২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ১০:৩৩:০১ অপরাহ্ন


অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এক ক্ষণজন্মা তরুণের কথা
রুবিনা হোসেন
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৬-০৬-২০২২
অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এক ক্ষণজন্মা তরুণের কথা


১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইট নামে ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস গণহত্যা শুরু করেছিল। বিশ্বে নজিরবিহীন এই হত্যাকাণ্ডের উপলক্ষ ছিল স্বাধিকার আন্দোলনে উত্তাল বাঙালিদের নিরস্ত্র প্রতিবাদ বুলেটের ভাষায় স্তব্ধ করে দেওয়া। জারি করা হয়েছিল কারফিউ। পিলখানা ইপিআর কোয়ার্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পুরনো ঢাকাসহ সমগ্র ঢাকা নিরীহ মানুষের লাশ আর রক্তে রঞ্জিত। ২৭ মার্চ কয়েক ঘন্টার জন্য কারফিউ তোলা হলে ধানমন্ডি ৪ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে সমবেত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কিছুপ্রতিবাদী তরুণ।

পাকিস্তানের স্বৈরশাসক গণতন্ত্র নস্যাৎ কল্পে যে পন্থা অবলম্বন করেছিল তাতে ক্ষুব্ধ এই তরুণেরা তাদের করণীয় সম্পর্কে বুঝে উঠতে পারছিল না। বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র বাংলাদেশী কিভাবে প্রতিরোধ করবে? কাউকে কিছুএকটা করতেই হবে- এ নিয়ে আলোচনা চলছিল উদ্বিগ্ন তরুণদের মাঝে। ঠিক সেই সময় শোনা গেল রুমের এক কোণে পুরনো গদির ওপর শুয়ে থাকা এক তরুণের কন্ঠস্বর, 'বন্ধুরা, এমন কেউ নেই...আমাদেরকেই এই দায়িত্ব নিতে হবে।’

এই তরুণ শুধু দিক নির্দেশ করেই ক্ষান্ত ছিলেন না, মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নেই সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়ে পড়েন এবং প্রথম গেরিলাদলের একজন হয়ে অস্ত্র জোগাড়ের উদ্দেশে ২৮ মার্চ ঢাকা ত্যাগ করেন। হ্যাঁ, ইনি ছিলেন চার সদস্য বিশিষ্ট প্রথম গেরিলাদলের একজন, নাম বদিউল আলম। পরবর্তী কালে ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে অনেকগুলো দুঃসাহসিক অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন এবং সর্বোপরি ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতায় পাকিস্তানি ক্সসন্যের হাতে ধরা পড়ে অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করে শহিদ হন।

আজ তাঁর ৭৪ তম জন্মবার্ষিকী।

বদিউল আলমের ডাক নাম তপন হলেও সর্বত্র তিনি পরিচিত ছিলেন বদি নামে। জন্ম ১৯৪৮ সালের ২৬ জুন, তাঁর নানাবাড়ি

গফরগাঁও উপজেলার শিলাসী গ্রামে। সাত ভাইবোনের মধ্যে বদি ছিলেন সবার বড়। মেধাবী ছাত্র বদি ফে․জদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে যথাক্রমে সম্মান ও

এমএ পাস করেন। তীক্ন  মেধা, অসাধারণ স্মরণশক্তি এবং বলিষ্ঠ ও প্রতিবাদী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। বদিউল আলমের মা রওশন আরা খানম ছেলেকে নিয়ে লেখা জীবনী  তার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। পরিবারের প্রতি দ্বায়িত্বশীলতা, গরীবের প্রতি মমত্ববোধ, সৃজনশীলতা-এসব বিষয়ের পাশাপাশি অন্যায়ে বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার প্রবণতা তিনি ছোটোবেলা থেকেই ছেলের মাঝে লক্ষ্য করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে মা স্কুল জীবনের একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। ক্লাসে একজন নিরীহ এবং একজন মাস্তান টাইপ ছেলের মাঝে ঝগড়া বাঁধে। পরবর্তী এক সময়ে মাস্তান ছেলেটি আরো কিছু সঙ্গী নিয়ে নিরীহ ছেলেটিকে আক্রমণ করে বসে।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত সকলে দাঁড়িয়ে দেখছিল কিন্ত  শুধুমাত্র কিশোর বদি এগিয়ে এসেছিলেন ছেলেটিকে রক্ষার জন্য। নিজেও প্রহৃত হতে

