আওয়ামী লীগের আমলে লোকজন ভোটদানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল
সাধারণ মানুষ কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেবেন- এমন আস্থা তাদের মধ্যে এখনও গড়ে ওঠেনি। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনে তাঁর দেয়া একটি ভোট কি সরকার গঠন করবে তা নিশ্চিত করবে- এটা সাধারণ মানুষ এখন আর মনে করেন না। বিগত ১৬ বছরে তিন, তিনবার জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের যে মডেলের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন শেখ হাসিনা সে থেকে মানুষ আস্থা ফেরাতে পারছে না ভোটে। প্রশাসন ব্যবহার করে দলীয় ক্যাডার দিয়ে একক ও দলীয় প্রভাব নিয়ে তাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজ্যের অবিশ্বাস, হতাশা, শঙ্কা এখনও বিরাজ করছে। তারা বিশ্বাসই করতে পারেননা, একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, এমনকি তার ভোটটা দিনের কোনো একটা সময় ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নির্বিঘ্নে দিয়ে আসতে পারবেন। সেখানে কেউ বাঁধা দেবে না। কেউ বলে দেবে না, ভোট যদি অমুক মার্কায় না দেন তাহলে বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হবে, রাস্তায় হাট বাজারে অপমানিত করা হবে, মামলা দেয়া হবে, মাইর দেয়া হবে এমন কিছু।
সাধারণ মানুষের মধ্যে ভোটদানের যে একটা আত্মবিশ্বাস যুগ যুগ ধরে চলে আসছিল অন্তত ওয়ান ইলেভেনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। সে বিশ্বাসে কুঠারাঘাত করে গেছেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। দিনের ভোট রাতে, ভোট ছাড়াই প্রার্থী অভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরকার গঠন করার যে দেড় শতাধিক আসনের প্রয়োজন সেটা প্রশাসন দিয়ে নিশ্চিত করে ফেলা, বা ডামি ভোটের মাধ্যমে। মানুষ এখন বলছেন, ‘বাপু আমাদের ভোটের আর প্রয়োজন হয় না।’ মানুষের মধ্যে এ আস্থা কিভাবে ফেরানো সম্ভব, এ চ্যালেঞ্জ এখন রাজনীতিবিদদের, এ চ্যালেঞ্জ এখন অন্তর্বর্তী সরকারের। কিন্তু কিভাবে? রাজনৈতিক ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি বহু আগ থেকেই। আওয়ামী লীগকে তাড়াতে একতাবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করা দল এখন বহু মতে বিভক্ত। মানুষ এখন এটাতেও দারুণভাবে দ্বিধাগ্রস্ত!
জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ একেবারে ঘোষণা না হলেও আগামী ফেব্রুয়ারিতে যে বহুল প্রত্যাশিত জাতীয় নির্বাচনটা হতে যাচ্ছে তা এখন অনেকটাই নিশ্চিত। যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন গত ৫ আগস্ট (মঙ্গলবার)। ৬ আগস্ট এ সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় নির্বাচন কমিশনকে চিঠিও দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে, সেপ্টেম্বরের মধ্যেই তারা নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ করে ফেলবে। নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মোহাম্মদ সানাউল্লাহ বলেন, আগামী ডিসেম্বরে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। ৭ আগস্ট তিনি জানান, সেপ্টেম্বর মাস থেকে প্রবাসীদের ভোটার এডুকেশনের কাজ করা হবে। রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ-বিধিমালা ইতিমধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে।
এদিকে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন গত ৯ আগস্ট শনিবার রংপুরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক শেষে বলেছেন, আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সিইসি আরও বলেন, নির্বাচনী ব্যবস্থায় জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপন এখন বড় চ্যালেঞ্জ। মানুষ এই ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়েছে। তাদের আবার ভোটকেন্দ্রে ফিরিয়ে আনা বড় কাজ হবে। এছাড়া, অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, নির্বাচনের জন্য যত টাকা লাগবে, তা দেয়া হবে। এনিয়ে কোনো সমস্যা নেই। চলতি অর্থবছরের বাজেটে নির্বাচন কমিশনের জন্য ২ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। নির্বাচন অয়োজনে সরকারের ঘোষণা ও গৃহীত পদক্ষেপে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল একে স্বাগত আনালেও কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচন আয়োজনে নানান শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন। নতুন নতুন ওই সব শর্তাদি সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্বিধা বিভক্তি। এদের কেউ কেউ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করছেন। কেউ বলার চেষ্টা করছেন সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন না হলে