২৫ এপ্রিল ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০১:১০:৩০ অপরাহ্ন


মার্কিন ভিসানীতির প্রচণ্ড প্রভাব পড়েছে
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-০৬-২০২৩
মার্কিন ভিসানীতির প্রচণ্ড প্রভাব পড়েছে


মার্কিন ভিসানীতি প্রচণ্ড রকম প্রভাব ফেলেছে বাংলাদেশের জনসাধারণের মধ্যে। ব্যাপক আলোচনা এ নিয়ে। প্রায় সর্বত্র এ আলোচনা শুনতে পাওয়া যায়। রাজনীতিবিদরা নিজস্ব মত তুলে ধরে সারমর্ম হিসেবে যে কথাটি অভিন্নভাবে বলছেন সেটা হলো মার্কিন ভিসানীতি বাংলাদেশের মানুষের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। বিশেষ করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন যখন নিজের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে টুইট করেছেন তখন গোটা বিশ্ব মুহূর্তে জেনে গেছে। এরপর এর বহু ব্যাখ্যা বারবার দিচ্ছেন মার্কিনিরা। এটাও ফলাও করে বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো প্রচার করছে। 

ভিসানীতি ঘোষণার একটাই উদ্দেশ্য, বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং সাধারণ মানুষের প্রাণের দাবি তাদের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া। আর এজন্যই মার্কিনিরা ভিসানীতিতে বলেছে, যে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সব ধরনের বাধাদানকারী, বাধা দেওয়ার নির্দেশদাতা ও বাস্তবায়নকারী ও বিরোধীদলের মতো প্রকাশে বাধা প্রদানকারী সে যেই হোক না কেন, তার ও তার পরিবারকে ভিসা দেবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং এ কাজে সহায়তাকারী চিহ্নিত হলে তার ভিসা থাকলেও তা বাতিল করা হবে। 

যখন একটা দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা কে চালাবে সেটা নিরূপণে সাধারণ মানুষের মতো প্রতিষ্ঠার জন্য ভিসানীতি দিয়ে জনগণের অধিকার ফেরানোর চেষ্টা করা হয়, তখন গোটা বিশ্ব এ বিষয়টা নতুন করে জানলো। কেউ এ ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করলো আবার কেউ অধীর আগ্রহে পরবর্তী অবস্থা অবলোকন করতে তৈরি হলো। মার্কিনিরা এ কাজটা করে দিয়েছেন এবং দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন বিষয়টা সমাধানে এগিয়ে এসেছে এবং গণমানুষের মতো ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটা ওপেন উদ্যোগ নিয়েছে-এখন থেকে তারা সেটা সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত যত রকম উদ্যোগ রয়েছে সেগুলো প্রয়োগ করতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। 

দেশের সাধারণ মানুষও ডিজিটাল বাংলাদেশের বিভিন্ন মাধ্যমের বিশ্লেষণে সে বিষয়গুলো এখন পুরাপুরি অবগত। যদিও এতে মতবিরোধ রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের ক’জন লোক আমেরিকাতে যাবেন। কিন্তু কথা হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন নীতি আড়ালে ফলো করবে যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ উন্নত বিশ্ব। ফলে এটা অনেকের জন্য সমস্যা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, এ ভিসানীতি সবার জন্য প্রয়োজ্য নয়। যারা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে বাধা দেবে তাদের বেলায় প্রযোজ্য হবে। সমস্যার মূল এখানেই। যারা বাংলাদেশের সব নির্বাচন তথা জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করছেন, তারা সমাজের উঁচুস্তরের লোকজন। যাদের স্বপ্ন ওইসব উন্নত দেশে স্ত্রী সন্তানদের লেখাপড়া ও উন্নত পরিবেশে থাকার ব্যবস্থা করা। মার্কিনিদের ভিসানীতিতে ওই সমস্ত লোকের স্বপ্নে ও প্ল্যানে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলো। 

