২৫ এপ্রিল ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৭:১৯:৫৭ পূর্বাহ্ন


ডিজিটাল আইনে ভুক্তভোগীদের বর্ণনা
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-০৪-২০২৩
ডিজিটাল আইনে ভুক্তভোগীদের বর্ণনা


‘ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন দিয়ে নাগরিকদেরকে প্রতিহত করা হচ্ছে যে, তারা তাদের অভিযোগগুলো বলবে না, তারা লিখবে না, সাংবাদিকরা যেন না লিখে তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ঠিক একই অন্যান্য আইনগুলো দিয়ে আজকে এই নির্বাচনে তারা প্রতিপক্ষকে সম্পূর্ণ রূপে দূরে রেখে নির্বাচন পার হয়ে যেতে চায়।’ কথাগুলো বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি আরো বলেন, ‘‘এই সরকার কোনো নির্বাচিত সরকার নয়, দখলদারী একটা সরকার। তারা এসব আইন করে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে চায়। সামনে নির্বাচন- এই নির্বাচনকে সামনে রেখে যেন কেউই রুখে দাঁড়াতে না পারে, কেউ যেন তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারে এবং নির্বাচনে তাদেরকে কেউ যেন বাধা দিতে না পারে তার জন্য এই সমস্ত আইনগুলো করে নিয়ে যাচ্ছে।”  গত ১১ এপ্রিল মঙ্গলবার ডিজিটাল নিরাপত্তার আইন বিষয়ক এক সেমিনারে বিএনপি মহাসচিব এই মন্তব্য করেন। 

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সকল কালাকানুন বাতিল করতে হবে। সবার আগে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল করতে হবে। এটা এখন দেশের দাবি, জনগনের দাবি। আসুন আমরা আমাদের সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশকে একটা সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য, বাংলাদেশকে একটি সত্যিকার অর্থে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র নির্মাণের জন্যে, এখানে সাধারণ মানুষ যাতে তার অধিকার ভোগ করতে পারে, বৈষম্য কমিয়ে নিয়ে এসে সাম্যের একটি অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করার জন্যে আমরা সবাই একযোগে লড়াই শুরু করি। এই যে ভয়াবহ দানব যা আমাদের বুকের ওপরে চেপে বসে আছে তাদেরকে সরিয়ে সত্যিকার অর্থেই জনগণের একটা পার্লামেন্ট, জনগণের একটা সরকার গঠন করতে পারি-সেই লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে যাই।’

গুলশানে লেকশোর হোটেলে বিএনপির উদ্যোগে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, গণতন্ত্র এবং সাংবিধানিক কাঠামো’ শীর্ষক এই সেমিনার হয়। এতে দলের দলের মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান আসাদ মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১৭ মাস কারাবন্দি থাকা বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি রুহুল আমিন গাজী বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের মানুষের সমস্ত অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। এই আইনের সমস্ত ধারাই খারাপ, নির্মম, নির্দয়, মানবাধিকার পরিপন্থি। সেইদিন আমাকে কর্মস্থল থেকে তুলে নেয়া হয়েছিলো।  ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রেখে দেশে গণতন্ত্রের কথা চিন্তা করা যায় না। এই ফ্যাসিস্ট সরকার যতদিন থাকবে দেশে মানুষ স্বাধীন থাকবে না।’  

আইসিটি অ্যাক্টে ভিকটিম রাজবাড়ীর সোনিয়া আখতার স্মৃতি বলেন, ‘সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলছি বলে আইসিটি অ্যাক্টে মামলা করছে। আমাকে রাতে রাজবাড়ীতে থেকে তুলে নিয়ে কয়েক ঘন্টা কোথায় রেখেছে আমি জানি না। আমার দ্ইুটা ছোট ছোট বাচ্চা আছে তাদের থেকে নিয়ে তারা আমাকে তুলে নিয়ে ছিলো। আমি এই মামলার ভুক্তভোগী। আমার কথাটা ভাইরাল হয়েছে বলে আমাকে আপনারা জানেন। কিন্তু এমন অনেকে আছেন তাদের খবর কেউ জানে না।’

জাহিদ হাসান বলেন, ‘এই আইনের গুমের ওপর কিংবা তুলে নেয়ার পর কি যে অত্যাচার করা হয় যা আমি বলে শেষ করতে পারবো না। আমাকে গুম করেছে আমার কি অপরাধ ছিলো? আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু লিখতাম, ব্লগিং করতাম.. এই যা।’ গুমে থাকা অবস্থার তার ওপর ‘নির্মম’ নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন তিনি।

ডিজিটাল আইনে গ্রেফতার হওয়া মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ বলেন, ‘আমি শুধু সোশ্যাল মিডিয়া একটু বক্তব্য দিয়েছিলাম, আবেগ থেকে একটু কথা বলেছিলাম সেজন্য আমাকে তুলে নিয়ে গেলো। আমাকে র‌্যাব অফিসে নিয়ে একের পর এক ইন্টারোগেশন করেছে তার বর্ণনা দিলে শিহরিত হয়ে উঠতে হয়। আমি এখানে তা বলতে চাই। আমাদের রিমান্ডের পর জেলে পাঠানো হয় সেখানে আমাকে কম্বল-বালিশটা পর্যন্ত দেয়া হয়নি। এই হচ্ছে আমাদের স্বাধীন দেশ।’

