০৬ মে ২০১২, সোমবার, ০৮:২৯:০৫ পূর্বাহ্ন


বিএনপিকে মাঠে ফেরাচ্ছে আওয়ামী লীগ
মাসউদুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৪-০৪-২০২৪
বিএনপিকে মাঠে ফেরাচ্ছে আওয়ামী লীগ


দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিয়ে নিজেদের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কাছে যখন প্রশ্নবানে জর্জরিত বিএনপি, ঠিক সে সময় ত্রাণকর্তার ভূমিকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। একের পর এক প্রশ্ন ও বিতর্কিত সব তীর্যক মন্তব্য করে বিএনপির তৃণমূলে কঠিন জবাবদিহিতা থেকে উত্তরণ ঘটালেন তারা। বিএনপি এ মুহূর্তে তৃণমূলের ওইসব প্রশ্নের জবাব বা কৈফিয়ত দেওয়ার ওই ধারামুক্ত। এবার তারা কষছেন নতুন হিসাব। আন্দোলনের নতুন ধারা এবং সেটাতে তৃণমূলের কর্মীদের কীভাবে সম্পৃক্ত করা যায় সে চিন্তাধারায়। 

যেভাবে ত্রাণকর্তার ভূমিকায় আওয়ামী লীগ

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন যে যথার্থভাবে সম্পাদিত হবে এটা খোদ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের কিছু সংখ্যক নীতিনির্ধারক ছাড়া আর কেউ বিশ্বাস করতেন না। সবার চোখে মুখে ছিল হতাশা! যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্র রাজনৈতিক গেমটা মঞ্চস্থ করেছেন, তাতে কারোই বোঝার উপায়ও ছিল না। বিএনপিরও বদ্ধমূল ধারণা নির্বাচন হচ্ছে না। ফলে কিছুটা ফুরফুরে মেজাজেই ছিলেন তারা শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব অনেকে এ বিষয়াদি জানলেও প্রকাশ করার সাহস পায়নি। যারা টের পেয়েছেন, তাদের কেউ কেউ দলছুট হওয়ার চেষ্টা করেছেন। কেউ সফল কেউ ব্যর্থ। শাহাজাহান ওমর তাদের একজন। আরেক সফল কল্যাণ পার্টির তথা, বিএনপির মাঠের আন্দোলনের সহযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব.) ইব্রাহীম। 

বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব অন্যদের মনভাব বুঝতে পেরে কাউকে কাউকে বহিষ্কার, আবার কাউকে কঠোর নজরদারি ও বুঝিয়ে ছুটতে দেয়নি।

এভাবেই কেটে যায় সময়। অনুষ্ঠিত হয়ে যায় একতরফা ডামি নির্বাচন। ঠিকঠাক মতো সবকিছু হতে থাকে। বিএনপি ও বিরোধী পক্ষের যারা, তারা শুধু বিস্ময়ভরে দেখেছেন প্রতিটা মুহূর্ত। অবশ্য শীর্ষ পর্যায়ের অনেকে জেলেও ছিলেন। যারা বাইরে ছিলেন তারা দিয়েছিলেন গা ঢাকা। হাতেগোনা দু-তিনজন ছাড়া কাউকেই খুঁজেও পাওয়া যায়নি।

এ পরিস্থিতিটা বেশ কঠিন গেছে দলটির। তৃণমূলকে সঠিক বুঝ দেওয়ার মতো তেমন কেউ ভূমিকা রাখতে পারেনি। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, ওই মুহূর্তে লন্ডন থেকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ওভার টেলিফোন ও বিভিন্নভাবে পরিস্থিতি বুঝিয়ে অনেক নেতাকর্মীর মনোবল অটুট রাখার কাজ করেছেন।

