২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ১০:৫১:৩২ পূর্বাহ্ন


চিকিৎসার সুযোগ প্রায় শেষ
মৃত্যুঝুঁকিতে খালেদা জিয়া
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-১০-২০২৩
মৃত্যুঝুঁকিতে খালেদা জিয়া হাসপাতাল বেডে খালেদা জিয়া


বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার সুযোগ প্রায় শেষ হয়ে এসছে, মৃত্যুঝুঁকিতে আছেন। তাকে দ্রুত বিদেশে মাল্টিডিসিপ্ল্যানারি সেন্টারে প্রেরণের সুপারিশ করেছে এভার কেয়ার হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ড।

গত ৯ অক্টোবর সোমবার সকালে এভারকেয়ার হাসপাতালের ব্রিফিং কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়ার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের পক্ষে অধ্যাপক এফএম সিদ্দিকী এই কথা জানান। তিনি বলেন, ‘ম্যাডামের পেটে পানি জমছে, ফুসফুসে সংক্রামণ, পেটে অল্প অল্প রক্তক্ষরণ হতে থাকে। এবারে হাসপাতালে ভর্তিতে উনাকে চার ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে। বাস্তব অবস্থা অত্যন্ত জটিল ও কঠিন। আমাদের এই মেডিকেল বোর্ড এবং এর সঙ্গে চিকিৎসক সম্পৃক্ত সবাই ২৪ঘণ্টা ওনাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে এর মধ্যে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এমন একটা অবস্থায় আমরা উপনীত হয়েছি যে, এ অবস্থায় এখন পরবর্তীতে আমাদের সব চিকিৎসার অপশনগুলো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আমাদের হাতে কোনো অপশন নেই। যদি আমরা দুই বছর আগে ট্রিপস প্রসিডিউরটা করতে পারতাম, তাহলে আজকে ওনার পেটে ও বুকে কোনো পানি জমা হতো না, ওনার পেটে কোনো রক্তক্ষরণ হতো না।’

এফ এম সিদ্দিকী বলেন, ‘চিকিৎসক হিসেবে চোখের সামনে একটা প্রতিকারযোগ্য অসুস্থতা যেটা করা সম্ভব, সেটা করা যাচ্ছে না বিধায় যে একজন রোগী ক্রমশ আস্তে আস্তে খারাপ হয়ে যাচ্ছে-এটা আমাদের পক্ষে বিহ্যাভ করা অনেক কঠিন। এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি। আজকে আমি মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে সর্বসম্মতিভাবে আপনাদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানাতে চাই যে, এখনো সময় আছে যদি ‘ট্রিপস’ করা হয় এবং বিদেশে উন্নত মাল্টিডিসিপ্ল্যানারি সেন্টারে নিয়ে ওনার ‘ট্রিপস’ পরবর্তী লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য ব্যবস্থা করা হয়, সম্ভবত এখনো আমাদের হাতে অপশন আছে যে, আমরা হয়তো ওনার অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারবো।’

‘ট্রিপস’-এর বিষয়ে তিনি বলেন, এই ‘ট্রিপস’ প্রসিডিউরটার কথা বলেছি এটা ইমিডিয়েট দরকার। এই ট্রিপস বাংলাদেশে হয় না। এটা হলে ওনার বুকে যে পানি আসছে, এটা চলে যাবে, রক্তক্ষরণ হবে না। এটা লাইভ সেভিংস প্রসিডিউর। এটি বাংলাদেশে হয় না। লিভার ট্রান্সপারেন্টও বাংলাদেশে হয় না।’ লিভার প্রতিস্থাপন তো বাংলাদেশে করা যায় এখানে আপনারা কেন করছেন না প্রশ্ন করা হলে মেডিকেল বোর্ডের সদস্য গ্যাস্ট্রোলজির অধ্যাপক এ কে এম মহসিন বলেন, ‘আমাদের এখানে লিভার ট্রান্সপারেন্ট হয় না। আমাদের এখানে একটা-দুইটা হয়েছে-বলতে পারেন যে, এক্সপেরিমেন্ট বেসিসে। আমাদের এখানে লিভার ট্রান্সপারেন্টেশনের যে সেটআপ সেই সেটাআপ তৈরি হয়নি, যে ম্যানপাওয়ার দরকার তা নেই, আমাদের কোনো সার্জারি নেই। বেগম খালেদা জিয়ার ক্রিটিক্যাল অবস্থা। বাংলাদেশে তার ট্রিপস ও লিভার ট্রান্সপারেন্টের মতো সেটআপ নেই।

মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদার বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার এখানে ভর্তি আছেন। এই পর্যন্ত তিনি চার বার ভর্তি হয়েছেন। তার অবস্থা জটিল। ম্যাডামকে কেবিন থেকে সিসিইউতে নেয়া হয়েছে। কেবিন থেকে কখন একজন রোগীকে নেওয়া হয় সিসিইউতে? যখন রোগীর অবস্থা ক্রিটিক্যাল থাকে, যখন এভরি চান্স অব কলাপস, সার্টেনলি কলাপস। ম্যাডামের হৃদরোগ আছে, একটা রিং লাগানো আছে, দুটি ব্লক আছে, যখন পানি বের করা হয় তখন চান্স অব কলাপস। সেই পানি বের করার জন্য ওনাকে সেজন্য সিসিইউতে নিতে হয়েছে, এটা বাস্তবতা।

