০১ মে ২০১২, বুধবার, ০৭:৪৪:৩১ অপরাহ্ন


অর্থনৈতিক চরম সংকট
রাশিয়া-চীন থেকে সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট গ্রহণ সরকারের
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৪-২০২৪
রাশিয়া-চীন থেকে সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট গ্রহণ সরকারের অর্থনৈতিক সূচক


কঠিন সময়ে বাংলাদেশ অর্থনীতির অব্যাহত রক্তক্ষরণ অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিতে গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। দেশের মিডিয়ায় খবর ২০ মাস যাবৎ উচ্চমূল্য স্ফীতিতে বাংলাদেশ, প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ রাশিয়া-চীন থেকে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট গ্রহণ করছে। এমনিতেই বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা। কোনোভাবে কোভিড প্রতিক্রিয়া এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট সংকট সামলানো বাংলাদেশ এখন দ্রব্যমূল্যের অব্যাহত ঊর্র্ধ্বগতি সামাল দিতে বেসামাল। ভ্রান্ত নীতির কারণে নিজেদের মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ মাটির নিজে ফেলে রেখে বিশ্ববাজর থেকে জ্বালানি আমদানির কৌশল নিয়ে গভীর জ্বালানি সংকটে বাংলাদেশ। জ্বালানি আমদানির ডলার সংস্থানে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। এর মাঝে দায় বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের জন্য গৃহীত বৈদেশিক ঋণের সুদসহ আসল পরিশোধ। এমন সময় অব্যাহত উঁচু মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়া গভীর উদ্বেগের কারণ। সরকারি দল কৌশলে বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনের বাইরে রেখে অনেকটা একচেটিয়াভাবে নির্বাচন করে ধারবাহিকভাবে চতুর্থবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে। জানিনা সরকারের উচ্চ শিক্ষিত উপদেষ্টারা অর্থনীতির সংকটের গভীর ক্ষত এবং ব্যাপ্তি বিষয়ে সরকার প্রধানকে সঠিক দিক নিদের্শনা দিচ্ছেন কিনা? অর্থনৈতিক পরিস্থিতির এহেন অবস্থায় রাশিয়া-চীন থেকে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট গ্রহণ কতটা সময় উপযোগী সেই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আসুন বিষয়গুলো একটু গভীরভাবে তলিয়ে দেখি। 

২০ মাস যাবৎ উঁচু মুদ্রাস্ফীতি 

একটি প্রতিবেদনের সূত্র ধরে মিডিয়া রিপোর্ট থেকে অবগত হওয়া গেছে যে, বিগত অর্থ বছরের পুরো সময় জুড়ে এবং চলতি অর্থ বছরের প্রথম আট মাস সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ এর অধিক রয়েছে। প্রতিক্রিয়ায় দ্রব্য মূল্যের উর্ধগতি নিম্ন আয়ের মানুষ কথাই নেই, মধ্যম আয়ের মানুষ তথা সীমিত আয়ের মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা সৃষ্টি করেছে। দেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদদের মতে বাংলাদেশে বিগত ৩০ বছরে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি এত দীর্ঘ সময় স্থায়ী হয়নি। কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদের মতে সরকার পরিস্থিতি আমলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহণে অনেক বিলম্ব করে ফেলেছে। 

ইতিহাস থেকে প্রতীয়মান, নব্বইয়ের দশকে বেসরকারি খাতের উত্থানের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতির বিকাশ শুরু হয়। ওই দশকে কখনো কখনো মূল্যস্ফীতি বাড়লেও তা খুব বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। এক বছর বাড়লেও পরের বছরই তা কমে গেছে। ওই দশকে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর সর্বনিম্ন ছিল ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে ২ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এর পরের দশকের শুরুতে ২০০০-০১ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ছিল ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ। ওই দশকে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

এরপর গত দশকে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি দেখা গেছে ২০১১-১২ অর্থবছরে, যার হার ছিল ১০ দশমিক ৬২ শতাংশ। আর সর্বনিম্ন ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ ছিল ২০১৬-১৭ অর্থবছরে। চলতি দশকের প্রথম দুই অর্থবছর ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ৫৬ ও ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরেই তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির ওই ধারা অব্যাহত আছে এখনো। 

খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদদের মতে ‘আমাদের সরবরাহ ব্যবস্থা ও বাজার শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে সমস্যা রয়ে গেছে। এ কারণে অনেক সময় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না, যার ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। তাছাড়া সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি থাকা সত্ত্বেও ভর্তুকির বিপরীতে বিশেষ বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে এসএলআর হিসেবে এ বন্ড ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে ব্যাংক খাতে তারল্যের জোগান বাড়বে। এটি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির বিপরীতে যাচ্ছে। এতে মুদ্রানীতি সঠিকভাবে কাজ করবে না। আরেকটি দিক হচ্ছে আগে বাজারে ডলার সরবরাহ করে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা উঠিয়ে নিত। কিন্তু বর্তমানে এটা কিছুটা শর্তযুক্ত। ব্যাংককে টাকা দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার নিচ্ছে। এতেও তারল্য সরবরাহ বাড়ছে। 