নির্বাচনের পর সবকিছু ঠিকঠাক করার পর ধীরেসুস্থে বিএনপির নেতাকর্মীদের কারামুক্তি শুরু হয়। বিএনপি তখন এদের বরণ নিয়েই ব্যস্ত। এরপর শুরু রমজান। এ সময় ইফতার মাহফিল করে করে দেশের প্রায় প্রতিটা স্থানে নেতাকর্মীরা একত্রিত হওয়া, কারামুক্তদের ফুলের শুভেচ্ছা জানানোর মাধ্যমে দলে কিছুটা প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে। 

কিন্তু এরপরও একটা দুশ্চিন্তাভাব বিএনপিতে বিদ্যমানই ছিল। কারণ রমজানের পর কী হবে আন্দোলনে ধরন। সেটা নেতাকর্মীরা কতটুকু সক্রিয় থাকবেন, আদৌ বিষয়টা কীভাবে নেবে। ভবিষ্যৎ কর্মপরিক্রমা কী হলে ভালো। ভূ-রাজনীতিটা কী। বন্ধুপ্রতিম যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্রদের এখন মনোভাব, প্রতিবেশী ভারতকে রাজি করানো প্রয়োজন না বিরোধিতা, আন্দোলনে শরিক দলসমূহকে কীভাবে আবার ধরে রাখা যাবে-এমন নানা দুশ্চিন্তা যখন দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের ঘুম হারাম হওয়ার উপক্রম, ঠিক সে মুহূর্তে ত্রাণকর্তা পুরোনো শত্রু বা বন্ধু আওয়ামী লীগ! 

বিএনপিকে লক্ষ্য করে একের পর এক মন্তব্য, যা দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগেই শুধু নয়, দুই দলের ঐতিহ্যগত বিতর্ক, বিভিন্ন রাজনৈতিক বক্তব্যে বিএনপি নেতারা কথা বলার ইস্যু হাতে পেয়ে যায়। কর্মীদের প্রশ্নের জবাবের চেয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্যের জবাবটাই তখন মুখ্য হয়ে ওঠে রাজনীতিতে। এটা এখন ব্যাপকভাবেই চলছে। বিএনপির তৃণমূল কেন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি সে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে এবার আওয়ামী লীগের পলিটিক্সে মনোযোগী হয়ে আবার পুরোনো ক্ষোভ সঞ্চার শুরু করেছেন। এতে করে বিএনপি নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগের বন্ধু নেতৃত্ব অনেককে ধন্যবাদ দিতেই পারে।

নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার প্রশ্নটা কী বিলীন?

বিএনপির তৃণমূলের ধারণা এবার নির্বাচনে অংশ নিলে অন্তত ৬০ থেকে ৭০টার মতো সিট বিএনপি পেলেও পেতে পারতো। যদিও সঠিক নির্বাচন হওয়ার সুযোগ নেই, তবু বিএনপি বিভিন্ন কারণে ওই সিটগুলো পেলে সংসদে বিএনপির একটি অবস্থান তৈরি হতো। তৃণমূলে যে মার খাচ্ছে নেতাকর্মীরা, তারাও কিছুটা হয়তো রিলিফ পেয়ে দলটি এগিয়ে যেতে পারতো। তাছাড়া তো কোনো শক্তিই কাজে আসছে না। কিন্তু কেউ কেউ আবার মনে করছেন যে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে হাতেগোনা ১০ বা ১২ সিট ধরিয়ে দিয়ে প্রমাণ করানোর চেষ্টা হতো বিএনপির জনপ্রিয়তা কতটা হ্রাস পেয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নমুখী রাজনীতির সামনে। বরং নির্বাচনে অংশ না নেয়াই সঠিক কৌশল। এতে ক্ষমতাসীনদের ওপর একটা চাপ অব্যাহত থাকলো। এ বিতর্কটা বেশ জমজমাট তৃণমূলে। 

তাছাড়া বিএনপির প্রধান যে দাবি, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন বা দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনেই অংশ নেবে না দলটি, সেটা বহাল রেখে জনগণকে বলতে পারবে মাথা উঁচু করে বিএনপি গণতন্ত্রের স্বার্থে ত্যাগ তিতিক্ষা করে যাবে। 