পারতেন কিন্ত চোখের সামনে ঘটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন ছোটোবেলা থেকেই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। কাজেই সহজেই অনুমেয় যে মানুষ দৈনন্দিন জীবনে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে পারেন না, তাঁর পক্ষে কীভাবে সম্ভব ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে পাকিস্তান হানাদারবাহিনীর নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ নীরবে মেনে নেওয়া? মেনে তিনি নেননি। তাই যুদ্ধে যাওয়ার প্রাক্কালে মাকে এ কথাটাই বলেছিলেন বদি, ‘আম্মা, পাকিস্তানি বাহিনী অন্যায় করছে। আমাদের দেশে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। তারপর আমাদের ওপর অত্যাচার করছে। এই অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতেই হবে।’


বদিউল আলম যখন ক্যাডেট কলেজে/ফাইল ছবি 


বদিউল আলমের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে জানা যায় যে তিনি একেবারেই অন্যায় সহ্য করতে পারতেন না। অন্যায় দেখলেই রুখে দাঁড়াতেন এবং পরিণতি চিন্তা না করেই প্রতিহত করার চেষ্টা করতেন। নিপীড়ন ও নিপীড়কের বিরুদ্ধে সর্বদাই তিনি ছিলেন

সোচ্চার। বিষয়টি আরও পরিস্কার হবে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দিকে দৃষ্টি ফেরালে। ১৯৬৬ সালে বদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তখন সামরিক ‣স্বরশাসক আইয়ুব খানের শাসনাধীনে ছিল দেশ। বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলো প্রাদেশিক গভর্নর মোনায়েম খানের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন (এনএসএফ) এর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণে ছিল। সরকারের মদদপুষ্ট কুখ্যাত সাইদুর রহমান (পাঁচপাত্তু) এবং তার কমরেড খোকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিল। তারা এতোটাই পরাক্রমশালী ছিল যে কেউ তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস করতো না। 

ছাত্রজীবনে বদি নিজেও এনএসএফ এর রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। কিন্ত এনএসএফ এর মাঝে বিভাজন ছিল। এক অংশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মাহবুবুল হক (দোলন)- যার সাথে যুক্ত ছিলেন নাজিম কামরান চে․ধুরী, বদি, স্বপন, সালেকসহ এনএসএফ এর অধিকাংশ নেতাকর্মী। অপর অংশের প্রেসিডেন্ট জমির আলী, যার পৃষ্ঠপোষক ছিল মোনায়েম খান।

এর মধ্যে কোনো এক সময় বদির এক বন্ধু খোকাদের হাতে নির্যাতিত হয়। প্রকৃতিগতভাবে বদি যেহেতুঅন্যায় সহ্য করতে পারতেন না, তাই তিনি নিজ হাতে সমুচিত জবাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বন্ধুতারেকসহ পাঁচপাত্তু ও খোকার দুর্গ হিসেবে পরিচিত ঢাকা হলে গিয়ে খোকার জানালা লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়েন বদি। সেই সময়ের প্রেক্ষিতে এটি এমনই এক দুঃসাহসের কাজ ছিল যা খুব কম মানুষই কল্পনা করতে পারত।

বদিকে এর মাশুল দিতে হয়েছিল চরমভাবে। তাঁকে ঢাকা হলে ধরে এনে প্রচণ্ড মারধর করা হয়েছিল, পিঠ কেটে লবণ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্ত এই ঘটনার পর জমির আলী গ্রুপের দাপট কমে যায় এবং বদি ক্যাম্পাসে কিংবদন্তিতে পরিণত হন। বদির এই দুঃসাহসী রূপের ভেতর ভবিষ্যতের এক দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধারই প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছিল।



ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় বদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন। এই গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক মুক্তি সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল কেননা এর মধ্য দিয়ে এক দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা আইয়ুব খান সরকারের পতন ঘটে। বলা যেতে পারে এই গণ-অভ্যুত্থানই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের বীজ। গণ-অভ্যুত্থানের প্রারম্ভে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আহুত ছাত্র-আন্দোলনের ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। ছাত্রদের এই আন্দোলনই পরবর্তীকালে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এই সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন বদিউল আলম। 

