যুক্তরাষ্ট্রের হাউস রিপাবলিকানরা মেডিকেইড থেকে ৮৮০ বিলিয়ন ডলার কাটছাঁটের একটি বিতর্কিত পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে। হাউস রিপাবলিকানদের উন্মোচিত ‘বড়, সুন্দর বিল’-এর অধীনে শুধু মেডিকেইড, সোশ্যাল সিকিউরিটি এবং খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি স্নাপ বা ফুড স্ট্যাম্প থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাজেট কাটছাঁটের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রস্তাবের মূল উদ্দেশ্য ট্রাম্প প্রশাসনের ২০১৭ সালের করছাড় পুনর্বহাল রাখতে ৪.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের খরচ পূরণ করা। এই বিলটির মাধ্যমে মূলত মেডিকেইড এবং ওবামাকেয়ার নামে পরিচিত ‘অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট’-এ বড় ধরনের পরিবর্তন আনার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। রিপাবলিকানদের দাবি, এই প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলো মূলত ‘অপ্রয়োজনীয় ব্যয়, জালিয়াতি এবং অপব্যবহার’ রোধ করার জন্য এবং প্রকৃত যোগ্য ব্যক্তিদেরই সেবা দেওয়া নিশ্চিত করার জন্য নেওয়া হয়েছে। তবে ডেমোক্র্যাটরা একে একটি ‘লজ্জাজনক এবং নির্মম’ পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং বলেছেন, এর ফলে লাখ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা হারাবেন।
সোশ্যাল সিকিউরিটি খাতে যে পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো পেনশন পাওয়ার বয়স ৬৭ থেকে বাড়িয়ে ৬৯ করা। এতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরো বেশি সময় কাজ করতে হবে পেনশন সুবিধা পাওয়ার জন্য। এছাড়াও পেনশনের হিসাব পদ্ধতি পরিবর্তন করে এমন একটি কাঠামো চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে, যা অনেকের জন্য বার্ষিক পেনশনের পরিমাণ কমিয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রী, সন্তান ও প্রতিবন্ধী সদস্যদের জন্য নির্ধারিত অতিরিক্ত সুবিধাগুলোকেও ধীরে ধীরে কমিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে, যা অনেক পরিবারকে আর্থিক চাপের মুখে ফেলবে। খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি স্ন্যাপের ক্ষেত্রে, রিপাবলিকানরা এটি ব্লক গ্র্যান্টে রূপান্তর করার প্রস্তাব করেছে, যার ফলে স্টেটগুলো নির্দিষ্ট বাজেট পাবে এবং তারা নিজেদের মতো করে এই সহায়তা বিতরণ করবে। এটি অনেক ক্ষেত্রে সুবিধাভোগীদের সংখ্যা কমিয়ে দিতে পারে। এ ছাড়া কর্মক্ষম ব্যক্তিদের জন্য বাধ্যতামূলক কাজের শর্তারোপের কথা বলা হয়েছে, ফলে যারা কাজ খুঁজে পাচ্ছেন না বা অস্থায়ীভাবে কর্মহীন, তারাও সহায়তা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হচ্ছে ‘মিতব্যয়ী খাদ্য পরিকল্পনা’ যার ভিত্তিতে স্ন্যাপ সুবিধার পরিমাণ নির্ধারিত হয় এর আপডেট বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব। এর ফলে খাদ্য সহায়তার বাস্তব মূল্য হ্রাস পাবে এবং অনেক সুবিধাভোগীর জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য কিনে চলা কঠিন হয়ে পড়বে।
এই প্রস্তাবিত কাটছাঁটগুলো বাস্তবায়িত হলে দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের ওপর তা মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। অনেকেই স্বাস্থ্যসেবা, অবসরকালীন নিরাপত্তা ও ন্যূনতম খাদ্য সহায়তা হারাতে পারেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থার মৌলিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স এই উদ্যোগকে অলিগার্কির প্রকৃত উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, ‘ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে, আর গরিবরা স্বাস্থ্যসেবা হারাচ্ছে, এটা সম্পূর্ণ অমানবিক।
কংগ্রেশনাল বাজেট অফিসের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, এই প্রস্তাব কার্যকর হলে আগামী ১০ বছরে অন্তত ৮.৬ মিলিয়ন মানুষ স্বাস্থ্য বীমা থেকে বঞ্চিত হবেন। এর ফলে শুধু ব্যক্তিগতভাবে নয়, বরং সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, হাসপাতাল এবং চিকিৎসা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপ বাড়বে। হাউস এনার্জি অ্যান্ড কমার্স কমিটির চেয়ারম্যান রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ব্রেট গ্যাথরি বলেছেন, এই সাশ্রয়ের মাধ্যমে আমরা ট্রাম্পের করছাড় পুনর্নবীকরণ করতে পারবো এবং মধ্যবিত্ত আমেরিকানদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারবো। কিন্তু এর বিপরীতে ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি ফ্র্যাঙ্ক প্যালোন বলেন, এই বিল পাস হলে হাসপাতালগুলো বন্ধ হবে, প্রবীণরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাবেন না এবং সাধারণ মানুষের প্রিমিয়াম আরো বেড়ে যাবে।