উপজেলা নির্বাচনে কঠোর হওয়ার ভূমিকা

শেষের চিন্তাভাবনা থেকেই বিএনপি তাদের পুরোনো সিদ্ধান্তে অটল। উপজেলায় অংশ নিলে সেই নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ ও সরকারের সব সিদ্ধান্ত সঠিক এটাই মেনে নেওয়া হলো। যা প্রকারান্তরে জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি নাটক করেছিল বলেই প্রমাণিত হয়ে যেতো। ওই চিন্তাধারায় বিএনপি উপজেলা থেকে সরিয়ে রেখেছে। শুধু তাই নয়, উপজেলায় দলের কেউ অংশ নিলে আজীবন বহিষ্কারের হুমকি দিয়ে নিজেদের কঠোরতার প্রমাণ দিয়েছে। 

আওয়ামী লীগ কেন ত্রাণকর্তার ভূমিকা নিলো 

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি মস্ত বড় ভুল করেছে, এটা বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা অনুধাবন করছে। এ বিশ্লেষণ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছায়। তখন তারা ভেবেছিল, বিএনপিকে রাজনৈতিক মাঠে ফিরিয়ে আনতে হলে তাদের চাঙ্গা করতে হবে এবং পেছনের ভুল বুঝতে পেরে উপজেলা নির্বাচনে চলে আসবে দলটি। এতে একের পর এক বিষোদ্গার শুরু। অথচ টানা চারবার সরকার গঠনের ঠিক পর মুহূর্তে বিএনপিকে এতাটা গুরুত্ব ভাবার কোনো অর্থ আছে আওয়ামী লীগের সেটা তো মনে হয় না। এক হিসাবে বিএনপিকে একেবারে পাত্তা দেওয়ারই কথাটা আওয়ামী লীগের! একই সঙ্গে দেশে বিরাজমান নানা সংকট, যেমনটা নিত্যপ্রয়োজনীয় মূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্র্ধ্বগতিসহ ডলার সংকট, দৈন্যদশা থেকে মুক্ত হতে কয়েকটি ব্যাংককে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণ নানা ইস্যু বিদ্যমান। এগুলো পাশ কাটিয়ে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে রাখতে বিএনপির বিরুদ্ধে বিষোদগারের অন্যতম উত্তম পন্থা। বিএনপিও যাতে এতে যোগ দিয়ে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত করে ফেলে অন্তত কথার যুদ্ধে। 

এটা একটা চিন্তা হতে পারে আরেকটিও। সেটা হলো বিএনপি যদি উপজেলায় অংশ নেয়। যেহেতু তৃণমূলের একটা চাপ রয়েছে, তাই বিএনপি উপজেলাতে অংশ নিলে নিতেও পারে। তাহলে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন এককভাবে হওয়ার যে দুর্নাম সেটা আড়ালে পড়ে যাবে-এমনকি বিএনপির নির্বাচনকেন্দ্রিক বিভিন্ন দাবিদাওয়াও। কিন্তু বিএনপি সেটাতে যায়নি। এতে করে আওয়ামী লীগের পলিসির কিছুটা অসফল হলেও সার্বিকভাবে লাভবান আওয়ামী লীগ সরকার। কারণ একটি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচন দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলকে পাশ কাটিয়ে করে ফেলে সরকার গঠন করে আবার মাঠে তাদের সঙ্গে পুরোনো রাজনীতিতে মত্ত হয়ে প্রমাণ দেওয়া পেছনে যা হয়েছে ওগুলো দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন যথার্থই ছিল। এদিক থেকে রাজনীতির খেলায় আওয়ামী লীগ বরং দারুণ সফল। এর সঙ্গে বহির্বিশ্বের নানা পলিটিক্স তো আছেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসবই সুচারুভাবে হ্যান্ডেল করেই চলেছেন দক্ষ হাতে। বিদেশি বন্ধুদের যথার্থ মেইনটেন করাটাও রাজনৈতিক বড় কৌশল। আওয়ামী লীগ তাতেও সফলতা দেখিয়েছে ও দেখাচ্ছে। 

