১৭ জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ০৬:৫৩:০৮ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
গোপালগঞ্জ এখন মুজিববাদী সন্ত্রাসীদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে- নাহিদ এনসিপি’র মার্চ টু গোপালগঞ্জ কর্মসূচি ঘিরে ব্যাপক সংঘর্ষ চারজন নিহত নিউইয়র্কে ২০ লাখ মানুষ মেডিকেইড ও ৩ লাখ পরিবার স্ন্যাপ সুবিধা হারাবে নতুন ভিসা ফিতে বাংলাদেশিদের খরচ বাড়বে আড়াই গুণ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ২ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি মাহমুদ খলিলের টেক্সাসের অভিবাসন আইন এসবি ৪ অসাংবিধানিক ঘোষণা ফ্লোরিডার ‘সিনেট বিল ৪-সির কার্যকারিতা বন্ধ করলো যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট নতুন নীতি ঘোষণা : ৯ কারণে নাগরিকত্ব হারাতে পারেন জঙ্গিবাদে সতর্ক থাকার মার্কিনী পরামর্শে নানা প্রশ্ন এনসিপিসহ ১৪৪ নিবন্ধন প্রত্যাশী দলের তথ্যে ঘাটতি


জাপানের সমরাস্ত্র উন্নয়ন চীন ও ট্রাম্পকে বিস্মিত করেছে
মঈনুদ্দীন নাসের
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৮-০৬-২০২৫
জাপানের সমরাস্ত্র উন্নয়ন চীন ও ট্রাম্পকে বিস্মিত করেছে প্রতীকী ছবি


জাপান তার সাংবিধানিক ‘শান্তিবাদ’ পরিত্যাগ করে আক্রমণের শক্তি সঞ্চিত করে আমেরিকার সার্বক্ষণিক সামরিক অংশীদার হতে তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে। সাম্প্রতিক বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার জাপান সফরের সময় জাপান বাংলাদেশের ডিফেন্স পার্টনার হওয়ারও প্রস্তাব রেখেছে। দীর্ঘদিন ধরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোড়খাওয়া জাপান অস্ত্র নির্মাণ পরিত্যাগ করলেও বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে আমেরিকা জাপানকে অস্ত্র তৈরিতে উৎসাহিত করে। তখন জাপান বলেছিল যদি জাপান ইচ্ছা করে তার যে কারিগরি দক্ষতা রয়েছে, তা ব্যবহার করে জাপানের অস্ত্রভান্ডার বিশ্বে সমীহ করার মতো পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবে। জাপান বলেছিল তারা তাদের শান্তিবাদ নিয়ে থাকতে চায়। কিন্তু পরম্পরায় বিশ্ব বদলিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, জাপান এখন ভারী অস্ত্র যেমন জোগান দিচ্ছে নিজেদের অস্ত্র ভান্ডারে অস্ত্র আমদানি করে, তেমনি নিজেরাও ভারী অস্ত্র নির্মাণ করে সম্প্রতি বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। আর ‘বে অব বেঙ্গলে’ আধিপত্যবাদের হম্বিতম্বির মুখে জাপান বাংলাদেশে প্রতিরক্ষা অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার ওপরও নজর দিয়েছে। জাপানের প্রস্তাবে নতুনত্ব হচ্ছে চীন যেখানে অস্ত্র বাণিজ্যের ওপর নজর দিয়েছে, সেখানে জাপান অস্ত্র নির্মাণ খাতে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চায়। এক্ষেত্রে জাপান নারায়ণগঞ্জে তাদের স্পেশাল ইকোনমিক জোনকে যেমন ব্যবহার করতে চায়, তেমনি চট্টগ্রামে তাদের মাতারবাড়ী পোর্টকে কেন্দ্র করে নতুন করে ডিফেন্স বিনিয়োগ সৃষ্টি করতে চায়। 

সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জাপান নৌবাহিনীতে জাহাজ বিধ্বংসী মিসাইল সংযোজন করা হয়েছে। জাপানি সেনাবাহিনীর সপ্তম রেজিমেন্টের ঘন সবুজ ট্রাকের ওপর শোভিত হচ্ছে। তা সহজে চলাচল ও লুকিয়ে রাখা যায়। কিন্তু এখন সেনাবাহিনী তা লুকোনোর কোনো প্রয়াস না নিয়েই ঘোরাফেরা করছে। অনেকে মনে করেন, জাপান যা দেখাচ্ছে তার চেয়ে তারা অনেক দূর বেশি এগিয়ে আছে। জাপান এ অস্ত্র আবিষ্কার করেছে এক বছর আগে আর এই মিসাইল স্থাপন করা হয়েছে অকিনাওয়া দ্বীপের পাহাড়ের চূড়ায়, যা কয়েক মাইল দূর থেকে দৃশ্যমান। মনে করা হচ্ছে, জাপান ইচ্ছাকৃতভাবে এ মিসাইল প্রদর্শন করছে। জাপানের সপ্তম রেজিমেন্ট দুটি মিসাইল রেজিমেন্টের একটি-যা নতুন তৈরি করা হয়েছে। এই মিসাইল এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যা চীনের নেভি, যারা প্রতিনিয়ত জাপানের পানিসীমার মধ্য দিয়ে চলাচল করে, তাদের বিরুদ্ধে উত্তর দেওয়ার জন্য তৈরি। জাপান বলছে, তাদের অস্ত্র প্রদর্শনী কোনো বহিঃশত্রুকে সতর্ক করার জন্য।