গ্রহণযোগ্য হবে না। যার অর্থ আওয়ামী লীগকেও নির্বাচনে সুযোগ দান। এয়োদশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেবে কি না, বা দলটিকে নির্বাচন করতে দেয়া হবে কিনা এ ব্যাপারে কোনো আলোচনা নেই। তবে এ নিয়ে পক্ষ বিপক্ষে কথা রয়েছে। কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগের সবাই তো আর খারাপ না, কিছু ভাল রয়েছেন, তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেয়া উচিৎ। সেটা হলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে উৎরে যাবে। নতুবা যতই সুন্দর নির্বাচন হোক না কেন দিন শেষে এ নির্বাচনে দেশের একটা বড় রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করতে দেয়া হয়নি এ প্রশ্নটা আসবে। ফলে এ বিষয় নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্ব বিরাজমান। বিশেষ করে সোহেল তাজ ও তার বড় বোন শারমিন আহমদ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষতের পর আওয়ামী পুর্নবাসন ও সেটা এ দুইয়ের হাত ধরে হচ্ছে কিনা তা নিয়ে কথা উঠেছে। যদিও আওয়ামী লীগের বড় একটা অংশ শেখ হাসিনার বাইরে সোহেল তাজ বা অন্য কেউ পুর্নবাসন কার্যক্রম করুক এটা পছন্দ করছে না।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণার পর বিএনপি নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো শর্ত আরোপ না করলেও অন্য তিনটি দল কতিপয় শর্ত উল্লেখ করেছে। তার মধ্যে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন বাংলাদেশের আমীরের কথায় নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে তাদের সংশয়ের কথাও প্রকাশ পেয়েছে। আর এনসিপি আগেই নিরপেক্ষতার অভিযোগ তুলে নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ দাবি করেছে।
অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। তাহলে নির্বাচনের আগে ৩ মাসের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে কি না- এমন প্রশ্নও করছেন কেউ কেউ। আর আওয়ামী লীগের কার্যক্রম যেহেতু নিষিদ্ধ, নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে সংশয় আছে। এ ছাড়াও আরও যেসব প্রশ্ন এখন এক এক করে সামনে আসছে, তা হলো-মৌলিক সংস্কার, বিচার, জুলাই সনদ, নির্বাচন পদ্ধতি, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, আইনশৃঙ্খলা, নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার, না কি অন্তর্বর্তী সরকার। তবে এর বাইরে বড় একটা চাপ রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপর। সেটা হলো- নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেয়ার একটি চাপ আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে আসবে। অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। এবং সেটা তাদের নেতাদের সকল অপরাধমূলক কর্মকান্ডের বিচারাদি সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত। এর ফলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ এতেই সীমিত হয়ে গেছে। তবে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল যেমন জামায়াত ও এনসিপি বা আরও কোনো দল মিলে নির্বাচন বর্জন করলে সেটা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের জন্য। যদিও রাজনৈতিক দলগুলো বারবার স্বরণ করছে যে এমন কিছু করা যাবে না যাতে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটতে পারে। বা আওয়ামী লীগ আবারও ফিরে আসার সুযোগ তৈরি করতে পারে। যদিও আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করার মত বর্হিবিশ্বের বড় কোনো চাপ আসবে বলে মনে হয় না।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্প্রতি বলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার করেই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলোর একমত হতে হবে। নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার লাগবে। আইনের সংস্কার লাগবে। তবে সবই সম্ভব। কোনো আশঙ্কা দেখছি না। তিনি আরও বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে সরকারের আন্তরিকতায় কোনো অভাব দেখছি না। তবে নির্বাচন কমিশনকে তার কাজের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে হবে। আর সেসব সংস্কার প্রয়োজন, তাতে রাজনৈতিক দলগুলোকে একমত হতে হবে। সেটা হলে কোনো সমস্যা দেখছি না।
তবে মূল চ্যালেঞ্জ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা। মানুষকে ভোট দিতে কেন্দ্রে যেতে উদ্ভুদ্ধকরণ, ব্যাপক প্রচারণা ও আইনশৃংখলাবাহিনীর উপর আস্থা ফেরানো। এসব চ্যালেঞ্জে এগিয়ে গেলে কার্যকরিভাবেই নির্বাচনমুখী হবে মানুষ। নতুবা সবার মাঝেই ‘কী হয়’ ‘আচ্ছা দেখি’ ‘আমার ভোটের আবার কী দরকার’ ভোটারদের এমন সব অভিমানী কথা উৎসবমুখর ভোটের পরিবেশ ও ভোটের গ্রহণযোগ্যতা মলিন হয়ে যেতে পারে বৈকি!