বেগম খালেদা জিয়ার সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরে অধ্যাপক এফ এম সিদ্দিকী বলেন, ‘আপনারা দেখতে পারছেন আগে ভর্তি হতেন বাসায় যেতে পারতেন, এরপর ভর্তি হয়ে একটু বেশি সময় থেকেছেন আর এখন ভর্তি হয়ে তিনি বাসায় যেতে পারছেন না। এর থেকে আপনারা বুঝতে পারেন ম্যাডামের অবস্থাটা কোন পর্যায়ে।’

অধ্যাপক নুরুদ্দিন আহমেদ বলেন, উনার অনেকগুলো রোগ আছে। তার মধ্যে উনি লিভার সিরোসিসের কারণে বেশি কষ্ট পাচ্ছেন। লিভার সিরোসিসের অনেক জটিলতা আছে এর মধ্যে যেমন পেটে রক্তক্ষরণ হয়েছে এগুলো লিভার সিরোসিসের কারণে হয়েছে। ওনার পেটে পানি আসা সেটাও লিভার সিরোসিসের আরেকটি জটিলতা, বুকে পানি আসা আরেকটি মারাত্মক জটিলতা এবং পেটের পানির কারণে ইনফেকসন হওয়া সেটাও মারাত্মক জটিলতা লিভার সিরোসিসের কারণে। যেখানে মৃত্যুঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। আল্লাহর রহমতে আমরা চিকিৎসকরা আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব হয়েছে, যার কারণে উনি হয়তো এই যাত্রা সেভ হয়ে গেছেন। কিন্তু পেটে ও বুকের মধ্যে যতক্ষণ পানি থাকবে, ততক্ষণ মারাত্মক ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে একটা পর্যায়ে কোনো ওষুধে কাজ করবে না এই রকম অবস্থায় চলে যেতে পারে। সেই অবস্থায় মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে। এখন ওনার (খালেদা জিয়া) পেটের ও বুকের পানি সরানোর জন্য আমরা যেটা করছি, দেখেছেন আপনারা তাকে সিসিইউতে নিয়েছি কয়েকবার।

তিনি বলেন, ওনার এই জটিল অবস্থার মধ্যে আমরা ওনাকে বাসায় নেওয়ার অনুমতি দিচ্ছি না। দুই দিন পরপরই বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিচ্ছে এবং ইনফেকশন হওয়া জটিলতা হচ্ছে। রক্তে ইনফেকশন, পানির জন্য ইনফেকশন ইত্যাদি দেখা দিচ্ছে। আপনারা জানতে চেয়েছেন যে, এই অবস্থায় কতদিন আমরা কি করব? জবাব হচ্ছে, আমাদের হাতে আর কোনো চিকিৎসা নেই যে, এই মুহূর্তে সেটি হলো বারবার পানি বের করা এবং যেসব অ্যান্টিবায়োটিক আছে সেগুলো দিয়ে চিকিৎসা করা। কিন্তু আপনাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি এই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে করতে সেগুলো রেজিটেন্স ডেভেলপ করে যাচ্ছে। অনেক উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিকও ওনার মধ্যে কাজ করছে না এটি একটি বড় রকমের ঝুঁকি। তাতে ওনার জন্য চিকিৎসার সুযোগ দেশে নয়, বিদেশে আছে। সেখানে উন্নত সেন্টারে নিয়ে ট্রিপস করলে ওনার বুকে ও পেটে পানি জমা বন্ধ হতে পারে। এটা না করা গেলে এখানে যে কোনো মুহূর্তে ওনার মৃত্যুঝুঁকি অত্যন্ত বেশি।

গত ৯ আগস্ট থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি আছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গত ৯ অক্টোবর সোমবার তার হাসপাতালে থাকার টানা দুই মাস পূর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে লিভার জটিলতার কারণে অবস্থার অবনতি হলে তাকে কয়েক দফা ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নিতে হয়েছে।

এরকম পরিস্থিতির মধ্যে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর অনুমতি চেয়ে গত ২৫ সেপ্টেম্বর তার পরিবারের পক্ষ থেকে ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে। মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশসহ (খালেদা জিয়াকে দ্রুত বিদেশে পাঠানো জরুরি) সেই আবেদনটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলে আবেদনটি নাকচ করে দেয় সরকার। ৭৮ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রাইটিস, হৃদরোগ, ফুসফুস, লিভার, কিডনি, ডায়াবেটিসসহ প্রভৃতি রোগে ভুগছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাহী আদেশে দুর্নীতির দুই মামলায় ১৭ বছরের সাজা স্থগিত করার পর খালেদা জিয়া মুক্তি পেলেও বিদেশে তার চিকিৎসা করা যাচ্ছে না। বিদেশে যাবেন না-এমন শর্তে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ ছয় মাসের জন্য মুক্তি পান বিএনপিনেত্রী। সরকার বলছে, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী এখন বিদেশে যেতে চাইলে খালেদা জিয়াকে কারাগারে গিয়ে আবেদন করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলন অধ্যাপক এস এম এ জাফর, অধ্যাপক শামসুল আরেফিন, অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেন, ডা. জাফর ইকবাল, ডা. আহসানুল আমিন, ডা. জিয়াউল হক, ডা. আতিকুর রহমান, ডা. আল মামুন, ডা. রফিকুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

শেয়ার করুন