০২ মে ২০১২, বৃহস্পতিবার, ৬:১১:০৭ অপরাহ্ন


হাসিনার ভারত সফরে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বোঝাপড়া হবে
প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ভারত সফর কতটা গুরুত্বপূর্ণ
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩১-০৮-২০২২
প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ভারত সফর কতটা গুরুত্বপূর্ণ শেখ হাসিনা


রাজনৈতিক মহলে চলছে নানা বিশ্লেষণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের গুরুত্ব নিয়েই ওই আলোচনা-বিশ্লেষণ। মূলত দু’দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক মানেই এ নিয়ে থাকে ব্যাপক আলোচনা। এবারো তার ব্যতিক্রম নয়। বরং খানিকটা বেশি। কী পাবে বাংলাদেশ? কী পেতে পারে এ হিসেব মেলানোর নিরীক্ষণ চলছে। আগামী ৫ অক্টোবর যাচ্ছেন তিনি রাষ্ট্রীয় ওই সফরে দিল্লিতে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে শেখ হাসিনার এ সফর। বলা হচ্ছে ২০২৩ সনের শেষে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের আগে এটাই বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর শেষ সফর। ফলে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে কি নিয়ে আসবেন বা কী চুক্তি করবেন সেটা নিয়ে চলছে আলোচনা।

২০১৮ সনের ৩০ জুন ভারত সফর থেকে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের (ভারতের আনন্দবাজারের লেখা যে- ‘বাংলাদেশ এখন প্রতিদান চায়’) জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোন পত্রিকা এসব নিউজ করেছে তা আমি জানি না। আমি কারো কাছে কোনো প্রতিদান চাই না। আমার নেয়ার অভ্যাস কম, দেয়ার অভ্যাস বেশি আর আমরা ভারতকে যা দিয়েছি তা ভারত সারাজীবন মনে রাখবে।’ 

মূলত ওই সফরের দীর্ঘদিন পর শেখ হাসিনার এ সফরটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। যদিও সে সফর এবং বর্তমান সফরের প্রেক্ষাপটে অনেক পার্থক্য রয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারতে এ সফরের খানিকটা আগে স্বপ্রণোদিত হয়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র বাংলাদেশ সফর করে যাওয়াটা অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন। বিষেশ করে তাইওয়ানে যে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা চলছিল চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তেমন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে চায়না পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকায় দুদিন অতিবাহিত করে বেশ কয়েকটি বৈঠকের বিস্তারিত জানা না গেলেও তার একটা প্রভাব বাংলাদেশের ওপর বিস্তার করবে। 

কেননা এ মুহূর্তে চীন বাংলাদেশের বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টের উন্নয়নের পার্টনার। এছাড়াও ঢাকার সঙ্গে বেইজিংয়ের যোগাযোগে আচমকা তৎপরতা বেড়ে যাওয়া তথা বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার ডেটলাইনে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে এখনো হচ্ছে। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে যখন শীতল ভাব রয়েছে বিশেষ করে উপমহাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অত্র অঞ্চলের নিরাপত্তার স্বার্থে যে কোয়াড (ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) সমন্বয়ে গড়া জোট যা মূলত চীনের উত্থান ঠেকানোর জন্যই। ফলে এখানে নতুন কোনো বার্তা রয়েছে কিনা চীনে সেটা স্পষ্ট নয়। তবে এটা ঠিক, এ সফরে ভারতের সঙ্গে বেশ কিছু বিষয়ে নিষ্পত্তির প্রত্যাশা রয়েছে। এ ছাড়াও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বোঝাপড়া, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতি, যুদ্ধ-সংঘাতের কারণে জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের সরবরাহে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট এবং বাংলাদেশ ও ভারতে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সফরটির গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচ্য হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টিকে থাকা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের যে বক্তব্য সেটাতে এ সফরে বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকা ও রাজনীতির হিসাব-নিকাশের মধ্যে বাংলাদেশে সরকার প্রতিষ্ঠায় ভারতের স্পষ্ট প্রাধান্য হওয়ার বিষয়টা ফুটে উঠেছে। 

গত ১৮ আগস্ট চট্টগ্রামে সন্ধ্যায় জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা আমাদের আদর্শ। তাকে টিকিয়ে রাখতে পারলে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে যাবে এবং সত্যিকারের সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক একটা দেশ হবে। শেখ হাসিনার সরকার টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারতবর্ষের সরকারকে সেটা করতে অনুরোধ করেছি।’

নগরের জেএম সেন হলে জন্মাষ্টমী উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত সফরের প্রসঙ্গ টেনে বক্তব্য দেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমি বলেছি, আমার দেশে কিছু দুষ্ট লোক আছে, কিছু উগ্রবাদী আছে। আমাদের দেশ সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন না। আপনার দেশেও যেমন দুষ্ট লোক আছে, আমাদের দেশেও আছে।’

কিছুদিন আগে তাদের (ভারতের) দেশেও এক ভদ্রমহিলা (নুপুর শর্মা) কিছু কথা বলেছিলেন উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা সরকারের পক্ষ থেকে একটি কথাও বলিনি। বিভিন্ন দেশ কথা বলেছে, আমরা বলিনি। এই ধরনের প্রোটেকশন আমরা আপনাদের দিয়ে যাচ্ছি। সেটা আপনাদের মঙ্গলের জন্য, আমাদের মঙ্গলের জন্য। আমরা যদি একটু বলি, তখন উগ্রবাদীরা আরো সোচ্চার হয়ে আরো বেশি বেশি কথা বলবে। তাতে ক্ষতিটা হবে কী? আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন হবে। স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হবে।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ সময় আরো বলেন, ‘ভারতকে বলেছি, আমরা উসকানিমূলক কর্মকা- কখনো প্রশ্রয় দেবো না। এটা যদি আমরা করতে পারি, ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়ের মঙ্গল। শেখ হাসিনা আছেন বলে ভারতেরও যথেষ্ট মঙ্গল হচ্ছে। 

