা বিতর্ক এবং সংকট সৃষ্টি হয়। প্রকল্প ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ঠিকাদার সাইপেম বিয়ানীবাজার থেকে কৈলাশটিলা পর্যন্ত পাইপলাইন অসম্পূর্ণ রেখেই চুক্তির তুলনায় অনেক বেশি অর্থ প্রদানে সরকারকে বাধ্য করে। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে পেট্রোবাংলা এবং সরকার আমাকে পাইপ নির্মাণ কাজে প্রমাণিত পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে বিজিএসএল থেকে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে জিটিসিএলে উপমহাবাবস্থাপক (পাইপ লাইন) হিসেবে পদায়ন করে। নতুন কোম্পানিকে বিশাল গুরুত্বপূর্ণ অথচ চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে কত কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে সেটি ১৯৯৪ -৯৭ পর্যন্ত গ্যাস সেক্টরের কাজ দেখেছেন তারাই জানেন।
১৯৯৪ শুরুতে জিটিসিএলে আমার পদায়ন তৎকালীন প্রতিক্রিয়াশীল চক্র সহজে মেনে নেয়নি। সদ্য সৃষ্ট কোম্পানির প্রকল্প অফিস গুছিয়ে নেওয়ার পর্যায়ে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র আমাকে এবং আমার পরিবারকে নানাভাবে হুমকি দিতে থাকে। পেট্রোবাংলা থেকে বিপুল পরিমাণ অলস জনবলকে জিটিসিএলের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। আমরা সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে উত্তরায় আমাদের অফিস সাজিয়ে নিই।
চ্যালেঞ্জ ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং কুমিল্লা অঞ্চলের নিম্নাঞ্চলে পাইপলাইনের পথস্বত্ব অধিগ্রহণ নিশ্চিত করা। ইতিমধ্যে মালামাল ক্রয় এবং নির্মাণ (পিঅ্যান্ডসি) ভিত্তিতে পাইপলাইন নির্মাণকাজ করার জন্য ফিডিক ফরম অব কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী দরপত্র আহ্বান করা হয়। শুরুতেই অনুভব করি বাংলাদেশের একটি সংগঠিত গোষ্ঠী যে কোনোভাবে দেশীয় পাইপলাইন কনসোর্টিয়ামকে কাজটিতে নিয়োজিত করার জন্য বদ্ধপরিকর। দরপত্রে একটি শর্ত ছিল ঠিকাদার যদি দরপত্রে প্রমাণ করতে পারে দেশীয় সূত্র থেকে প্রকল্প মূল্যের ৫১ শতাংশ কাজ হবে, তাহলে স্থানীয় ঠিকাদার ৭১/২ শতাংশ বিড প্রেফারেন্স পাবে।
আমি যদিও দরপত্র কমিটির সদস্য ছিলাম না। শুরুতে আমাকে সহায়তা করতে বলায় কমিটির অন্যান্য সদস্যদের দৃষ্টিভঙ্গি দেখে কমিটির আহ্বায়ক আমার শ্রদ্ধেয় বুয়েট শিক্ষককে বলে আমি আমার কাজ জমি অধিগ্রহণ কাজে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অফিস মুষ্টিমেয় কয়েকজন কর্মকর্তাকে নিয়ে কাজ শুরু করলাম। অনেকের স্মরণে থাকবে উত্তর-দক্ষিণ পাইপলাইন নির্মাণে মূল সংকট ছিল পথস্বত্বের জমি নিয়ে স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে সমস্যা।
বিশ্বব্যাংক এবং সরকার বিষয়টি অনুধাবন করে প্রথমবারের মতো জমির মূল্যের ওপর ১০ শতাংশ অতিরিক্ত প্রিমিয়াম সরাসরি প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। স্মরণে আছে মাহমুদ খান, মুহিত মফিজ, শ্যামল রয় এবং কয়েকজন তরুণ প্রকৌশলীকে সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে দুই মাসে অকুস্থলে ৩ কোটি টাকা সরাসরি জমির মালিকদের হাতে তুলে দিই। বলতেই হবে এ কাজটি সার্থকভাবে করে পরবর্তী সময়ে জমির মালিকদের কারণে পাইপলাইন নির্মাণকাজে কোনো সমস্যা হয়নি।
ওদিকে পাইপলাইন নির্মাণকাজের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি দ্বিতীয় নিম্নতম দরদাতা স্থানীয় ঠিকাদার গোষ্ঠী এবং দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই কনসোর্টিয়ামকে ৭১/২ শতাংশ বিড প্রেফারেন্স দিয়ে কাজটি প্রদানের সুপারিশ করে। জিটিসিএল বোর্ড এবং পেট্রোবাংলা বোর্ডে অনুমোদনের পর প্রস্তাবটি বিশ্বব্যাংকে পাঠানো হলে বিশ্বব্যাংকের নির্দিষ্ট শাখা প্রশ্ন তুলে পাইপলাইনের উপকরণ এবং নির্মাণ সামগ্রী বিদেশ থেকে আমদানি বাবদ ৭০ শতাংশ খরচ হওয়ার কারণে কোনোভাবেই স্থানীয় ঠিকাদার বিড প্রেফারেন্স পেতে পারে না। এমতাবস্থায় বিশ্বব্যাংক জানায় বাংলাদেশ সরকার তাদের সুপারিশ মতো অগ্রসর হলে মিসপ্রকিউরমেন্ট বিবেচনা করে বিশ্বব্যাংক অর্থ প্রদানে বিরত থাকবে। সে সময় বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে তীব্র আন্দোলন দানা বাঁধছিল। একপর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আইনি লড়াই শুরু হয়। তবে পরবর্তী সময়ে সরকার বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়ন সঠিক বিবেচনা করে প্রকৃত নিম্নতম দরদাতা অস্ট্রেলিয়ার ম্যাককোনেল ডাওয়েলের অনুকূলে প্রকল্প চুক্তি প্রদান করে।
