২৯ মার্চ ২০১২, শুক্রবার, ০৬:১৫:৫৫ পূর্বাহ্ন


কথার কথকতা
মাইন উদ্দিন আহমেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৪-০৯-২০২২
কথার কথকতা


বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা যেখানেই যায় সাথে নাকি নিয়ে যায় আন্তরিকতা। কারণ এই মানুষগুলো এমন এক ভূখ-ের অধিবাসী যেখানে কোনো বাড়িতে পথচারী, মুসাফির পানি খেতে চাইলে কেউ শুধুই পানি দিতো না, সাথে কোনো না কোনো একটা খাবার সংযোজন করে দিতো। খুব গরিব পরিবার হলে অন্তত এক বাটি মুড়ি হলেও দিতো পানির সাথে। জ্বি হ্যাঁ, এই চিত্রটি হচ্ছে যখন আমরা স্কুলে পড়তাম তখনকার। এরপর বাংলার ইতিহাসে কতো কি যে ঘটতে থাকলো। অনেক উলট-পালট হয়ে গেলো। তখন মুসাফিররা চলার পথে রাত হয়ে গেলে মসজিদে আশ্রয় নিতো। কারণ ওটা আল্লাহর ঘর। আর বর্তমান চিত্র হলো, আল্লাহর ঘর হিসেবে ঘোষণা করার জন্য কোনো মসজিদ পাওয়া যাবে কিনা তাও সন্দেহ আছে। এখন মসজিদ হয়ে গেছে প্রভাবের, কমিটির, ব্যক্তির, নেতার বা স্বঘোষিত কামেল মানুষের। আমার প্রিয় বাংলার মানুষদের প্রশংসা করতে চেয়ে বেশিদূর এগোতে পারলাম না। তারপরও বলতে হবে, বিদেশের মাটিতে  একজন বাঙালি আরেকজন বাঙালির দেখা পেলে মনে হয় প্রাণশক্তি বেড়ে যায়। স্বদেশি মানুষ, একই ভাষার মানুষ, আন্তরিকতা উপহার দেয়ার মতো লোক খুঁজে ফেরে সবাই। অচেনা মানুষ সামনে পড়লে এবং দেশি মনে হলে ভূমিকা ছাড়াই প্রশ্ন ছুড়ে দেয়- ‘বাংলাদেশ?’ উত্তরে হ্যাঁ, শব্দটি শোনার সাথে সাথে মুখে হাসি ফুটে ওঠে, বিদেশ হয়ে ওঠে আপন। এই স্তরে বাংলাদেশের মানুষটি বিদেশের মাটিতে মনে মনে একজন বাঙালি বাড়িওয়ালা খোঁজে, একটা বাংলাদেশির মালিকানাধীন গ্রোসারি শপের সন্ধান করে, একটা বাঙালি চা দোকান খোঁজে, একজন বাংলা বলেন এমন ডাক্তারের কাছে যেতে চান। তবে আপনারা শুনলে হতাশ হবেন যে, সেই পরিস্থিতি পাল্টে যাচ্ছে, বরং বলা যায় পাল্টে গেছে। অনেক কিছুর পর এখন স্বদেশি ও স্বভাষী মানুষের মোহ ভঙ্গ হয়েছে। কারণ আমরা আমাদেরকে আন্তরিকতাম-িত করে ধরে রাখতে পারছি না।

আমাদের এক পরিচিত মানুষ এ বিষয়ে আমাকে তার তিক্ত অভিজ্ঞতা ওনার নিজের মতো করে বর্ণনা করে এ বিষয়ের ওপর লিখতে বললেন। আমি বলেছি লিখবো, কিন্তু এসব বিষয় ভদ্রলোকের উপলব্ধির মতো করে লেখা খুব কঠিন তা আমি জানি। তারপরও কথা যখন দিয়েছি চেষ্টা করে দেখি।

ভদ্রলোক অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, সব তো আর একবারে লেখা যাবে না, একটু একটু করে লিখতে চেষ্টা করবো। শুরুতে ওনার ডাক্তার সম্পর্কিত অভিজ্ঞতার কথা লিখবার চেষ্টা করি।

আমেরিকার নিউইয়র্ক স্টেটে আসার পর ওনাকে ওনার এক আত্মীয়া একটা ইন্স্যুরেন্সের একজন বাঙালি কর্মকর্তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং ওনার মাধ্যমে একজন বাঙালি ডাক্তারকে প্রাইমারি ডক্টর হিসেবে গ্রহণ করলেন। ডাক্তার সাহেবও বাংলাভাষী এবং তাতে তিনি খুশি। যখন দেখলেন ডাক্তার সাহেবের অফিসে প্রায় সবাই ওনার আত্মীয়ার পরিচিত, তখন তিনি আরো বেশি করে খুশি হলেন। চলছিলো ভালোই, তবে মাঝেমাঝে ডাক্তার সাহেবের অফিসের লোকজনের ওনাকে চিনতে না পারার ভান করাটা ভদ্রলোকের কাছে স্বাভাবিক মনে হয়নি। তারপরও এভাবে চলেছিলো প্রায় চার বছর।