বিএনপি কী করবে

জাতীয় নির্বাচন কী ঘটেছে সেটা আর নতুন করে বলার নেই। পরাশক্তিদের স্বার্থের কাছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকারটুকু তুচ্ছ হয়ে গেছে। এটা গণতন্ত্রের ভাষায় কে কী ব্যাখ্যা দেবে তারা বিশ্লেষকরা ভাল বলবেন। 

এমন প্রেক্ষাপটে বিএনপির কী করার আছে সেটা তাৎক্ষণিক ব্যালেন্স মেলানো বেশ কঠিন। অনেকটাই খাদে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা দলটির। এখান থেকে উত্তরণই শুধু নয়, বিএনপিকে সঠিক স্বপ্ন দেখানোই এখন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ। মানুষ স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। সব কাজেরই একটা সফলতার হিসাব কষে মানুষ এগিয়ে যায়। বিএনপির আন্দোলন, রাজনীতির গতিপথের ভবিষ্যৎ কী? কঠিন এক প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে দলটি। 

যদিও সেই পুরোনো প্রবাদ, ‘রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই’। যে কোনো মুহূর্তে পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসতে পারে-যেমনটা প্রতিনিয়ত ঘটছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে। নতুবা ইউক্রেনকে শুধু শুধু মাঠে নামিয়ে চরমভাবে মার খাইয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্রের সটকে যাওয়া কেন? ইসরাইল ইরানের উত্তেজনাতেও অনেক পরিসংখ্যান লক্ষণীয়। বিএনপি এসব দৈবিক কোনো ‘টার্ন’-এর দিকে অপেক্ষা করছে হয়তো! সেটা হতে পারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঠিক চিন্তাধারায় মনোনিবেশ এবং সব দলকে নিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করে সঠিক ধারার রাজনীতি ও ভোটের অধিকার মানুষের হাতে ছেড়ে দেওয়া ইত্যাদি। রাজনীতিতে উত্থান পতন থাকে। আজ সবাই যা চিন্তা করছে, কাল সে চিন্তাধারায় আসতে পারে পরিবর্তনও। বিএনপি হয়তো এসব ভেবেই নিজেদের গতিপথ নির্ণয় করবে। 

ইতিমধ্যে যার প্রমাণও কিছুটা মিলেছে। কেননা জাতীয় নির্বাচনের মতো উপজেলাতেও মানুষকে সতর্ক করতে ‘লিফলেট’ বিতরণ কর্মসূচি করবে। অহিংস আন্দোলনের ধারাতেই থাকবে। 

সবশেষ

বাংলাদেশের মানুষ এ মুহূর্তে রাজনীতির চেয়ে নিজেদের নিত্যপ্রয়োজনীয় বিষয়ের চিন্তাভাবনায় বেশিই ব্যস্ত। রাজধানীর বাইরে বিদ্যুৎ সংকট চরমে। বিভিন্ন শিল্প-কলকারখানায় প্রোডাকশন সঠিক ধারায় রাখতে হা-হুতাশ। প্রচণ্ড খরতাপে পুড়ছে বাংলাদেশ, যা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। ডলার সংকটের প্রভাব সংসার জীবনেও। কারণ প্রতিটি জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি, যাতে জমানো অর্থ অল্প অল্প করে শেষ! শহর ছেড়ে মধ্যবিত্তের অনেকে গ্রামের সহায়-সম্পদের খোঁজে ছুটছেন। এতে সবের মধ্যে রাজনীতির চিন্তা আপাতত মাথায় নিচ্ছেন না তারা!

শেয়ার করুন