এটা নিয়ে সরকরি দলের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া একেবারেই ছিল না বললে চলে। যতটুকু ছিল তা তারা দাবি করছিলেন যে আওয়ামী লীগ একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েই এগুচ্ছে। কিন্তু এতে বিএনপি বাধা দিচ্ছে। ফলে এ ভিসানীতিতে এবার বিএনপির জন্য সমস্যার কারণ হয়ে যাবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এ নিয়ে তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এটা সম্পূর্ণ মার্কিনিদের এখতিয়ার। একই সঙ্গে তিনি মার্কিনিদের অনেক বিষয়ে বাংলাদেশ থেকে শেখার রয়েছে বলেও জানিয়েছেন। সর্বশেষ, গত ৩ জুন তেজগাঁওয়ে আওয়ামী লীগের এক সভায় প্রধানমন্ত্রী তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘কে আমাদের ভিসা দেবে না, কে স্যাংশন দেবে সেটা নিয়ে মাথাব্যাথা করে আমাদের লাভ নেই। ২০ ঘণ্টা প্লেনে জার্নি করে, আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ওই আমেরিকা না গেলে কিচ্ছু আসে যায় না। পৃথিবীতে আরো অনেক মহাদেশ আছে, তাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ বৃদ্ধি করব। আমাদের অর্থনীতি আরো মজবুত ও উন্নত হবে। আমরা নিজের পায়ে চলবো, নিজের দেশকে গড়ে তুলবো। কারো মুখাপেক্ষী হয়ে নয়।’ প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য বিপুল করতালি দিয়ে নেতাকর্মীরা স্বাগত জানায়। বিএনপি অবশ্য এ ভিসানীতি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত লজ্জার যা মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া একটা দেশের জন্য অবমানকর বলে মন্তব্য করেছে। এবং এটা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্যই হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে। 

কী প্রভাব পড়তে পারে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. আলী রিয়াজ ও ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে মার্কিন ভিসানীতি নিয়ে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেন। সেখানে ড. আলী রিয়াজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ ভিসানীতি এক অর্থে নতুন নয়। এর আওতায় তারা যখন যাকে খুশি তাদের ভিসা কন্ট্রোল করতেই পারেন। তবে এ মুহূর্তে এটা ঘোষণা করা হলো কেন? এর বৈশিষ্ট কী? এ প্রশ্নটা আসতেই পারে। আসলে মার্কিনিদের খুব শিগগিরই কেন, কখনোই কোনো দেশের বেলায় এমন ভিসানীতি ঘোষণা করতে দেখা যায়নি। যদিও নাইজেরিয়ায় এমন একটা বিষয়ে তারা সফল হওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেটা তাদের ১৫ মের নির্বাচনে অনিয়মের ইস্যু ধরে তার সঙ্গে জড়িত থাকাদের ওপর ভিসানীতি প্রয়োগ করেছে। কিন্তু কোনো দেশের নির্বাচনের আগে যেমনটা এখন বাংলাদেশের জন্য ঘোষণা করেছে, এটা বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে দেখিনি। অন্য দেশের বেলায়ও এটা ঘটেনি। এটা বাংলাদেশের জন্য নতুন ও অভূতপূর্ব। নাইজেরিয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এমন ঘোষণা একটা পোস্ট ফ্যাক্টর। কিন্তু নির্বাচনের আগেই এমন ঘোষণা সেটা অতীতে যুক্তরাষ্ট্র কাউকে দেয়নি। এটাতে বোঝা যায়, বাংলাদেশের আরো সাত মাস পর যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সেটাতে অবাধ ও সুষ্ঠু হবে বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আস্থা রাখতে পারছে না। 

আলী রিয়াজ বলেন, গত দেড় বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করে আসছে। গত বেশ কিছুদিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত আট জন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা বাংলাদেশে সফর করে গেছেন। ওয়াশিংটনেও দুই পক্ষের মধ্যে বৈঠক হয়েছে। এই একই ইস্যুতে। বারবার তারা বলছেন। সর্বশেষ, ওয়াশিংটনেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রসচিবদের সঙ্গে বৈঠক হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন সেক্রেটারির সঙ্গেও। সেখানেও কড়া ভাষায় তারা কথা বলেছেন নির্বাচনের ক্ষেত্রে, যা তারা প্রকাশ করেও জানিয়েছে। কিছু গোপনেও তারা বলেছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী থেকে শুরু করে বেশকিছু মন্ত্রী বলে আসছেন যে, তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। 

এরপরও এবার যেটা করলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটা পাবলিকলি। সর্বস্তরের সবাইকে জানিয়ে দিলো যে, বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু না হলে ভিসানীতি প্রয়োগ করা হবে। এর অর্থ, তারা বাংলাদেশের দায়িত্বশীল ও মন্ত্রিদের কথার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে না-এ সন্দেহ থেকেই তারা এ নীতি অগ্রিম ঘোষণা করেছে। তারা বারবার বলেছে এরপরও এর কোনো প্রতিফলন না দেখায় তারা এ প্রক্রিয়ায় চলে গেছে। এটাই হলো ফ্যাক্টর। এটাই আমার কাছে মনে হয়েছে। 

