২৬ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ০৫:১০:১৫ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :


আন্দোলনের মাধ্যমেই বাংলাদেশে নেতৃত্ব গড়ে উঠবে
মঈনুদ্দীন নাসের
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-১০-২০২২
আন্দোলনের মাধ্যমেই বাংলাদেশে নেতৃত্ব গড়ে উঠবে


আন্দোলনের সূতিকাগার হচ্ছে অত্যাচারীর নির্যাতন, নিষ্পেশন। কিন্তু আন্দোলনের সফল পরিণতির জন্য চাই নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম, আকণ্ঠ প্রতিবাদ, জীবনের মোহ-মায়া ত্যাগ করে উচ্চ জীবনের আকাঙ্ক্ষা, বিশেষ করে দেশের মানুষ ও মাটির মুক্তি। মানুষ ও মাটির মুক্তি না হলে জীবনযুদ্ধ সার্থক হতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষ ফকির মজনু শাহ, ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরাণী, ফেরাগুল শাহ, চেরাগালী শাহ থেকে শুরু করে সূর্য সেন, প্রীতিলতা, মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হকের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দেখেছে। বাংলাদেশের বুকে দাঁড়িয়ে দেখেছে ইলামিত্রের নেতৃত্বে নাচোলের কৃষক বিদ্রোহ। আব্দুল মতিন, অলি আহাদ, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন, ’৫৭ সালের মওলানার কাগমারী সম্মেলন, ’৬২ সালের শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন, ’৬৯ সালে আবার মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গণতন্ত্রের লড়াই, পরিণতিতে স্বাধীনতা আন্দোলন। এই সব আন্দোলনের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে নেতৃত্ব, বাংলাদেশের জাতীয় নেতৃত্ব। কিন্তু ষড়যন্ত্রের যাঁতাকলে বাংলাদেশের সৃষ্ট নেতৃত্ব তার অনুসারিরা হারিয়ে গেছে। সম্ভাবনায় উজ্জ্বল দিনগুলো ম্লান হয়ে গেছে আর আজ দেশের নেতৃত্ব গিয়ে পরদেশে আকুতি জানায় গদি রক্ষার। আন্দোলন আজ ম্রিয়মাণ। আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে বিজয় কেতন। গর্বের দেশকে ভূলুণ্ঠিত করেছে সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র-সংহারি বিদেশি গোষ্ঠীর কাছে। 