বিলটির সবচেয়ে বড় অংশজুড়ে রয়েছে মেডিকেইড প্রাপ্যতার শর্তে বড় পরিবর্তন। এখন থেকে ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম, সন্তানহীন প্রাপ্তবয়স্কদের মেডিকেইড সেবার জন্য প্রতি মাসে অন্তত ৪০ ঘণ্টা কাজ, পড়াশোনা বা স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে হবে। এটি কার্যত একটি ‘ওয়ার্ক রিকোয়ারমেন্ট’ হিসেবে দাঁড়াবে, যা অনেকের জন্যই বাস্তবায়ন করা কঠিন হতে পারে। বিশেষ করে যারা দূরবর্তী বা সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলে থাকেন এবং যারা অস্থায়ীভাবে কাজ হারিয়ে ফেলেন, তাদের জন্য এই শর্ত বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
প্রাপ্যতা যাচাইয়ের নিয়মেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আগে যেখানে বছরে একবার যাচাই করলেই চলতো, এখন তা বছরে দুইবার করতে হবে। এর ফলে অনেকেই নানা কারণে সময়মতো কাগজপত্র জমা দিতে না পারায় প্রাপ্যতা হারাতে পারেন, যার ফলে তৈরি হবে ‘কভারেজ চর্ন’— অর্থাৎ মানুষ বারবার বীমা হারিয়ে ফের আবেদন করতে বাধ্য হবেন। আয় যাচাইয়ের ক্ষেত্রেও কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে, বিশেষ করে যারা ওবামাকেয়ারের আওতায় আছেন। যারা ফেডারেল দারিদ্র্যসীমার ১০০ শতাংশের বেশি আয় করেন (একটি চার সদস্যের পরিবারের জন্য যা প্রায় ৩২ হাজার ডলার তাদের কিছু নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যসেবার জন্য নিজের পকেট থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ ডলার পর্যন্ত খরচ করতে হতে পারে। তবে এই ফি জরুরি বিভাগ, গর্ভকালীন সেবা, শিশুচিকিৎসা এবং প্রাথমিক চেকআপের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
বাড়ির সম্পদের ওপর ভিত্তি করে প্রাপ্যতার সীমাও নির্ধারণ করা হয়েছে। যার ব্যক্তিগত বাসস্থান এক মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের, তিনি আর মেডিকেইডের আওতায় পড়বেন না। যদিও এই ধরনের সম্পদের মালিকদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, তবে এটি একটি রাজনৈতিক বার্তা বহন করছে যে সরকার চাইছে ‘ধনী অথচ সুবিধা নিচ্ছেন’ এমন নাগরিকদের বাদ দিতে।
অবৈধ অভিবাসীদের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। যে রাজ্যগুলো অবৈধ অভিবাসীদের স্থানীয় ফান্ড দিয়ে মেডিকেইডের আওতায় রাখে, সেসব রাজ্যের জন্য ফেডারেল ফান্ড ১০ ভাগ কমিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এছাড়া ওবামাকেয়ারভুক্ত স্বাস্থ্যসেবার জন্য আবেদন করতে হলে অবশ্যই বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন তা প্রমাণ করতে হবে। এই পদক্ষেপগুলো মূলত অভিবাসনবিরোধী অবস্থান থেকেই এসেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
প্রস্তাবিত এই বিলটির প্রভাব শুধু স্বাস্থ্যসেবা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়; এটি পরিবেশ ও শক্তি খাতেও বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছে। বাইডেন প্রশাসনের অধীনে গৃহীত জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত নীতিমালাগুলোর মধ্যে অনেকগুলোকে এই বিলের মাধ্যমে প্রত্যাহার করার পরিকল্পনা রয়েছে। বিশেষ করে ক্লিন এনার্জি প্রজেক্ট ও সবুজ প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের জন্য বরাদ্দ তহবিল বাতিল করার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেল পাইপলাইন প্রকল্পগুলোর অনুমোদন প্রক্রিয়া দ্রুত করার জন্য ‘এক্সপেডাইটেড পারমিটিং’ পদ্ধতির কথাও বলা হয়েছে।
এই বিলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। যদিও হাউস স্পিকার মাইক জনসন ২৭ মে মেমোরিয়াল ডের আগেই বিলটি পাস করাতে চান, তবুও নিজ দলের ভেতর থেকেই কিছু রিপাবলিকান এই বিলের বিরোধিতা করছেন। অন্তত ডজনখানেক রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা জানিয়েছেন, তারা নিজ নিজ এলাকার বাসিন্দাদের স্বার্থে স্বাস্থ্যসেবা খাতে এত বড় কাটছাঁট সমর্থন করতে পারবেন না। এমনকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেও জনসমক্ষে বলেছেন, তিনি মেডিকেইডে কাটছাঁট চান না। এই অবস্থায় মিসৌরির সিনেটর জশ হাওলি একটি খোলামেলা নিবন্ধে সতর্ক করেছেন, স্বাস্থ্যসেবা কেটে করছাড় চালু রাখা নৈতিকভাবে ভুল এবং রাজনৈতিকভাবে আত্মঘাতী। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স এই পরিকল্পনার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, এটাই অলিগার্কি (ধনীর শাসন)—ধনীরা আরো ধনী হয়, দরিদ্ররা স্বাস্থ্যসেবা হারায়। এটি একেবারেই ন্যক্কারজনক।
সব মিলিয়ে, ট্রাম্পের করছাড় বাঁচাতে গিয়ে যে মেডিকেইড এবং স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে এতো বড় কাটছাঁট প্রস্তাব করা হয়েছে, তা শুধু কংগ্রেস নয়, গোটা দেশের রাজনীতিতে এক নতুন উত্তেজনার সূচনা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো কেমন থাকবে, তা নির্ভর করছে এই বিলের ভাগ্যের ওপর। এখন দেখার বিষয়, রাজনৈতিক চাপ ও জনমত বিবেচনায় রেখে শেষ পর্যন্ত রিপাবলিকানরা তাদের প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় কতটা স্থির থাকতে পারেন।