কিছুদিন আগে এই ভদ্রলোক অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ডাক্তার সাহেবের পরামর্শে রক্ত পরীক্ষা করা হলো, দেখা গেলো ওনার রক্তে সোডিয়ামের পরিমাণ খুব কম। ডাক্তার সাহেব ওনাকে সাতদিনের ওষুধ দিলেন। এই ওষুধ খাওয়া শেষ হলে আবার রক্ত পরীক্ষা করতে বলা হলো। তিনি দেখবেন, সোডিয়াম কমতির সমস্যাটি আছে, না কি সমাধান হয়ে গেছে। তাই করা হলো। এর মধ্যে ডাক্তার সাহবের এক সহযোগী মহিলা ডাক্তার এই রোগীকে একটা ভিজিটিং কার্ড দিলেন যাতে একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বিস্তারিত ঠিকানা দেয়া আছে। ও হ্যাঁ, নিউইয়র্কে এই কার্ডকে ভিজিটিং কার্ড বলে না, বলে বিজনেস কার্ড। যাই হোক, কার্ডটা দিয়ে মহিলা ডাক্তারটি আদেশের সুরে বললেন, স্যার এই ইন্স্যুরেন্সের বোর্ড মেম্বার হয়েছেন, আপনি আগের ইন্স্যুরেন্স বাদ দিয়ে এই কোম্পানিতে আসুন, না হয় স্যার আপনাকে দেখবেন না। রোগী ভদ্রলোক মনে মনে ভাবলেন, কি বলে, ইন্স্যুরেন্স বদল করে ফেলতে বললেই কি করা যায়? ওসবের জটিল প্রক্রিয়া আছে। আর এটা তো কোনো সততাপূর্ণ আদেশ নয়! কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না তিনি।

কয়েকদিন পর রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট এসেছে এ খবর জানিয়ে ভদ্রলোককে ডাক্তারের চেম্বারে যেতে বলা হলো। ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়ার পর ফ্রন্ট ডেস্কের সহকারী মহিলা জানতে চাইলেন, ইন্স্যুরেন্স পরিবর্তন করা হয়েছে কিনা। তিনি উত্তর দিলেন, জ্বি না। সাথে সাথে প্রশ্ন করলেন, তাহলে কি ডাক্তার সাহেব আমাকে আর দেখবেন না?  উত্তর এলো, আজ দেখবেন, পরে আর দেখবেন না। ভদ্রলোকের বিস্মিত হবার ডিগ্রি অনেক উচ্চ হয়ে গেলো। তিনি তিরস্কারের ভঙ্গিতে বললেন- আহারে, তাহলে আমাদের কি হবে? রাস্তায় রাস্তায় কি ঘুরে বেড়াতে হবে? ডাক্তার সাহেবের উচিত অনুচিতের তোয়াক্কা না করা সহকারী হঠাৎ চোখ মুখ লাল করে ঘোষণা দিলেন, আপনাকে আজো দেখবে না, চলে যান। এতোক্ষণে এই বয়স্ক রোগী এদের অবস্থা সম্পর্কে পুরো পরিষ্কার হয়ে গেলেন। একটা রোগীর শারীরিক জটিলতার পুনঃপরীক্ষার এই স্তরে এদের এ রকম অচেনা মানুষের মতো আচরণে এই স্তরে তিনি আর অবাক হলেন না। এদের মানবসেবার স্তর বুঝে ফেলার পর তিনি বাসায় ফিরে গেলেন।

পরে একদিন ওনার এক আত্মীয় রোগীর সাথে ওই ডাক্তার সাহেবের চেম্বারে গেলে ফ্রন্ট ডেস্কের ওই আপার চোখে তিনি বিস্ময় বিচ্ছুরিত হতে দেখলেন। নীরবে তিনি যেন বলছিলেন, এই লোক এখানে কি করে! তবে এই রোগীর জন্য আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো পরবর্তী পর্যায়ে।

তিনি তাঁর ওই আত্মীয়ার সহযোগিতায় নিউইয়র্কের একটা বড় হাসপাতালের একজন নামকরা ডাক্তারের অধীনে চিকিৎসা পাবার সুযোগের সন্ধান পেলেন। এই ডাক্তার বাংলাভাষায় কথা বলেন না, ইংরেজিতে বলেন। ইংরেজি ভাষার ডাক্তার এবং রোগী দু’জনেরই দ্বিতীয় ভাষা। ডাক্তার সাহেবের কথা বুঝতে রোগীর খুব একটা অসুবিধা হয়নি। দুবার দুটো কথা বুঝতে সমস্যা হলে তিনি দ্বিতীয়বার বলে বুঝিয়ে দেন।

আমাদের আজকের আলোচ্য রোগীর হার্টের সমস্যা থেকে শুরু করে চারটি জটিল রোগ আছে। ওনার লিখে নেয়া ওষুুধের তালিকা ধরে ডাক্তার সাহেব দীর্ঘসময় নিয়ে নতুন রোগীটাকে বুঝে নেয়ার চেষ্টা করলেন। উনি আগে প্রাইমারি ডাক্তারকে দেখিয়ে ছিলেন এবং কেন ডাক্তার পাল্টানো হচ্ছে এগুলো তিনি খুব মিষ্টি ভাষায় জানতে চাইলেন।

