১২ এপ্রিল ২০১২, বুধবার, ০১:৩৮:৩৮ পূর্বাহ্ন


বাংলা ক্যালেন্ডারের সঠিক ইতিহাস এবং আমার একটি ভুল
কাজী জহিরুল ইসলাম
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-০৪-২০২২
বাংলা ক্যালেন্ডারের সঠিক ইতিহাস এবং আমার একটি ভুল


পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডারগুলো তৈরি হয়েছে রাজা, বাদশাহ, ধর্মযাজকদের জন্ম, মৃত্যু বা বিশেষ কোনো রাজ্য জয় বা পরাজয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। যীশুর জন্ম থেকে গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা, মোহাম্মদের মদিনায় হিজরত করা থেকে হিজরি সাল, রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজ্য জয়ের দিন থেকে বিক্রমসাম্বাত পঞ্জিকা, গুরু নানকের জন্ম থেকে নানকশাহী পঞ্জিকা, সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহনের দিন থেকে তারিখ-ই-ইলাহি বা বঙ্গাব্দ, হয়তো শেখ মুজিবের জন্মসাল থেকে বা তার জন্মশতবার্ষিকী থেকে শুরু হতে যাচ্ছে আরেকটি নতুন পঞ্জিকা মুজিববর্ষ।

আজ বাংলা পঞ্জিকা, বাংলা মাস, এসব নিয়ে কিছু কথা বলবো। ‘শেকড়ের খোঁজ’ গ্রন্থে আমি বিস্তারিত লিখেছি এবং গত একযুগ ধরে বিভিন্ন মিডিয়ায় এবং মঞ্চে এ-নিয়ে কথা বলেছি। এখন মনে হচ্ছে আমি কিছু ভুল তথ্য দিয়েছি। সেই ভুলের সংশোধন করতেই এই রচনা।

বঙ্গাব্দের শুরু সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহনের দিন থেকেই। সেটি ছিল ৯৬৩ হিজরি এবং ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ। উপমহাদেশের মুসলিম শাসকেরা চান্দ্রমাসভিত্তিক হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সাম্রাজ্য পরিচালনা করতেন। হিজরি মাস অনুযায়ী ৩৫৪ দিনে বছর, যা সৌরবর্ষের চেয়ে ১১ দিন কম। ৩৫৪ দিনে যেহেতু পৃথিবী সূর্যকে প্রদণি করে পূর্বের জায়গায় ফিরে আসতে পারে না তাই হিজরি সাল অনুযায়ী পরের বছর মাসগুলো আর আগের জায়গায় থাকে না। এভাবে প্রতি তিন বছর পর পর ১ মাস করে পিছিয়ে যায়। দেখা যায় শীতকালের মহররম মাস ১০ বছর পরে গ্রীষ্মকালে হয়। যেহেতু কৃষকেরা উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে খাজনা পরিশোধ করে তাই খাজনা আদায়ের মাস সব সময় একটি নির্দিষ্ট ঋতুতে থাকা জরুরি। 

এই তাগিদ থেকে সম্রাট আকবর তার জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতেহ উল্লাহ খান শিরাজিকে নির্দেশ দেন এমন একটি পঞ্জিকা বানাতে যাতে খাজনা আদায়ের মাস ফসল তোলার সময়েই স্থির থাকে। ইরান দেশের মানুষ শিরাজি পারস্য নওরোজ পঞ্জিকাটিকে ভিত্তি করে একটি সৌর পঞ্জিকা বানালেন। আকবর এর নাম দিলেন তারিখ-ই-ইলাহি। সেটি ছিল ৯৯২ হিজরি বা ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দ। আকবর তখন পরিণত সম্রাট। তার শাসনামলের ২৯ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এর দুবছর আগেই, ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে আকবর হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে মজবুত করার জন্য দুই ধর্মের সমন্বয়ে একটি নতুন ধর্ম ‘দ্বীন-ই-ইলাহি’ প্রবর্তন করেছিলেন। নতুন ধর্মের জন্য নতুন পঞ্জিকা। হয়ত এই চিন্তাও তার মধ্যে কাজ করে থাকবে। 

নতুন পঞ্জিকার মাসগুলোর নাম নওরোজ মাসের মত রাখার চেষ্টা করেছিলেন আমির ফতেহ উল্লাহ খান শিরাজি। অনেকে বলেন আকবরের নাতি সম্রাট শাহজাহান মাসের নামগুলো পরিবর্তন করেন কিন্তু এর সপে তেমন জোরালো কোনো যুক্তি বা প্রমাণ মেলে না। বরং আমি মনে করি ভারতবর্ষের হিন্দুদের মধ্যে শকাব্দের প্রচলন ছিল, দিনণের হিসাব রাখতে তারা বিক্রমসাম্বাত পঞ্জিকার বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র এই মাসগুলো ব্যবহার করতো। আকবর যেহেতু উদারনৈতিক মানুষ ছিলেন এবং উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের জন্য দুই ধর্মের সমন্বয় করতে চেয়েছিলেন, নিজে হিন্দু মেয়ে জোধা বাইকে বিয়ে করেছিলেন, তিনিই নত্রভিত্তিক বিক্রমসাম্বাত পঞ্জিকার বা শকাব্দের মাসগুলো গ্রহণ করেন। তবে এই পঞ্জিকার নাম তারিখ-ই-ইলাহি থেকে বদলে গিয়ে বঙ্গাব্দ কখন হলো তা আমি এখনো নিশ্চিত নই। অনুমান করতে পারি, হয়তো তখনই বা পরবর্তিতে বাংলার শাসকরা এর নাম বঙ্গাব্দ দিয়ে থাকতে পারেন। 