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য লড়তে হয়েছে বাংলাদেশি জনগণকে। কারণ তারা নির্বাচনে জিতেও পাকিস্তানের শাসনে বসতে পারেননি। গণতন্ত্র নিয়ে পাকিস্তানিদের ধোঁকা বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই যুদ্ধকে বস্তুত সাংস্কৃতিক সংগ্রামের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই যুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রভাব থাকলেও যুদ্ধটা মূলত গণতন্ত্রের কারণে। বলতে গেলে যুদ্ধ্রে মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বর্বর পাকিস্তানিদের খাঁচা থেকে মুক্ত করে আনতে হয়েছে। আর যুদ্ধ করেই গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশেও শাসকগোষ্ঠী গণতন্ত্রের জবাবদিহিতাকে সহ্য করতে পারলো না। শুধু তাই নয়, সার্বভৌমত্বের ওপরেও নেমে আসলো বিদেশের থাবা। স্বচ্ছতার কষ্টিপাথরকে করা হলো প্রশ্নবিদ্ধ। ১৯৭৫ ও ১৯৮১ সালের দু’জন প্রেসিডেন্টকে হত্যা করা হলো। অথচ তাদেরকে অপসারণের আন্দোলনকে সুযোগ দেয়া হলো না। বিকল্প নেতৃত্ব সৃষ্টির পথ রচনাতে ব্যত্যয় ঘটলো। এই ব্যত্যয়ের ইতিহাসই বাংলাদেশের সংকটের ইতিহাস। পাঠককে বিষয়টা বুঝে নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকা-ের সময় যেভাবে আন্দোলন হচ্ছিল তা যদি স্বাভাবিকভাবে চলতো, তাহলে হয়তো বাংলাদেশে নেতৃত্বের অভাব হতো না। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠতো বিকল্প নেতৃত্ব। এরপর ঘটনাপ্রবাহে ক্ষমতায় আসলেন শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তাকেও রাতের অন্ধকারে হত্যা করা হলো। তার সমালোচনা করে আন্দোলনের সৃষ্টি করা হলো না। আন্দোলনবিমুখ থেকে সৃষ্টি হলো এমন নেতৃত্ব, যাদের নেতৃত্বের শক্তি তো দুরে থাক, যোগ্যতা অতিশয় প্রশ্নবিদ্ধ। যদিও চালু ছিল গণতান্ত্রিক ধারা, তাকে ব্যাহত করলো এরশাদ নেতৃত্বাধীন সামরিক শাসন। তারপরও এরশাদের শাসনামলে সৃষ্টি হলো নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন। তাকে পদত্যাগ করতে হলো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। কথা ছিল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা নেতৃত্ব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথকে সুগম করবে। সুগম করবে জবাবদিহিতার স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা। কিন্তু আন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথচলা হলো না। তারপর আসলো আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার শাসন। যদিও বলা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো জরুরি সরকার নয়, তারপরও এ সরকার ভেঙে দেয়া হলো। শুরু হলো পাকিস্তানি কায়দায় গণতন্ত্রের ভূলুণ্ঠন। জুডিশিয়ারিকে ব্যবহার করা হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার তুলে দিতে। সংসদকে ব্যবহার করা হলো সরকার নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে যথেচ্ছাচার উপায়ে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে না গিয়ে লেবেলপ্লেয়িং ফিল্ডের অভাবের অজুহাতে নির্বাচন বয়কট করলো। আওয়ামী লীগ লজ্জাহীনভাবে একতরফা গোল করে নির্বাচনকে লুণ্ঠন করলো। আন্দোলনের গতিধারাকে নিষ্পেষণের মাধ্যমে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হলো। ১৯১৮ সালে ঘটে গেল আরেক নির্বাচনী প্রহসন। নির্বাচনের সময়ের পূর্বেই নির্বাচন খালাস। আবুল বাশারের ফুলবউ উপন্যাসের ফুলবউয়ের কথা মনে হলো। বৃদ্ধস্বামী যখন মারা যাচ্ছিল, তখন ফুলবউ তার কাছে তালাক নয় খালাস চেয়েছিল; কিন্তু খালাস না দেয়ায় সে তার সৎ সন্তানকে বিয়ে করতে পারেনি; যাকে বউয়ের মনে ধরেছিল। বাংলাদেশের জনগণের অবস্থাও তাই। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের যা নেই, তাহলো পছন্দসই মানুষ যাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করতে চায়। কারণ বাংলাদেশে আন্দোলনের মাধ্যমে নেতৃত্ব সৃষ্টিতে কখনো যত্নশীল কার্যক্রম ছিল না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আঞ্চলিক প্রভাবশালীদের ভূমিকা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৮ সালের বেহাল নির্বাচনকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ বলে কথিত ভারত ও সর্ববৃহৎ স্বৈরতন্ত্র চীন একযোগে সমর্থন করে। আর এভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র চর্চাকে ব্যাহত করা হয়। 

বাংলাদেশে র‌্যাবের মানুষ খুনের জন্য জবাবদিহিতা নেই, পুলিশের মানুষ খুনের জন্য জবাবদিহিতা নেই। প্রতিদিন ঘটে চলেছে জালিয়ান ওয়ালাবাগরূপী হত্যাকাণ্ড, ভারতের ১৯৭৪ সালের মতো ইমার্জেন্সির সময়ে যুবকদের হত্যার মতো কর্মকা-, ঘটে চলেছে ধর্ষণ, ছাত্রীদের ওপর বলাৎকার, হলভাড়া বাবদ টাকা আদায়, ভার্সিটির ছাত্রীদের দিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের যৌনবিলাস চরিতার্থ করার মতো কর্মকাণ্ড। বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলেজগুলোতে মহিলা নেত্রীদের দিয়ে মহিলাদের ওপর চালানো হচ্ছে বর্বরতা। তারপরও সারা দেশজুড়ে নেই কোনো আন্দোলন। অথচ বিকল্প নেতৃত্ব সৃষ্টিতে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। আর বর্তমান নেতৃত্ব যেখানে পরদেশের পদলেহী, যেখানে বিরোধী শিবির তাকিয়ে আছে নির্বাচন বাণিজ্যের দিকে, যেখানে দেশের স্বাধীনতা যে ভূলুণ্ঠিত হবে তার বিষয়ে সন্দেহ নেই। 