আমাদের এই রোগী জানেন যে, আগের ডাক্তার সাহেবও নিউইয়র্কের একটি অনেক বড় এবং বিখ্যাত হাসপাতালের উচ্চপর্যায়ের একজন ব্যক্তি। ওনার চেম্বারে জটিল স্তরে রোগী না দেখার অমানবিক সিদ্ধান্তে এই কারণেও ইনি আরো বেশি অবাক হয়েছেন। এই ডাক্তার সাহেবকে খুব সমীহ করার কণ্ঠে ওই ডাক্তারের নাম বললেন এবং জানালেন যে, ডাক্তার সাহেব একটা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে নতুন করে বোর্ড মেম্বার হয়েছেন। ওই ইন্স্যুরেন্স গ্রহণ না করলে তিনি রোগী দেখবেন না বলে ওনার সহকারীরা জানিয়ে দিয়েছেন।

ডাক্তার সাহেব ঠান্ডা মাথায় মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনলেন, সব ওষুধের নাম কম্পিউটারে লিখলেন। দুটো ওষুধের নাম ধরে স্বগতোক্তির মতো করে প্রশ্ন করলেন, এই ওষুধগুলো এতো লম্বা সময় ধরে দিচ্ছে কেন? এগুলো তো এক-দুই মাসের বেশি সেবন করা ক্ষতিকর!

নতুন ডাক্তারের নতুন রোগী ডাক্তার সাহেবের উপদেশ অনুযায়ী কয়েকটা পরীক্ষা পর্ব শেষ করে আরো পাঁচটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের একটা মুদ্রিত কাগজ হাতে নিয়ে সেদিনের জন্য মুক্তি পেলেন।

পর দিন সকাল ৯টা বা সাড়ে ৯টার দিকে আমাদের এই ভাগ্যবান রোগী একটা ফোনকল রিসিভ করলেন। একটি শিশুকে যেভাবে একজন অভিভাবক বর্ণশিক্ষা দান করেন সেই রকম মিষ্টি ভাষায় ডাক্তার সাহেব বিগত দিনের সব পরীক্ষার ফলাফল জানালেন। কি কি সমস্যা এখনো আছে সেগুলো বললেন। একটা ওষুধ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পাওয়ারের এবং অতি দীর্ঘসময় ধরে সেবন করার কারণে দেহে পটাসিয়াম বেড়ে যাবার কথা জানালেন। ডায়াবেটিসের আধিক্যের কথা জানালেন। বিস্তারিত বলার পর একটা তারিখ দিয়ে বললেন, পুনরায় পরীক্ষার জন্য আরো কিছু রক্ত লাগবে। ওষুধের রিফিল সম্পর্কে জানালেন, যেসব ওষুধের প্রয়োজন সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত সেগুলোর তালিকা ফার্মেসিতে পাঠানো হয়েছে। বাকিগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যদি প্রয়োজন মনে করা হয়, তখন পাঠানো হবে।

প্রিয় পাঠকবৃন্দ, আজকের বিষয়টি এতোই সেনসেটিভ যে, কোনো মন্তব্য করতে আমি সাহস পাচ্ছি না। এই রোগীর পূর্ব অভিজ্ঞতা ঢাকায় হলে আমরা বিস্মিত হতাম না, কিন্তু এতো নিউইয়র্ক, এটা তো আমেরিকার অংশ। কেউ কারো দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে কিনা, অনুচিত কিছু ঘটছে কিনা, এগুলো দেখার জন্য প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা আছে বলেই তো আমরা জানি। উপরন্তু বাংলায় কথা বলা মানুষদের নিয়ে অনুচিত খেলাধুলা করতে যাওয়া ফলাফল কি হতে পারে তা খামখেয়ালি ব্রিটিশ এবং পাকি শাসকেরা দেখে গেছে। আর কোনো মানুষ যদি অর্থ এবং প্রভাবের ধূম্রজালে পড়ে উচিত-অনুচিত ভুলে যায় নিয়ম এবং নিয়তি কোনোটাই তাকে মাফ করে না। উপরন্তু এটা কিন্তু আমেরিকা, অতএব সাধু সেজে অসাধু কর্মচর্চাকারীদের সাবধান হবার বিষয় আছে।

আমরা জানি না, আমাদের আজকের লেখায় এই রোগী ভদ্রলোকের বিষয়টি সঠিকভাবে চিত্রায়িত করতে পেরেছি কিনা। আমরা বাংলায় কথা বলা মানুষের ভালো কাজে অনেক বেশি খুশি হই আর অনুচিত কাজে সীমাহীন অখুশি হই। কারণ খারাপ দিকটা কমিউনিটির খুব বড় ধরনের ক্ষতি করে ফেলবে, যেটা কেউই সহজভাবে নেবে না। নিউইয়র্কে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি মনিটরিং টিমসমূহের একটু মনোযোগী হওয়া খুবই প্রয়োজন।

শেয়ার করুন