চীন তাদের একমাত্র টার্গেট নয়। এ প্রদর্শনী যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও। কারণ কিছুদিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জাপানকে এই বলে সমালোচনা করেছিল, জাপান আমেরিকান মিলিটারি বেসের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। কিন্তু জাপানের এ অস্ত্র মোতায়েন আমেরিকাকেও ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করে দিয়েছে, ট্রাম্পকে তো বটেই। জাপান ট্যারিফ নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে দেন-দরবার করলেও তাদের প্রধান উদ্দেশ্য নিরাপত্তা চুক্তি। জাপান ইতিমধ্যে আমেরিকার সঙ্গে ট্যারিফ কমানোর পাশাপাশি জ্বালানি, কম্পিউটার চিফ ও অস্ত্র কিনতে চায়, যা আমেরিকা বেচতে চায়।

জাপান আমেরিকার কাছে প্রতীয়মান হতে চায়, তারা আমেরিকার জন্য অপরিহার্য অংশীদার। তাই জাপান এতো দীর্ঘ সময়ের সীমিত সামরিক বাহিনীকে এমন এক শক্তিধর বাহিনীতে রূপান্তর করতে চায়, যাতে তারা দক্ষতা ও কারিগরি দিক থেকে আমেরিকার জাহাজ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে একযোগে কাজ করতে পারে। জাপান বলেছে তারা চায় আমেরিকা তাদের সঙ্গে আছে কি না? একই সঙ্গে তারা বর্তমান সামরিক শক্তিকে বৃদ্ধি করতে চায়। জাপানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা ট্রাম্পকে দেখাতে চায়, তারা এক প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান মিত্র।

জাপান ও পশ্চিমা বিশ্ব মনে করে, ইউক্রেনে রাশিয়া যেভাবে যুদ্ধ চালাচ্ছে, তেমনি চীনও তাইওয়ানে যুদ্ধ চালাতে পারে। ২০২২ সালে জাপান তখন ঘোষণা করে, তারা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য জিডিপির ২ শতাংশ ব্যয় করবে। এই পরিকল্পনা এখন চলছে। জাপান ব্যয়বহুল এফ-৩৫বি কিনছে আমেরিকা থেকে। আরো কিনছে টোমাহক ক্রুজ মিসাইল। এসব ভারী অস্ত্র জাপানকে ১৯৪৫ সালের পর নতুন করে টার্গেটে হামলার শক্তি দেবে। এ ব্যয়ের মধ্যে প্রধানত রয়েছে জাপানের নিজস্ব ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়ন। টোকিওর কাছে ট্রেডশোর মেলায় গত মে মাসে জাপানের উৎপাদিত হচ্ছে যেমন-হাইপারসনিক মিসাইল, ড্রোনকে ভূপাতিত করার লেজার সিস্টেম এবং ব্রিটেন ও ইতালির সঙ্গে মিলে জেট ফাইটার তৈরি করতে চায়।

শুধু তাই নয়, জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এককাট্টা হয়ে যুদ্ধ করার জন্য ভবিষ্যতে তৈরি থাকতে চায়। টোকিওতে জাপান যুদ্ধ করার জন্য একটি নতুন হেডকোয়ার্টার্স করতে চায়। সেখানে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র পরস্পর এক হয়ে কাজ করবে। 

জাপান-আমেরিকা ফার্স্টের মতো একাকীত্বের নীতি ও ট্রাম্পের অনিশ্চিত কথাবার্তা নিয়ে সন্দিহান। জাপান মনে করে, ট্রাম্প চীনের সঙ্গে কৌশলগত ডিলও করতে পারে। জাপান চায় না আমেরিকার সঙ্গে চীনের কোনো স্ট্র্যাটেজিক চুক্তি হোক। 