এসব কাজে অনেক সময় অতিবাহিত হয়। বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত নিম্নাঞ্চলে পাইপলাইন নির্মাণ করা যায় না। ১৯৯৬ বর্ষা মৌসুমের মাত্র কয়েকমাস আগে চুক্তি হওয়ায় ঠিকাদার নানা টালবাহানা করতে থাকে। একপর্যায়ে পাইপলাইন কোটিং এবং কংক্রিট কোটিং দেশে না করে বিদেশে করার সুযোগ দেওয়ার শর্তে ঠিকাদার সুবিধাজনক শর্তে দ্রুততম সময়ে প্রকল্প সম্পাদনের প্রস্তাব দেয়।
ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের জন্য নির্ধারিত বাখরাবাদ এবং ফেনী গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন বিভ্রাট দেখা দিলে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশে গ্যাস সরবরাহ সংকটের মুখে পড়ে। প্রকল্পের এই ক্রান্তিলগ্নে সীমিত সময়ের জন্য আমি প্রকল্প ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে ছিলাম। এ সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গন ছিল উত্তপ্ত। কামাল হোসেন অ্যাসোসিয়েটস আমাদের আইনি সহায়তা দেওয়ায় আমরা পরিবর্তিত চুক্তি স্বাক্ষর করি। আমি নিজে ভারত হয়ে মেক্সিকোতে পাইপলাইন নির্মাণকাজ পরিদর্শন করি। জিটিসিলের একটি কারিগরি টিম মালয়েশিয়ার কুয়ানটনে পাইপ কোটিং কংক্রিট কোটিং পরিদর্শন করে।
সবাই জানে ১৯৯৬ সালে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে আশুগঞ্জ বাখরাবাদ প্রকল্পটি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারভিত্তিক জাতীয় প্রকল্পে পরিণত হয়। রাজনৈতিক বৈরিতার কারণে সরকারের প্রতিপক্ষ পাইপলাইন নির্মাণকাজে নানাভাবে বাধা প্রদান করতে থাকে। বেশ কয়েকবার প্রকল্প ব্যবস্থাপক এবং জিটিসিএল ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিবর্তিত হলেও আমাকে প্রকল্পের ‘দি ইঞ্জিনিয়ার’ নিয়োজিত রাখা হয়। সবাই জানে একটি নিবেদিত জিটিসিএল মাঠপর্যায়ের সাহসী কর্মকর্তাদের আত্মনিবেদনের কারণে ১৯৯৭ সালে সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে প্রকল্পটি শেষ হয়। চট্টগ্রাম শহরসহ দেশের গ্যাস সরবরাহে স্বস্তি আসে। মাঠ পর্যায়ে আমার সঙ্গে কাজ করা টিমটি ছিল স্বদেশ প্রেমে উৎবুদ্ধ, অনুপ্রাণিত, যারা আমার সাথি ছিল তাদের কয়েকজন এখন পরলোকে।
বিস্তারিত আলোচনায় যাবো না। এ প্রকল্পে আমার কতটুকু অবদান ছিল সেটি যারা আমাকে ওই সময় দেখেছে তারাই বলতে পারবে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে কেউ ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কেউ পেট্রোবাংলা পরিচালক হলেও আমাকে পদোন্নতি বঞ্চিত রাখা হয়। গর্ব করতেই পারি আমাদের সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় প্রকল্পটি আওয়ামী লীগ সরকারের ১৯৯৬-২০০১ পর্বের শুরুতে সম্পাদিত হওয়ায় সরকার জ্বালানি সঙ্কট থেকে মুক্তি পায়। বাংলাদেশের জ্বালানি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের ইতিহাসে আশুগঞ্জ বাখরাবাদ পাইপলাইন প্রকল্প নানা কারণে মাইল স্টোন হিসাবে বিবেচিত হবে।
প্রকল্পের নথিপত্র সঠিকভাবে সংরক্ষিত থাকায় প্রকল্প শেষে ঠিকাদার বিশাল দাবি করলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একপর্যায়ের প্রধান মরহুম জাস্টিস হাবিবুর রহমানের মেডিয়েশন হেরে যায় ঠিকাদার। তথাপি ঠিকাদারের সঙ্গে পেশাদারি সম্পর্ক অক্ষুণ্ন ছিল। ২০০৫ সালে আমাকে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হলে মাককোনেল ডাওয়েল অস্ট্রেলিয়ান সরকারকে অনুরোধ করে আমাকে চাকুরী দিয়ে পরিবারসহ অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যায়। (চলবে)