২৫ এপ্রিল ২০১২, বৃহস্পতিবার, ১১:৪২:৫৬ অপরাহ্ন


মেগাপ্রকল্পগুলো বাংলাদেশকে পাল্টে দেবে
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০১-০৬-২০২২
মেগাপ্রকল্পগুলো বাংলাদেশকে পাল্টে দেবে


মেগাপ্রকল্প গ্রহণ, বাস্তবায়নে বন্ধুর পথ পেরিয়ে বাংলাদেশ আলোর পথে এগিয়ে চলেছে। জানাইআছে এই পথে পাহাড়সম বাধা-বিঘ্ন আছে। আছে কাঁটাবিছানো মরুপথের চ্যালেঞ্জ। কিছু মেগাপ্রকল্প শেষ হবার পথে, কিছু আছে অগ্রগতির তুঙ্গে। প্রতিটি প্রকল্পের উপযোগিতা আছে। কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়েছে, ভূ-রাজনীতির কারণে কিছু প্রকল্পের বাস্তবায়ন খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু সার্বিকভাবে সবক’টির শুভ প্রভাব ২০৩০ নাগাদ বাংলাদেশ উপভোগ করবে।

ভূমি অধিগ্রহণ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ভূ-রাজনীতির বিবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশের মেগা অবকাঠামো প্রকল্পগুলো একে একে সমাপ্তির দিকে এগিয়ে চলেছে। পটুয়াখালীর পায়রায় ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়ে গেছে। ডিসেম্বর ২০২২ নাগাদ পূর্ণমাত্রায় উৎপাদিতবিদ্যুৎ জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডে সংযোজিত হবে। পদ্মা বহুমুখী সেতু (২৫ জুন ২০২২), কর্ণফুলী নদী তলদেশের টানেল (২০২২), ঢাকা মেট্রোরেল প্রথম পর্যায় (২০২২), রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র (২০২৩), হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল (২০২৩), এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রথম পর্যায় (২০২৩), রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রথম ইউনিট(২০২৪), মাতারবাড়ি  বিদ্যুৎকেন্দ্র (২০২৫), রূপপুর আণবিক  বিদ্যুৎকেন্দ্র দ্বিতীয় ইউনিট২০২৫ নাগাদ চালু হলে বাংলাদেশের দৃশ্যপটপাল্টে যাবে। 

ঢাকা-চট্টগ্রাম উন্নত রেল যোগাযোগ, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আধুনিক রেল যোগাযোগ, আইকনিক কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর টার্মিনাল সম্প্রসারণ, মাতারবাড়ি-মহেশখালী বিদ্যুৎ-জ্বালানি হাব, বঙ্গবন্ধু যমুনা রেলসেতু, ১০১টি বিশেষায়িত শিল্পাঞ্চল যোগ হবে পর্যায়ক্রমে ২০৩০ নাগাদ। প্রকল্পগুলো শেষ হলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উন্নয়নের মিলন মোহনায় পরিণত হবে। 

বাংলাদেশের তথা, বিশ্বের বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এতোগুলো মহাপ্রকল্প গ্রহণ এবং সফল বাস্তবায়নের সাহসী উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দেশপ্রেম এবং সাহসের প্রশংসা করতেই হয়। কিন্তু বুঝে হোক, না বুঝে হোক কিছু সমালোচনাকারী প্রকল্পগুলোর বিস্তারিত কারিগরি এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ না করেই নানাধরনের মন্তব্য করে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করছেন। আমি সরকারের তোষামোদ করছি না। একজন আন্তর্জাতিক পরামর্শক এবং ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির দর্শক হিসেবে বাস্তবতার নিরিখে বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করছি।

জনগণকে শতভাগ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা

দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা বাংলাদেশের জন্য অন্যতম প্রধান অর্জন। দুনিয়ার অনেক দেশের কথা ভুলে যান, প্রতিবেশী ভারত বা পাকিস্তান পারেনি এই লক্ষ্য অর্জন করতে। জানি, কিছু কিছু মানুষ বলবেন এখনো মানসম্মত বিদ্যুৎ সার্বক্ষণিকভাবে সুলভ মূল্যে সবাইকে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এদেরই কারো কারো কারণে দেশের নিজস্ব জ্বালানি সম্পদ কয়লা অ্যান্ড গ্যাস উত্তোলন বাধাগ্রস্ত হয়ে আছে। জ্বালানি সরবরাহ সংকট, করোনা বাধা, ইউক্রেনে যুদ্ধের বাধা কাটিয়ে বাংলাদেশ ২০৩০ এসডিজি ৭ লক্ষ্য অর্জন করবে দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায়। ঘরে ঘরে বিদ্যুতের এল জল বাংলাদেশ জেগে উঠবে উন্নয়নের মহীসোপানে।