দীর্ঘদিন গুম থাকা দৈনিক পক্ষকালের সস্পাদক আলোকচিত্রী শফিকুল ইসলাম কাজল বলেন, ‘বাংলাদেশের গণমাধ্যম কতটা স্বাধীন? আমার মনে হয়, গণমাধ্যম এখন মৃতপ্রায়। ৫৩দিন গুম হওয়াকালে আমি কিছুই বুঝতে পারিনি.. কোথায় আছি, কেমন আছি। আমার চোখ বন্ধ ছিলো। আমি ক্রসফায়ারারে মুখোমুখি হয়েছি। অভিযোগ ছিলো.. আমি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে লিখেছি। হয়ত লিখেছি.. এটা আমার অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার। তাই বলে গুম করে নেয়া হবে.. ক্রসফায়ারের নেয়া হবে.. জেল খাটতে হবে।’

‘তারা রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়’

দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এই সরকারের সবচেয়ে বড় অপরাধ তারা রাষ্ট্রের যে আত্ম সেই আত্মার মূল যে চরিত্র তাকেই তারা ধবংস করে ফেলেছে, একটা গণতান্ত্রিক যে আত্মা সোল সেটাকে তারা নষ্ট করে ফেলেছে। ইচ্ছাকৃতভাবে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে শুধু নিজেরা ক্ষমতায় থাকার জন্য একদলীয় শাসন ব্যবস্থা যেটা তাদের অতীতের লক্ষ্য ছিলো সেই বাকশাল তৈরি করার মধ্য দিয়ে যেটা ব্যর্থ হয় এখন নতুন আঙিকে নতুন ছদ্মবেশ ধারণ করে, একটা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কায়েম করছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে নাগরিকদের নির্যাতন করা হচ্ছে।এখন কি করছে? যে কেউ বাইরে থেকে যদি কোনো লেখা লেখে বা স্ট্যাটাস দেয়- ডয়েচে ভেলের একটা ভিডিও গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে র‌্যাবের ঘটনা নিয়ে। সেই ভিডিওতে একজন সাক্ষ্য দিয়েছিলো নাফিজকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের একটাই লক্ষ্য নাগরিকদের কথা বলতে দেয়া হবে না, নাগরিকদের তাদের অধিকার প্রয়োগ করতে দেয়া হবে না। তারা তাদের মতো করে এখনো রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, করেছে সেইভাবে।’ তিনি বলেন, ‘এটা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র পথ। এদেরকে সরাতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আজকে প্রত্যেকে আমরা ভিক্টিম হচ্ছি, প্রতিটি নাগরিক ভিক্টিম হচ্ছে, দেশের সাধারণ ও গরীব মানুষ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’

তারা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে চায়

হাতিরঝিল থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী অপুকে গত পরশু সাদা পোষাকধারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নেওয়ার পর থেকে নিখোঁজ রয়েছে জানিয়ে অবিলম্বে তার সন্ধান ও মুক্তি দাবি জানান বিএনপি মহাসচিব।

স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, এই ডিজিটাল নিরাপত্তা  এটা আমাদের সংবিধান পরিপন্থি, এই ডিজিটাল আইন গণতন্ত্রের পরিপন্থি, এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ইউনিভারসেল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস-১৯৪৮ এর পরিপন্থি। আজকে জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান আছেন তারও প্রতিক্রিয়া আপনারা দেখেছেন তিনি সরকারকে বলেছেন, এটা স্থগিত করেন। আমরা একথায় বলতে চাই। 

বিএনপি মহাসচিবের সভাপতিত্বে ও প্রচার সম্পাদক শহিদ উদ্দিন চৌধুরীর সঞ্চালনায় সেমিনারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমির খসুর মাহমুদ চৌধুরী, জাতীয় পার্টি(কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, গণঅধিকার পরিষদের ড. রেজা কিবরিয়া, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, এনডিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লুতফর রহমান বক্তব্য রাখেন।

অনুষ্ঠানে কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নূর, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, জাতীয় দলের সৈয়দ এহসানুল হুদা, মুসলিম লীগের শেখ জুলফিকার চৌধুরী বুলবুল, নাগরিক ঐক্যের শহীদুল্লাহ কায়সার, এনডিপির আবু তাহের, বিকল্পধারা বাংলাদেশ’র অধ্যাপক নুরুল আমিন ব্যাপারী, জাগপার খন্দকার লুতফর রহমান, গণদলের এটিএম গোলাম মাওলা, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহিউদ্দিন ইকরাম, সাম্যবাদী দলের সৈয়দ নুরুল ইসলাম, পিপলস লীগের সৈয়দ মাহবুব হোসেন, ন্যাপের সালেকি, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের হারুন চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদ, ন্যাপের এমএন শাওন সাদেকী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

বিএনপির সেলিমা রহমান, নজরুল ইসলাম খান,  আবদুল্লাহ আল নোমান, শাহজাহান ওমর, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বরকত উল্ল্হা বুলু, আবদুল আউয়াল মিন্টু, মীর নাসির, আহমেদ আজম খান, মনিরুল হক চৌধুরী, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, ইসমাইল জবিউল্লাহ, আবদুল কুদ্দুস, আবদুল কাইয়ুম, শাহিদা রফিক, আফরোজা খানম রীতা, বিজন কুমার সরকার, সিরাজ উদ্দিন আহমেদ, মজিবুর রহমান সারোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, শ্যামা ওবায়েদ, জহির উদ্দিন স্বপন, আফরোজা আব্বাস, সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের কাদের গনি চৌধুরী, অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল ইসলাম, অধ্যাপক শামসুল আলম, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম প্রমুখ ছিলেন।

শেয়ার করুন