পঞ্জিকাটি আকবর তার শাসনামলের ২৯ বছরের মাথায় তৈরি করলেও এর শুরুর কাল নির্ধারণ করেন তার সিংহাসনে আরোহনের বছর থেকে। সেটি ছিল ৯৬৩ হিজরি। সম্রাট বাবর থেকে শুরু করে হুমায়ুন হয়ে আকবরের ২৯ বছর, এই দীর্ঘসময় সাম্রাজ্যের লোকেরা হিজরি সাল অনুযায়ী বছর গুনে আসছে হঠাৎ নতুন করে ১ সাল থেকে বছর গুনতে বললে তারা বিভ্রান্ত হতে পারে, হিজরি সালকে বাতিল করা হচ্ছে, এটা ভেবে মুসলমানেরা প্তি হতে পারে, এসব বিবেচনা করে বিচণ আকবর সিদ্ধান্ত নেন ৯৬৩ সালই থাকবে, শুধু বছরটা ৩৫৪ দিনের বদলে ৩৬৫ দিনে হবে। সেই থেকেই তারিখ-ই-ইলাহি বা বঙ্গাব্দের শুরু। 

একটি শিশু ভ‚মিষ্ঠ হয়েই তার বয়স বলছে দশ বছর, এটা কি করে হয়। আমার এক সময় মনে হয়েছিল, এটা কিছুতেই হতে পারে না। তাই পেছনে হাটতে শুরু করলাম। কবে হয়েছিল ১ বঙ্গাব্দ, কে ছিল বাংলার শাসক? খুঁজে বের করলাম, তখন রাজা শশাঙ্ক পাল ছিলেন বঙ্গের শাসক। সেটি ছিল ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ। ইতিহাস বলছে এর কাছাকাছি সময়েই বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্য (লিখিত ফর্মে) চর্যাপদ রচিত হয়েছে। কাজেই বাংলা সন-তারিখের শুরুটাও সেই সময়ে হওয়া খুবই যুক্তিসঙ্গত। প্রকৃতপে এই পঞ্জিকাতো ছিলই, যীশুর জন্মের ৫৭ বছর আগেই রাজা বিক্রমাদিত্য বিক্রমসাম্বাত পঞ্জিকার প্রবর্তন করেন। পাল বা বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা সেই সময়ে লিখতে শিখেছেন, কাজেই তারা এর একটি বাংলা নাম বঙ্গাব্দ দিয়ে লিখতে শুরু করেন। 

বিষয়টি খুবই যুক্তিগ্রাহ্য মনে হলেও এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে এটি সঠিক নয়। সম্রাট আকবরই বাংলা সালের প্রবর্তন করেন এবং জন্ম হয়েই এর বয়স ছিল ৯৬৩ বঙ্গাব্দ। কেন এটা মনে হচ্ছে সেই কথাটিই বলছি। ৯৬৩ বঙ্গাব্দই ছিল ৯৬৩ হিজরি। কিন্তু এখন ১৪২৯ বঙ্গাব্দে এসে হিজরি সাল দাঁড়িয়েছে ১৪৪৩। পার্থক্য হয়ে গেল ১৪ বছর। এবার দেখুন শুরুর বছর থেকে আজ অব্দি পার হয়েছে (১৪২৯-৯৬৩) ৪৬৬ বছর। আমরা জানি, হিজরি সাল ১১ দিন কম অর্থাৎ বাংলা সাল ১১ দিন বেশি। ৪৬৬ বছরে মোট কতদিন বেশি হলো তাহলে? (৪৬৬ী১১) ৫ হাজার ১২৬ দিন। এই ৫ হাজার ১২৬ দিনকে আমরা যদি ৩৬৫ দিন দিয়ে ভাগ করি, তাহলে পেয়ে যাবো ১৪ বছর। আজ বাংলা সাল ঠিক ১৪ বছরই পিছিয়ে আছে। এতে এটা সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণিত যে ৯৬৩ হিজরিকেই সম্রাট আকবর ৯৬৩ বঙ্গাব্দ (বা তারিখ-ই-ইলাহি) ঘোষণা করেছিলেন।

বাংলা বারো মাসের নাম এসেছে ১২টি নত্রের নাম অনুসারে। কে বা কারা এই নাম রেখেছেন তার সঠিক ইতিহাস আমি অন্তত জানতে পারিনি। যদি কখনো আনতে পারি তখন আমার পাঠকদের অবশ্যই জানাবো। তবে একইসঙ্গে একজন পণ্ডিত সব নাম রেখেছেন এমনটা আমি আন্দাজ করি না। হয়ত শত শত বছর লেগে গেছে সব নাম পেতে। 