সরকারসংশ্লিষ্ট মহল বর্তমান সংকটের জন্য মূলত বৈষয়িক অবস্থাকে দায়ী করে থাকে। সন্দেহ নেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ (প্রকারান্তরে দুই পরাশক্তির ছায়াযুদ্ধ) বৈশ্বিক জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা ও ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। ওই সময় প্রায় একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও বিশ্বের অন্যান্য দেশেও মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করে। এরপর ২০২২ সালেই বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমতে শুরু করে। যদিও বাংলাদেশের বাজারে এর তেমন কোনো প্রভাব দেখা যায়নি। এক পর্যায়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসা শুরু হলেও ভিন্নচিত্র বাংলাদেশে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এই সময়ে উঁচু মূল্যস্ফীতির কবলে পড়েছিল। কিন্তু নানা কার্যক্রম গ্রহণ করে ওরা পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি ২০২২ সেপ্টেম্বরে ৬৭.৫ শতাংশ উন্নীত হয়েছিল। সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ২০২৩ ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ৫.৯ শতাংশ নেমে এসেছে। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বের যেসব দেশেই মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে তারা সেটি নিয়ন্ত্রণে ত্বরিৎ পদক্ষেপ নিয়েছে। আগ্রাসীভাবে সুদহার সমন্বয়ের মাধ্যমে রাশ টানা হয়েছে তারল্যের সরবরাহে। এর ধারাবাহিকতায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে দেশগুলো। কিন্তু বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বজায় থাকলেও সুদহার সমন্বয়ের ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হয়েছিল মুদ্রার বিনিময় হারও। এক পর্যায়ে সুদহার ও বিনিময় হার সমন্বয়ের উদ্যোগ নেওয়া হলে দেখা যায় এসব উদ্যোগ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। বিলম্বিত পদক্ষেপ উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পেরেছে সামান্যই। এর মধ্যে রমজানকে কেন্দ্র করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দিতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। 

শুধু কঠোর ও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতিকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর সঙ্গে সঙ্গে ডলারের সরবরাহ বৃদ্ধি ও বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে বলেও মনে করছেন তারা। 

বিদেশি ঋণ ১০০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাওয়া 

পত্রিকার খবরে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ অব্যাহতভাবে কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে বিদেশি ঋণের পরিমাণ প্রথমবারের মতো ১০০ বিলিয়ন দলের ছাড়িয়েছে। ডিসেম্বর ২০২৩ সরকারি এবং বেসরকারি খাতে বিভিন্ন সূত্রে গৃহীত ঋণের সমন্বিত পরিমাণ ১০০.৬৪ বিলিয়ন (১০ হাজার ৬৪ কোটি ডলার)। বিনিময় হার ডলার প্রতি ১১০ টাকা ধরা হলে এই পরিমাণ ১১ লাখ ৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা। দেশের মোট বিদেশি ঋণের ৭৯ শতাংশই নিয়েছে সরকার। বাকি ২১ শতাংশ ঋণ নিয়েছে বেসরকারি খাত। আর ১৫ বছর আগে ২০০৮ সাল শেষে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। অর্থাৎ গত ১৫ বছরে দেশের বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৭৭.৮৫ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৩৪২ শতাংশ। 

সবাই জানেন, দায়িত্বশীল সরকার নিজেদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা অনুযায়ী ঋণ গ্রহণ করে থাকে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে যে পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করেছে সেটি সময় মত সুদসহ পরিশোধ সামর্থের সীমানায় পৌঁছেছে। 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন চলতি বছর থেকে অনেক মেগা প্রকল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হচ্ছে। এতে ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়বে। এমনিতেই দেশে ডলারের তীব্র সংকট চলছে। বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ায় আরো বেশি পরিমাণে ডলারের প্রয়োজন হবে। তবে সেই অনুযায়ী রেমিট্যান্স, রফতানি আয়সহ দেশের ডলার সংস্থান বাড়ানো যাচ্ছে না। বিপরীতে দেশের রিজার্ভ ক্রমাগত কমছে। এমন প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার চীন ও রাশিয়া থেকে সাপ্লাইয়ার ক্রেডিট নিচ্ছে। তবে সেটা এখনই বন্ধ করতে হবে মনে করেন তারা। 

দেশটা আমাদের 

দেশটা আমাদের সবার। অনেকের সঙ্গেই মতের মিল নেই এবং সেটিই স্বাভাবিক। আমরা কেউ চাই না কোনো সরকারের ভ্রান্ত উচ্চবিলাসী কার্যক্রমের কারণে জাতি দীর্ঘস্থায়ী সংকটে উপনীত হোক। এখনো সময় আছে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করে রফতানিমুখী শিল্পগুলোতে গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করে ডলার উপার্জন বাড়ানো, প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্স বৈধপথে বাংলাদেশে নেওয়া। সর্বপ্রকার কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে সরকারি ব্যয় সংকোচন। সরকারের উচিত সর্বক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ। সরকারি কাজে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ প্রয়োজন। 

শ্রীলঙ্কা যদি পারে স্বল্পতম সময়ে কঠিন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে, কেন পারবে না বাংলাদেশ। প্রয়োজন সরকারের মানসিকতা পরিবর্তন এবং দেশে আইনের শাসন শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিতে হবে। সর্বস্তর থেকে লুটেরা সিন্ডিকেট ধ্বংস করে দিতে হবে।

শেয়ার করুন