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এমন বাহার দুই সপ্তাহ আমেরিকায় অবস্থান করে আমেরিকার কাছ থেকে র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার ব্যাপারে কোনো আলাপ করতে পারে না। বাইডনের সাথে ছবি তুলতে গিয়ে কথা বলতে পারে না। ওবামার সময়ে ছবি তুলতে গিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সাথে তার ছেলে জয়কে। কিন্তু এবার বাইডেনের সাথে ছবিতে জয় নেই। আমেরিকায় অবস্থান করেও জয় আসেনি ছবি তুলতে বাইডেনের সাথে। কিন্তু কেন এতো সংশয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত যাওয়ার পূর্বে বিদেশমন্ত্রী প্রাক্তন এনএসএফ নেতা ও যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ নেতা একেএম আব্দুল মোমেন ভারত থেকে এসে ঘোষণা দেন:  তিনি ভারতকে বলে এসেছেন প্রধানমন্ত্রীকে আরো ক্ষমতায় রাখার জন্য। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমার ক্ষমতা চাই, আরো ক্ষমতা চাই, দেশের উন্নয়নের জন্য। প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক ক্ষমতার চাইতে আর বড় ক্ষমতা কি? সম্ভবত তিনি নির্বাচন না দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চান। প্রধানমন্ত্রিত্বের স্বয়ংক্রিয় বর্ধিতকরণ চান। তিনি শিশুরমতো ক্ষমতার বায়না ধরেছেন। 

এ বায়নার সাধ নিতে তিনি শিশুর মতো ক্ষমতা চান। অবাধ ক্ষমতা চান তিনি র‌্যাবের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য, পুলিশের মারণাস্ত্র ব্যবহারের অনুমতির জন্য, দলীয় কর্মী, যারা মানুষ হত্যা করেছে তাদের মুক্তির জন্য, বিরোধীদের কণ্ঠরোধের জন্য, ডিজিটাল আইন প্রয়োগের জন্য, সংবাদপত্রের আওয়াজ রহিত করার জন্য, বিচারপতি শাহাবুদ্দীনের রাজত্বকালে তুলে দেয়া সংবাদপত্র সংশ্লিষ্ট বিশেষ ক্ষমতা আইনের খড়গহস্ত আবার প্রয়োগের। কিন্তু বাংলাদেশটা এমন হবার কথা ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিদেশের অস্ত্রের ঝংকারকে ভয় করেনি। গণতন্ত্রের হত্যাকারী পাকিস্তানের শিবিরকে ভয় করেননি, কিন্তু তার কন্যা ভারতের কাছে নিজের ক্ষমতা চান। আর ভারত চায় হাইওয়ে, ভারত চায় ২৫ শতাংশ ভারতীয় মুদ্রায় ব্যবসা করতে। ভারতের আদানী বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের দাদন সরকারি খাতে বিনিয়োগ করতে চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আদানীর বৈঠকে কি কি আলোচিত হয়েছে জানি না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাৎক্ষণিক তার জবাব দিতে পারেনি। বাংলাদেশ আজ বড়ই নেতৃত্বশূন্য। সরকারি মহলে অন্তত শেখ হাসিনার উপস্থিতি সরবের। কিন্তু বিরোধী শিবিরে কোনো নেতৃত্ব নেই, যা রয়েছে তা নেহায়েত অগৌরবের। নাম উচ্চারণে জাগে বিভমিষা। আন্দোলনের এখন অন্যতম বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ভিপি নুর। তার সাথে কথা বললে তিনি বলেন, সমাবেশ এ সরকার সহ্য করে না। অত্যাচার, নির্যাতন, গুলি তাদের নিত্য ব্যবহার্য উপাদান। আবরারের শোকসভার র‌্যালিতে গুলি করা নেহায়েত কাপুরুষোচিত কাণ্ড। আন্দোলনবিহীন অবস্থায় সরকার নয়, বাংলাদেশই টিকবে না। কাজেই আজ চাই আন্দোলন শুধু সরকারকে জবাবদিহিতার আওতার আনার জন্য নয়, দেশকে টিকিয়ে রাখার জন্য। যে আন্দোলনের মাধ্যমে সৃষ্টি হবে নয়া নেতৃত্ব। 

শেয়ার করুন