র‌্যাব ও তার সাত জনের ওপর যখন স্যাংশন দেওয়া হলো তখনো এটা ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বহু দেনদরবার করেছেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। তারা বলেছে, তোমরা সংস্কার করো। কিন্তু কই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সে স্যাংশন তুলে নেয়নি। তার অর্থ তারা হয়তো র‌্যাবের সংস্কার করেনি বা র‌্যাবের করা সংস্কারে সন্তুষ্ট হতে পারেনি।   

ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন 

মার্কিন ভিসানীতি প্রসঙ্গে ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, একটা কিছু হতে যাচ্ছে এটা বেশ কিছুদিন থেকেই আঁচ করা যাচ্ছিল। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর (জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য) সফর শেষে দেশে ফেরার পর থেকে অনেক কিছুই বলা হচ্ছিল। হয়তো ওই ভিসানীতির বিষয়টা ৩ মে জানিয়ে দেওয়ার পর থেকেই এতো কিছু বলা হচ্ছিল, তাতে মনে হচ্ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কোণঠাসা করে একটা গ্রাউন্ড তৈরি করার প্রাণান্তর চেষ্টা। শুধু পিএম নন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ল’ মিনিস্টারসহ অনেক জনের কাছ থেকেই এগুলো শোনা গেছে। এখন একটা প্রশ্ন উঠেছে, এ ভিসানীতি নির্বাচনের আগে কেন? দেখুন বাইরে (দেশসমূহে) একটা কথা প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে যে, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। 

এর একটি হলো ‘অতিকথন’। অনেক আওয়ামী লীগের নেতাকে বলতে শোনা গেছে, ভোটকেন্দ্রে আসতে দেওয়া হবে না। নির্বাচনে তারা যা চাইবে, তাই হবে। বিভিন্ন পর্যায়ে এগুলো বলা হচ্ছিল একেবারে স্থানীয় নির্বাচনগুলোতেও। দেখেন, ইউএসএ এবং ইউই কিন্তু গত দুই বছর ধরে সার্ভে করে আসছিল। তারা এগুলো নোট করেছে। তারা পরিস্থিতি দেখেছে, শুনেছে। ফলে এখান থেকে তারা একটা ধারণা নিয়েছে। তাছাড়া বিগত দুই নির্বাচন বিশেষ করে ২০১৪ ও ২০১৮। বিশেষ করে ২০১৮-এর নির্বাচন। এরপর লোকাল নির্বাচনগুলো দেখে একটা বদ্ধমূল ধারণা তৈরি করে দিয়েছে যে, এখানে (বাংলাদেশে) আর সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান হবে না। 

এ ভিসানীতি ঘোষণার পরের দিন গাজীপুর সিটি নির্বাচনে যা দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে ভিসানীতির প্রভাব পড়েছে। আরো চারটি নির্বাচনে এ প্রভাব আরো পড়বে বলে মনে হচ্ছে। 

ব্রিগেডিয়ার (অব.) শাখাওয়াত বলেন, আমি মনে করি, এটা (ভিসানীতি) এ মুহূর্তে স্যাংশনের চেয়েও বড় জিনিস। আমি যদি বলি জাল ফেলেছে। জাল ফেললে প্রথম দিকে বিস্তৃত থাকে। তারপর আস্তে আস্তে টেনে গুটিয়ে আসে। এখন আমি বলতে পারবো না, এটা কী সেই পরিস্থিতিতে যাবে কি না। এখানে (ভিসানীতি) পূর্ববর্তীদের কথাও বলা হয়েছে। অনেকে ভাবছেন এটা মাইল্ড হবে। কিন্তু আমার মনে হয় না এটা মাইল্ড হবে। যাদের ওপর এটা পড়বে কেবল তারাই অনুধাবনের সক্ষম হবেন। 

তবে এর মূলে নির্বাচন কমিশন। তাছাড়া নির্বাচন কমিশনে তো আর পাঁচজন নন। উপজেলা লেবেল পর্যন্ত অ্যাপ্রুভ অফিসার রয়েছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ কেন্দ্র রয়েছে। ন্যাশনাল ইলেকশন যখন হয়, তখন তো প্রশাসনের লোকজনের ইনভল্বমেন্ট নিয়েই হয়। প্রশাসনেরই এখানে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হয়। ফলে এখানে নির্বাচন কমিশনের ব্যাপ্তি বিশাল। সব দায়দায়িত্বও তাদের ‘ফর গুড অর ফর ব্যাড’। 

শেয়ার করুন