০৪ মে ২০১২, শনিবার, ০৬:৪৫:১৭ অপরাহ্ন


বিরোধী দলের একদফা ও কূটনৈতিক দৌড়-ঝাঁপে উত্তপ্ত বাংলাদেশ
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-০৭-২০২৩
বিরোধী দলের একদফা ও কূটনৈতিক দৌড়-ঝাঁপে উত্তপ্ত বাংলাদেশ ঢাকায় পৌঁছেছেন উজরা জেয়া ও ডোনাল্ড লু, স্বাগত জানাচ্ছেন মাসুদ বিন মোমেন


ফুঁসে উঠেছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। সরকার পতনের পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে সমান কাতারে রেখে একেই একদফা আন্দোলন কর্মসূচি নাম দিয়ে শুধুমাত্র একটি ঘোষণার দিনকে কেন্দ্র করে এমন উত্তপ্ত অবস্থা। এর পাশাপাশি উপস্থিত হয়েছে দেশের মাটিতে একঝাঁক কূটনীতিকের আগমন। এটা যেনো উতপ্ত পরিস্থিতিতে আরো ঘি ঢেলে দিয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আর বিএনপিকে মুখোমুখি অবস্থানে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। 

ঢাকায় এক ঝাঁক কূটনীতিকের পদচারণা

যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া  গত ১১ জুলাই মঙ্গলবার উজরা ও তাঁর সঙ্গে আসা প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বাংলাদেশ সফর শুরু করেছেন। তার আগে অবশ্য তিনি ভারতের নাগরিক সমাজের বিভিন্ন প্রতিনিধি ও সংগঠনের সঙ্গে তাঁদের আলোচনা করেন। উজরা জেয়ার সঙ্গে ভারতে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এবং ইউএসএআইডির উপসহকারী প্রশাসক অঞ্জলি কৌর। তাঁরা ইতোমধ্যে ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেট্টির সঙ্গে বৈঠক করেন।

তা ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডাইভারসিটি, ইক্ইুটি, ইনক্লুশন অ্যান্ড অ্যাকসেসিবিলিটি কাউন্সিল’ (ডিইআইএ) এর সদস্যদের সঙ্গে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলেছে, উজরা জেয়া আগামী ১৩ জুলাই বৃহস্পতিবার সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, শ্রম অধিকার, মানবাধিকার, মানব পাচার ও রোহিঙ্গা সংকট, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষার বিষয়ে আলোচনা করবেন। সফরের দ্বিতীয় দিনে ১২ জুলাই বুধবার তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির পরিদর্শনে যাবেন। 

বাংলাদেশে ৪ দিনের সফরের উজরা জেয়ার সফরসঙ্গীদের মধ্যে রয়েছেন মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। অন্যদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি কেমন তা জানতে চেয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল ঢাকায়। তারা এসেই নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ভোট আয়োজনে সক্ষম কিনা সেটাও জানতে চেয়েছে। ১১ জুলাই মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানো এবং নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চায় প্রতিনিধি দলটি। এদিকে জানা গেছে ইইউ প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের একটি টেকনিক্যাল টিম ১৮-১৯ জুলাই ইসির সঙ্গে পরবর্তী বৈঠক করবে। ইসি ভবনে ওই বৈঠকে নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম সচিব (আইন) এবং যুগ্ম সচিব (নির্বাচন ব্যবস্থাপনা ১ ও ২) এই তিনজন অংশ নেবেন। 

কি করবে বিএনপিসহ সমমনারা

সরকারের ওপর যখন এমন চাপ তখন সেই মাসেই সরকার পতনের এক দফা’র আন্দোলন কর্মসূচির ঘোষণার দিনক্ষণ দেয়া হয়েছে ১২ জুলাই বুধবার। আলাদা আলাদা সভা-সমাবেশ করে সরকার পদত্যাগের এক দফা’র যৌথ ঘোষণা দেবে বিএনপিসহ সমমনা বিরোধী জোটগুলো। এজন্য দলটি দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশের ডাক দিয়েছে সমমনাদের প্রধান শরিক বিএনপি। ১২ দলীয় জোটে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট বিজয়নগর পানি ট্যাংকের কাছে, এলডিপি তেজগাঁওয়ে এফডিসির কাছে দলের কার্যালয়ের সামনে, গণফোরাম-পিপলস পার্টি মতিঝিলে ইডেন গার্ডেনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে, লেবার পার্টি নয়া পল্টনে মসজিদ গলিতে দলের কার্যালয়ের যুগপত ঘোষণার কথা জানাবে। গণঅধিকার পরিষদ (রেজা কিবরিয়া) জাতীয় প্রেস ক্লাবে এবং গণঅধিকার পরিষদ (নূরুল হক নূর), গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, সমমনা গণতান্ত্রিক পেশাজীবী জোট জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এবং সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ জাতীয় প্রেসক্লাবে বিকাল তিনটায় দেবে। 

এদিকে বহুদিন পরে বিএনপি নেতাকমর্রিা মাইক বাজিয়েও সমাবেশের আয়োজনকে জানান দিচ্ছে। বিএনপি জানে পুরো জুলাই বাংলাদেশে কূটনৈতিক পাড়া থাকবে গরম। আর তাই এই মাস জুড়ে বিএনপির বিভিন্ন ধরনের কর্মকান্ড। কর্মসূচির বড়ো অংশ থাকবে রাজধানী কেন্দ্রীক। ঢাকায় নেয়া হবে পদযাত্রা, মানববন্ধন, অবস্থান কর্মসূচি। আর ঢাকার বাইরে তৃণমূলে থাকবে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি। আর এসব কর্মসূচি পালন হবে যুগপৎভাবে। এদিকে মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান এই সমাবেশ সর্ম্পকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলেছেন, আমাদের এই সমাবেশ হবে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। এজন্য আমরা সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছি। আমরা আশা করছি, ইনশাল্লাহ এই সমাবেশ জনসমুদ্রে রূপ নেবে।