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের কড়া সমালোচনা হয় বাংলাদেশে। আওয়ামী লীগ সরকার প্রচ- রকম বিব্রতবোধ করে। আওয়ামী লীগের তরফ থেকেও এর কড়া সমালোচনা। যদিও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই বক্তব্য তিনি দায়িত্ব নিয়েই বলেছেন সেটা পরের দিন সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেন। আবার আরো একদিন পর অস্বীকার করে বলেন, তিনি ঠিক ওভাবে কথাগুলো বলেননি। 

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই বক্তব্য দেয়ার একদিন পর ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী এক অনুষ্ঠানে বলেন, ভারত সবসময় বাংলাদেশের পাশে ছিল, আছে এবং থাকবে। ফলে প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগে এ দুটি বক্তব্যও ব্যাপক আলোচিত হয় কূটনৈতিক অঙ্গনে। তবে  সরলমনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে খোদ ভারত প্রশাসনও বিব্রত হওয়ার কথা। কারণ অনেক কিছুই থাকে যেগুলো অদৃশ্য। গোপন। সেগুলো সম্মুখে কেউ আনে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর বাংলাদেশের ২০১৪ ও ২০১৮ সনের জাতীয় নির্বাচনে ভারতের কোনো প্রভাব ছিল কি-না এটা নিয়েও আলোচনা হয়। 

এদিকে যেহেতু প্রায় ৩ বছর পর পূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেহেতু ভারতে যাচ্ছেন। এ সফরে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দুই বন্ধু রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যকার মুখোমুখি বৈঠক হবে এমন শিডিউল রয়েছে। সেখানে নিশ্চিতভাবে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে কথা হবে। বিশেষ করে রাজনৈতিক সম্পর্কের বিশেষ করে কথিত বাংলাদেশের চীনের দিকে একটু বেশি ঝুঁকে যাওয়া প্রসঙ্গ ‘ভুল বোঝাবুঝি’ নিরসনের চেষ্টা হবে। অর্থনৈতিক এবং সামরিক খাতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয়টিও গুরুত্ব পেতে পারে। তবে দু’দেশে কী কী ইস্যুতে কথা হবে এসব ব্যাপারে কেউ মুখ খুলছে না। আসলে একটি সফরের নানাদিক থাকে। সেগুলো প্রকাশ্যে আসেও না। কারণ দুই বন্ধুপ্রতিমের অভ্যন্তরীণ এমন কিছু থাকে, যা প্রকাশ্যে এলে সেটা অন্য দেশের চক্ষুশূলের কারণও হয়ে যেতে পারে। তবে বড় আশা বাংলাদেশ ও ভারত তিস্তা চুক্তি। যদিও সেটা এবারো না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবু প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরেও বহুল প্রতীক্ষিত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সইয়ে বরাবরের মতো তাগিদ দিবেন। 

ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফর ঘীরে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের প্রস্তুতির মুহূর্তে বাংলাদেশে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র স্বপ্রণোদিত সফর, ঢাকার সঙ্গে বেইজিংয়ের যোগাযোগে আচমকা তৎপরতা বেড়ে যাওয়া তথা বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি নিয়ে দিল্লির ডেটলাইনে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। 

দায়িত্বশীল সূত্রের বরাতে ভারতীয় মিডিয়া ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস অনলাইন জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৩টি বিষয় বোঝাপড়া হবে। দু’দেশের মধ্যকার প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদারে আনুষ্ঠানিক চুক্তি সইয়ের ইঙ্গিত দিয়েছে তারা। বলা হয়েছে, ওই চুক্তির খসড়া ইতিমধ্যে প্রস্তুত এবং বিনিময় হয়েছে। সরকারপ্রধানের আসন্ন সফরে বঙ্গোপসাগরের সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি যৌথ উৎপাদনের বিষয়টি পাকাপোক্ত করবে ঢাকা ও নয়াদিল্লি। ওই রিপোর্টে এটাও বলা হয়, বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বাড়ার প্রেক্ষাপটে নয়াদিল্লি ঢাকার সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সুদৃঢ় করার আলোচনায় জোর দিয়েছে। 

শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা, তৃণমূল কংগ্রেসনেত্রী মমতা ব্যানার্জি দিল্লিতে তার সঙ্গে দেখা করবেন কিনা তা নিয়েও এই মুহূর্তে জল্পনা তুঙ্গে। শেখ হাসিনা নিজে যে চাইছেন দিল্লিতে তার সঙ্গে মমতা ব্যানার্জির দেখা হোক, তা অবশ্য পরিষ্কার। গত মাসেই তিনি সরাসরি মমতা ব্যানার্জিকে চিঠি লিখে অনুরোধ জানিয়েছেন, আমি দিল্লিতে আসছি, আপনিও সেখানে আসুন। এই প্রস্তাবে প্রচ্ছন্ন সায় ছিল দিল্লিরও। মমতাও সাক্ষাতের বিষয়টা অনেকটাই নিশ্চিত করেছেন। 

সব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফর সফল করতে দু’দেশের শীর্ষ পর্যায়ের প্রস্তুতি চলছে। সফরে সব প্রোগ্রামাদি যাতে সঠিক ও সুন্দর হয় এ জন্য দু’দেশের সংশ্লিষ্টরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। 

শেয়ার করুন