চীন ইতিমধ্যে জাপানের সমালোচনা শুরু করে দিয়েছে। চীন কোনো দায়িত্ব নিতে চায় না কোনো দেশের। নিজের আধিপত্যবাদ নীতিকে ধারণ করলেও ভারতের ঘরপোড়া নীতিকে পরোক্ষভাবে ঘায়েল করে। বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ আছে। কিন্তু তারা একই সঙ্গে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়। এক্ষেত্রে জাপানের সব ধরনের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ রয়েছে। চীন ডিফেন্স সাহায্যের নামে পুরোনো মালের ডাম্পিং গ্রাউন্ড করে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহকে। বাংলাদেশকেও করেছে। যেমন ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ের সময় সমুদ্রের লোনা পানিতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ৪৮টি যুদ্ধবিমান ছিল ‘ডেথ ট্র্যাপ’। অনেক সেনাসদস্য এগুলো উড়াতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে। এদিক থেকে জাপানের ডিফেন্স ইকোনমিক জোন বাংলাদেশের সুরক্ষায় নতুন পতাকা ওড়াতে পারে।

এখন চীন ও নর্থ কোরিয়ার ঐক্যবদ্ধ যাত্রা ও তাদের আনবিক বোমা তৈরির কারণে জাপান কী করবে, তা আমেরিকাকে জিজ্ঞাসা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চায় তারা। জাপান বারবার আহ্বান জানাচ্ছে, আমেরিকাকে যেন তারা সেখানে কৌশলগত আনবিক অস্ত্র মোতায়েন করে। যাতে শত্রুরা তাদেরগুলো ব্যবহার করার আগে নিজেদেরটা ব্যবহার করতে পারে। জাপানের এক অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল সামাকাওয়া বলেন, আমেরিকা জাপানের জন্য অপরিহার্য।

জাপান ইতালি ও ব্রিটেনের সঙ্গে যৌথ ফাইটার প্লেন ডেভলপ করা ছাড়াও টোকিও-অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে অ্যাডভান্সড জাপানি মেড ফ্রিগেট বিক্রি করতে চেয়েছে। ইতিমধ্যে জাপান বাংলাদেশকেও ফ্রিগেট দিয়েছে। টোকিও গত মাসে ফিলিপাইনে ওয়ারশিপ ও সেনাবাহিনী পাঠিয়েছে যাতে তারা বহুজাতিক সামরিক মহড়ায় যোগ দিতে পারে। 

ওয়াশিংটন জাপানের সঙ্গে না থাকলে জাপানের ভিন্ন পথ ধরার অবস্থাও রয়েছে। জাপানে বেসামরিক পাওয়ার ইন্ডাস্ট্রি থেকে বহু টন প্লুটোনিয়াম জমা হয়ে রয়েছে। এ প্লুটোনিয়াম জাপান নিজস্ব আনবিক বোমা তৈরি করতে পারে। কিন্তু ১৯৪৫ সালের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে মার্কিন বোমার কারণে তারা এই পথে যেতে চায় না। কিন্তু ভবিষ্যতে তো একইভাবে না-ও চলতে পারে। 

জাপান তার নিরাপত্তার প্ল্যান ‘এ’তে রেখেছে আমেরিকার সঙ্গে যৌথ নিরাপত্তা। কিন্তু জাপানের প্ল্যান বিও রয়েছে যদি আমেরিকা এশিয়া থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে। তাহলো আনবিক বোমা উন্নয়ন। অকিনাওয়ায় ৫০ হাজার যুক্তরাষ্ট্রের ট্রুপ রয়েছে। জাপানের তৈরি টাইপ-১২ মিসাইল দেখতে আমেরিকার সমর নায়করা সেখানে সফর করেছে বারবার। এ মিসাইল ১০০ মাইল দূর পর্যন্ত অনায়াসে অতিক্রম করে শত্রু শিবিরে হামলা করতে পারে। জাপানের রয়েছে আমেরিকার মতো শক্তিধর মিসাইল।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গ : বাংলাদেশে জাপানের বিনিয়োগ রয়েছে বহুমাত্রিক। জাপানের বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। সাম্প্রতিককালে ঢাকার মেট্রোরেল, মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর ও কর্ণফুলী টানেল জাপানের পূর্ণ সহায়তায় নির্মিত। বাংলাদেশে জাপান এসব নির্মাণের পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জে বিশেষ ইকোনমিক জোন সৃষ্টি করেছে। এরপর রয়েছে গার্মেন্টসের ব্যাকআপ করার মতো ইন্ডাস্ট্রি।

জাপান তার এসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিজেরা সৃষ্টি করতে চায়। সেজন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি রয়েছে তাদের প্রস্তাব ডিফেন্স ইকোনমিক জোন।

শেয়ার করুন