রাজপথে ছাত্রদের এই আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। দুর্দান্ত সাহসের অধিকারী বদি পুলিশের সাথে রাস্তার এই সংঘর্ষে নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় থাকতেন। আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে গিয়ে তিনি মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালের ছাত্র আন্দোলনে বদিউল আলমের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার চূড়ান্ত প্রতিফলন ঘটে মুক্তিযুদ্ধে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভেই কিশোরগঞ্জে অবস্থানরত সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে ৩ এপ্রিল প্রথম গেরিলাদলের তিনজন সদস্য বদিউল আলম, শহীদুল্লাহ খান এবং আশফাকুস সামাদ ঢাকা প্রবেশ করেন। শুধুঢাকা শহরেই নয়, দীর্ঘ সময় বদিউল আলমের সদর্প বিচরণ ছিল তাঁর নিজ এলাকা কিশোরগঞ্জেও। নিকট-আত্মীয় ও স্থানীয় কিছুতরুণদের সমন্বয়ে গঠিত মুক্তিবাহিনীর দল বদিউল আলমের নেতৃত্বে রাজাকার ও শান্তিকমিটির সদস্যদের শায়েস্তা করে। এ সময় অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে বদি ঢাকা-কিশোরগঞ্জ চলাচল করতেন।


ভারত থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ ছাড়াই বদি একাধিক দুঃসাহসিক গেরিলা অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন যা উচ্চ-প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে রীতিমতো আতংকের সৃষ্টি করেছিল। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল ৮ আগস্টের ফার্মগেট অপারেশন এবং ২৫ আগস্টের ধানমন্ডি অপারেশন। এছাড়া ১৯ আগস্ট সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন রেকি করার সময় নৌকা ভর্তি পাকসেনাদের মুখোমুখি হয়ে পড়লে বদিউল আলমের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের কারণে অন্যান্য গেরিলাদের জীবন রক্ষা পায় এবং বেশকিছুসংখ্যক পাকিস্তানি ক্সসন্য হতাহত হয়। আগস্ট মাসে ক্র্যাক প্লাটুনের একের পর এক দুঃসাহসিক এবং সফল অভিযান টিক্কা খানের সামরিক শাসনের ভিতে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল।

১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল প্রফেসর জালালউদ্দিন সাহেবের ছেলে ফরিদ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক কলংকজনক অধ্যায়ের সূচনা করে। এদিন জালালউদ্দিন সাহেবের বাসায় ফরিদ ও অন্য বন্ধুদের সাথে তাস খেলছিলেন বদিউল আলম। চরম বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দিয়ে ইতিহাসের এই ঘৃণিত চরিত্র ফরিদ কয়েকজন পাকিস্তানি ক্সসন্য নিয়ে এসে ধরিয়ে দেয় বদিউল আলমকে। এই ঘটনার ধারাবাহিকতায় ২৯-৩১ আগস্টের মধ্যে হানাদারবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন আরো বেশ কিছুসংখ্যক গেরিলা যোদ্ধা। এঁদের অধিকাংশই অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে শাহাদত বরণ করেন যার মাঝে বদিও ছিলেন।

মায়ের স্মৃতিচারণ দিয়েই শেষ করছিওপরের কথা গুলো ছিল শিশু বদিকে নিয়ে তাঁর মা রওশন আরা খানম এবং দাদির ভাবনার বহিঃপ্রকাশ। দাদি চলে গেছেন অনেক

আগেই কিন্ত মা ছিলেন, মা জেনে গিয়েছিলেন কতোটা শক্ত, দৃঢ়চেতা এবং দুঃসাহসী হয়েছিলেন তাঁর সেদিনের সেই শিশুপুত্র। ১৯৭১ সালে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে তাঁর প্রাণপ্রিয় সন্তান দেশকে এনে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা। এমন এক ঋণে আমাদের তিনি আবদ্ধ করে গেছেন যা কখনো পরিশোধ হওয়ার নয়।

আজ ২৬ জুন, ২০২২-বাঙালি জাতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে স্মরণ করছে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে তাঁর ৭৪ তম

জন্মবার্ষিকীতে। 


শেয়ার করুন