মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গ্রিনকার্ডধারী স্থায়ী বাসিন্দা কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মোহসেন মাহদাউই গত ৩০ এপ্রিল জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। ভেরমন্ট জেলা ফেডারেল আদালতের বিচারক জিওফ্রি ডব্লিউ ক্রফোর্ড এই দিন একটি রায় দেন, যার মাধ্যমে মাহদাউইকে জামিনে মুক্তির নির্দেশ দেন, যদিও তার বিরুদ্ধে একটানা আটকের বিরুদ্ধে হ্যাবিয়াস পিটিশন নিষ্পত্তির জন্য আরো শুনানি হবে। বিচারক সরকার পক্ষের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে মাহদাউইয়ের মুক্তি সাতদিন দেরির অনুরোধ মঞ্জুর করেননি। মাহদাউইকে ১৪ এপ্রিল ভেরমন্টে একটি নাগরিকত্ব সাক্ষাৎকারে অংশ নিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসি) আটক করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তিনি আমেরিকান সরকারের নীতি ও নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর হতে পারেন, বিশেষ করে তার ফিলিস্তিনি অধিকার সমর্থনকারী কর্মকাণ্ডের জন্য। তবে তার আইনজীবীরা দাবি করেছেন যে, এই আটকটি মূলত তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর আক্রমণ এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফলস্বরূপ।তার আটককে অবৈধ দাবি করে মাহদাউইয়ের আইনজীবী দল তার মুক্তির আবেদন জানান। যুক্তরাষ্ট্র সরকার অভিযোগ করেছে যে, মাহদাউই মার্কিন বিদেশনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন, তবে তার আইনজীবীরা এই আটককে প্যালেস্টিনীয়দের পক্ষে তার কর্মসূচি ও পরিচয়ের কারণে প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। দীর্ঘ দুই সপ্তাহ ফেডারেল ইমিগ্রেশন হেফাজতে থাকার পর, ৩০ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আদালত তাকে জামিনে মুক্তির আদেশ দেয়।
মাহদাউই মুক্তি পাওয়ার পর ভেরমন্ট কোর্টের বাইরে তিনি বলেন, আমি পরিষ্কারভাবে বলছি, আমি আপনাদের ভয় পাচ্ছি না। আমি জানি, যা ঘটছে তা সঠিক নয়। আমরা যা দেখছি তা আসলে ডঃ মার্টিন লুথার কিংয়ের কথার মতো যেকোনো স্থানেই অযথা অবিচার, সব জায়গাতেই ন্যায়বিচারের জন্য হুমকি। মাহদাউই তার বক্তব্যে আরো বলেন, আমাদের উচিত মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো। কারণ পৃথিবী শুধু ফিলিস্তিন নয়, সারা পৃথিবীই আমাদের দেখছে। আমেরিকার কার্যক্রম পুরো বিশ্বে প্রভাব ফেলবে, এবং আমাদের উচিত মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলা। তিনি আরো বলেন, মুক্তির পর তার সমর্থকদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আমরা শান্তির পক্ষে এবং যুদ্ধবিরোধী। তিনি প্যালেস্টাইনবাসীর প্রতি সংহতি জানিয়ে বলেন, আমি আপনার দুঃখ অনুভব করি, আমি আপনার যন্ত্রণা দেখি এবং আমি স্বাধীনতা দেখি, তা খুব শিগগিরই আসবে।
আদালত তার জামিনের আদেশ দেওয়ার পর, সরকার জামিন স্থগিত রাখতে সাতদিনের সময় চেয়েছিল, তবে বিচারক এই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। মাহদাউই মুক্তি পাওয়ার পর, আমেরিকান নাগরিকদের নিরাপত্তা ও বিদেশি নীতির প্রতি তার অবস্থান সম্পর্কে অনেক বিতর্ক শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সহকারী সেক্রেটারি ট্রিশিয়া ম্যাকলফলিন একটি বিবৃতি দিয়ে বলেন, যখন কেউ সহিংসতার পক্ষে কথা বলে এবং সন্ত্রাসীদের সমর্থন করে, তখন তাকে আমেরিকায় থাকার অধিকার দেওয়া উচিত নয়। তিনি আরো বলেন, কোনো বিচারক, এই বিচারক বা অন্য কোনো বিচারক, ট্রাম্প প্রশাসনকে আমাদের অভিবাসন ব্যবস্থায় আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে বিরোধিতা করতে পারবে না।
মাহদাউইয়ের বিরুদ্ধে আরও কিছু অভিযোগ ছিল যে, তিনি পূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র কেনাবেচার সঙ্গে সম্পর্কিত কাজ করেছেন এবং তাকে পূর্বে শত্রুতাপূর্ণ কথাবার্তা বলার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। তবে মাহদাউইয়ের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমি কখনো এমন কথা বলিনি, যা আমাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আমি একজন শান্তিপূর্ণ ব্যক্তি এবং কখনো কাউকে হানিকর বা হত্যা করতে চাইনি। মাহদাউইয়ের আইনজীবী দলের অংশ আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন , তাদের বিবৃতিতে জানায় যে, মাহদাউইয়ের বিরুদ্ধে সরকারি অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং মার্কিন সংবিধানের অবমাননা। মাহদাউইয়ের আইনজীবী লুনা দৌরুবি বলেন, তিনি মুক্তির পর ভীষণভাবে প্রশান্তি অনুভব করছেন এবং প্রতিশ্রুতি দেন যে, আমরা লড়াই চালিয়ে যাব যতক্ষণ না মোহসেন সম্পূর্ণরূপে মুক্তি পায়।
মাহদাউই জন্মগ্রহণ করেন পশ্চিম তীরের আল-ফারা শরণার্থী শিবিরে। সেখানে তার অনেক পরিবার এখনো বসবাস করছে। ১৫ বছর বয়সে তিনি ইসরায়েলি সেনার গুলিতে আহত হন এবং তারপর যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। ২০২১ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি ফিলিস্তিনি অধিকার সমর্থক এবং গত বছর তিনি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনি বিষয়ক প্রতিবাদে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
এদিকে তার মুক্তির খবর ছড়িয়ে পড়ার পর অনেক আমেরিকান ছাত্র এবং অধিকারকর্মী তার মুক্তির সমর্থনে আওয়াজ তোলেন। মাহদাউই নিজেও তার মুক্তির পর বলেন, আমার স্বাধীনতা শুধু আমার নয়, এটি অন্যান্য অনেক ছাত্রেরও স্বাধীনতার সঙ্গে সংযুক্ত। এই ঘটনা একদিকে যেমন তার নিজের সংগ্রামের প্রতিফলন, তেমনি এটি আরেকটি উদাহরণ যে, কীভাবে ইমিগ্রেশন ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে। মাহদাউই, তার সহযোদ্ধা রুমেসা ওজটুর্ক এবং মাহমুদ খলিলসহ অন্যান্য ফিলিস্তিনি অধিকারকর্মীদের মুক্তির জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। মাহদাউইয়ের এই ঘটনা আন্তর্জাতিকভাবে ফিলিস্তিনির অধিকার আন্দোলনের প্রতি আরো আগ্রহ সৃষ্টি করবে এবং আমেরিকান ইমিগ্রেশন নীতির প্রতি নতুন প্রশ্ন তৈরি করবে।