বৈশাখ এসেছে বিশাখা নত্রের নাম থেকে। এই মাসে বিশাখা সূর্যের সবচেয়ে কাছে থাকে। জ্যেষ্ঠা নত্র থেকে এসেছে জ্যৈষ্ঠ মাসের নাম। এই নত্রটির বৈদিক নাম ইন্দ্র। অষধা নত্র থেকে আষাঢ় মাসের নাম এসেছি। তবে পূর্বাষাঢ়া এবং উত্তরাষাঢ়া নামেও দুটি নত্র আছে। শ্রবণা নত্র থেকে এসেছে শ্রাবণ মাসের নাম। ভদ্র নামের একটি নত্র আছে, সেটি থেকে এসেছে ভাদ্র। অশ্বিনী নত্রের নামে আশ্বিন মাসের নাম রাখা হয়েছে। কৃত্তিকা এবং মৃগশিরা থেকে এসেছে যথাক্রমে কার্তিক এবং অগ্রহায়ণ মাসের নাম। আগ্রা এবং হায়ন নামেও দুটি নত্র আছে। পুষ্যা নত্রের নামে হয়েছে পৌষ মাসের নাম, মঘা থেকে এসেছে মাঘ মাস। ফাল্গুনী নামে দুটি নত্র আছে, একটি উত্তর ফাল্গুনী, অন্যটি দণি ফাল্গুনী। এই নত্রদ্বয় থেকেই ফাল্গুন মাসের নামকরণ করা হয়েছে। চিত্রা নত্র থেকে হয়েছে চৈত্র মাসের নাম।

এই নামগুলো যে বাঙালিরাই রেখেছে সেটিও নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। কিছুটা ভিন্ন উচ্চারণে এই বারো মাসের নামই ব্যবহার করে পৃথিবীর বহু দেশ। আমাদের উপমহাদেশের সব দেশ তো বটেই এমন কি লাউস, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড এবং চীনেরও কিছু অংশ এই নামগুলো ব্যবহার করে। 

উপমহাদেশের হিন্দুদের মধ্যে একই পঞ্জিকা শকাব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। শকাব্দের প্রথম মাস চৈত্র। শিখ সম্প্রদায়ের লোকেরা গুরু নানক শাহের জন্মের বছর থেকে নানকশাহী পঞ্জিকা অনুসরণ করে কিন্তু মাসগুলোর নাম প্রায় একই। ওরা বলে, চেত, বাইসাখ, জেথ, হার্থ, সাভন, ভাদন, আসু, কাত্তক, মাঘার, পোহ, মাঘ এবং ফাগ্গান। চেত প্রথমে থাকলেও বাইসাখের প্রথম দিনকেই ওরা নববর্ষ হিসেবে মানে।

৩৬৫ দিনে বছর হলেও গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা যেত না। কোনো বছর ২১ ফেব্রæয়ারি হয় ফাল্গুন মাসের ৮ তারিখে আবার কোনো বছর হয় ৯ তারিখে। ১৪ এপ্রিলে একবার হয় পহেলা বৈশাখ, আবার অন্য বছর হয় ১৫ এপ্রিলে। আমি ছেলেবেলায় আমার নানাকে বলতে শুনেছি, এ বছর আষাঢ় মাস ৩২ দিনে হবে। এসব অসামঞ্জস্য দূর করার জন্য ১৯৫৪ সালে ভারতে ড. মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে একটি কমিটি হয়। এই কমিটি কিছু সংস্কার করেন। ১৯৬৩ সালে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে বাংলা একাডেমি ‘বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার’ কমিটি গঠন করেন, যেটি শহীদুল্লাহ্ কমিটি নামে পরিচিত।

সংস্কারের ফলে দাঁড়ায়: বৈশাখ থেকে ভাদ্র এই পাঁচ মাস হবে ৩১ দিনে। আশ্বিন থেকে চৈত্র এই ৭ মাস হবে ৩০ দিনে। ইংরেজি ফেব্রæয়ারি মাসের সঙ্গে মিল রেখে ফাল্গুন মাসকে অধিবর্ষ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতি চতুর্থ বর্ষে ফাল্গুন মাস ৩০ দিনের বদলে হবে ৩১ দিনে। মেঘনাদ সাহার সংস্কারে চৈত্র মাসকে অধিবর্ষ করা হয়েছিল।

১৯৬৩ সালে শহীদুল্লাহ কমিটি যে সংস্কার করে তা বিবেচনার জন্য টেবিলে ওঠে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮৮-৮৯ সালে। কিন্তু তাতেও কিছু জটিলতা দেখা দেয়। পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে এটি আমলে নিয়ে নতুন বাংলা পঞ্জিকা প্রকাশ করা হয়। এখন ৮ই ফাল্গুনে একুশে ফেব্রæয়ারি হয় এবং ১৪ এপ্রিলেই পহেলা বৈশাখ হয়।

হলিসউড, নিউইয়র্ক

১৪ এপ্রিল ২০২২

শেয়ার করুন