ঢাকার জনগণ রাজপথে তাদের দাবি নিয়ে আসবে এবং এই সমাবেশে থেকে যে কর্মসূচি ঘোষণা হবে তা বাস্তবায়ন হলে জনগণ তার ভোটাধিকার ফিরে পাবে এবং জনগণের একটি সরকার প্রতিষ্ঠা হবে বলে আমরা মনে করি। তিনি গণমাধ্যমে বলেছেন, এই সমাবেশ যাতে শান্তি পূর্ণভাবে হয় সেজন্য আমরা অনেকগুলো স্বেচ্ছাসেবক টিম গঠন করেছি। ঢাকা মেট্রোপলিট পুলিশের কাছে আমরা সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দিয়েছি। এদিকে এমন কর্মসূচির দিনে বিএনপি পরবর্তীতে কি করবে তার একটা ধারণাও দেয়া হবে সমাবেশ থেকে। ঢাকাজুড়ে মানববন্ধনের পর পর্যায়ক্রমে পদযাত্রা, অবস্থান ধর্মঘট, সমাবেশের মতো কর্মসূচি ঘুরেফিরে আসতে পারে। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে আসবে ঘেরাওয়ের কর্মসূচি। এতদিন ধরে ঢাকার বাইরে কর্মসূচি হলেও একদফা আন্দোলনের মূল কেন্দ্রবিন্দু হবে রাজধানী ঢাকা। সব কর্মসূচি পালন হবে যুগপৎভাবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এটির বিশেষ কোনো তাৎপর্য না থাকলেও দেশে একঝাঁক কূটনৈতিকের পদচারণায় পরিস্থিতি সুযোগ নিচ্ছে বিএনপি। চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণার ওই সমাবেশে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি ও জনসমর্থন দেখাতে চায় বিএনপি। 

আওয়ামী লীগ কি করবে?

একদফা আন্দোলন কর্মসূচি নাম দিয়ে শুধু মাত্র একটি ঘোষণার দিনটিকে মোকাবেলা করতে ক্ষমতাসীন ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে সমাবেশের ডাক দিয়েছে। সেখানে এক লাখ নেতাকর্মী ও সমর্থক জড়ো করার টার্গেট নেয়া হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। তাদের আশাবাদ ছড়িয়ে দেওয়া হবে নবাবপুর, ঠাটারীবাজার, হাইকোর্ট, পল্টন, বিজয়নগর ও দৈনিক বাংলার মোড় পর্যন্ত। এসব এলাকায় টানানো হবে মাইক। আওয়ামী লীগের সব সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা যোগ দেবে এ সমাবেশে। 

এতে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এসমাবেশ নিয়ে গণমাধ্যমে বলা হয়েছে আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছি। এক লাখ নেতাকর্মী ও সমর্থক জড়ো করার টার্গেট রয়েছে। আওয়ামী লীগের সব সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের মহানগর নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাদের অনুরোধ করা হয়েছে এই সমাবেশ সফল করার জন্য। তারা নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে শান্তি সমাবেশে যোগ দেবেন। আমরা ১০ জুলাই সোমবার সকালে দক্ষিণের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। বলা হচ্ছে ১২ জুলাই বুধবারের শান্তি সমাবেশে ব্যাপক লোক সমাগমের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। গত ১১ জুলাই মঙ্গলবারে উত্তরের বর্ধিত সভায় মহানগরীর নেতাদের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়। তবে একর্মসূচির শুধু মূল উদ্দেশ্য বিএনপি’কে উদ্দেশ্য করে না বলেই জানা গেছে। এটি করা হচ্ছে সফরত কূটনৈতিক ব্যক্তিবর্গসহ সংশ্লিস্ট দেশসমূহকে যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মাঠে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও আছে। এবং ব্যাপক জনসমর্থন নিয়েই সরকার ক্ষমতায়। 

কি হতে পারে ও শেষ কথা

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, পুরো জুলাই মাস জুড়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন অবস্থা বিরাজ করবে। তবে ১২ জুলাই বুধবারে দু-পক্ষ বলা চলে রাজধানী জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করবে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন বুধবারে বিএনপি কোনোভাবেই প্রতিহিংসামুলক আান্দোলনে দিকে যেতে চাইবে না। তেমনটি করলে বিএনপি’র সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে। রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের পুরো অহিংস ইমেজ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। 

তারপরেও কেউ কেউ মনে করে বিএনপি তাদের বুধবারের কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বড়ো ধরনের উস্তানির মুখে পড়তে পারে। কিন্তু তারা সে ফাঁদে পা না দেয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একজন নেতা বলেছেন বিএনপি বাড়াবাড়ি করলে তার কঠিন জবাব দেয়া হবে। কারো কারো মতে, তারপরে উত্তপ্ত অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে দেশের পুরো রাজনৈতিক পরিস্থিতিও অন্যদিকে টার্ণ নিয়ে নিতে পারে বলেই অনেকের আশঙ্কা। আর এজন্য সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে অনেকেই বলছেন জুলাইতে রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘটে যেতেও পারে আকস্মিক কোনো নাটকীয় ঘটনা।

শেয়ার করুন