ঢাকা মেট্রোরেল/ছবি সংগৃহীত  


প্রাণের সঞ্চার করবে পদ্মা বহুমুখী সেতু অবহেলিত দক্ষিণ বাংলায়

নিন্দুকেরা স্বীকার করবেন, পদ্মাসেতু ঘিরে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক গভীর ষড়যন্ত্র অতিক্রম করে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে সেতুর বাস্তবায়ন দক্ষিণ বাংলার উন্নয়নের বাতায়ন খুলে দিবে। আমি সেতুর বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে আমার প্রিয় শিক্ষক প্রয়াত ডক্টর জামিলুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ করে অনেক কিছু জেনেছি। এমনকি মহোদয়ের অকাল প্রয়াণের একদিন আগেও জুম আলাপ হয়েছে। মহোদয় বলেছিলেন, মিসিসিপি নদীর পর পদ্মা নদীতে বর্ষা মৌসুমে সবচেয়ে বেশি পানি প্রবাহিত হয়। নদীতলদেশের মাটি অনন্য। এই নদীর ওপর নির্মিত সেতুর ডিজাইনে বিশ্ব বিরল নির্মাণ কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে। হয়তো বাস্তবায়ন কালে কিছু সমস্যা হয়েছে। কিন্তু এতো বিশাল প্রকল্প করোনা বাধা পেরিয়ে সফল বাস্তবায়ন বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিশ্বসভায় অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে। সেতু বরাবর গ্যাসলাইন, রেললাইন, ফাইবার অপটিক্স ক্যাবল, সেতু সমান্তরালে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন বাংলাদেশের শস্যভাণ্ডার দক্ষিণ বাংলাকে, পায়রা, মংলা সমুদ্রবন্দরকে প্রাণবন্ত করে তুলবে।

 ইতিমধ্যে উক্ত অঞ্চলে ব্যাপক শিল্প উন্নয়নের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। সেতুর খরচ এবং টোল বিষয়ে যারা বিরূপ মন্তব্য করছেন তারা না জেনে করছেন। সেতু চালু হতে দিন দেখবেন তিন থেকে পাঁচ বছর পর দেশের চেহারাইপাল্টে যাবে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের সাহসী অর্জন

পদ্মা নদীপারে ঈশ্বরদীর রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াটরাশিয়া সরকারের কারিগরি এবং আর্থিক সহায়তায় ভিভিআইএর ১২০০ টেকনোলজি-নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বাংলাদেশের অগ্রগতির আরেকটি ব্যতিক্রমধর্মী মাইলফলক হয়ে থাকবে।

কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত অঞ্চলেবঙ্গবন্ধুর অন্যতম উন্নয়ন দর্শন অনুযায়ী ২০২৫ নাগাদ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে আসলে সার্বক্ষণিক ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে প্রবাহিত হচ্ছে। আমি একই ধরনের অন্তত ১২টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিস্তারিত বিষয়াদি অনুসন্ধান করে দেখেছি রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সব নিয়ম নীতি মেনে অত্যাধুনিক কারিগরি মাননির্ভর হয়ে নির্মিত হচ্ছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের মেধাবী তরুণ-তরুণীরা যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে  বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার দক্ষতা অর্জন করছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে বিস্তারিত না জেনে, ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে, কারো কিছু লেখা সঙ্গত নয় বলে আমি মনে করি। ১৪ বিলিয়ন ডলার খরচের বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া বা নিরাপত্তা বিষয়ে অযাচিত মন্তব্য না করে বাংলাদেশিদের প্রকল্পটি নিয়ে গর্বিত হওয়া সমীচীন বলে মনে করি।

পদ্মা বহুমুখী সেতুর অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সার্বিক সুদূরপ্রসারি প্রভাব দৃশ্যমান হতে শুরু করবে ২০২৬-২৭ থেকে যখন সেতুবরাবর নির্মিত রেললাইন যশোর, বরিশাল,পটুয়াখালী পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন বিস্তৃত হবে দক্ষিণ বাংলায়। ইতিমধ্যেই শিল্পগোষ্ঠী, শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে।বাংলাদেশের শস্যভাণ্ডার দক্ষিণ বাংলা কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনের জন্য আদর্শ। সেই সঙ্গে মোংলা এবং পায়রা দুটি বন্দর দিয়ে রফতানিমুখী শিল্পগুলো বিকশিত হবে। ভারত, নেপাল, ভুটান বাংলাদেশের বন্দর সুবিধা ব্যবহার করতে পারবে। বরিশাল, খুলনা বিভাগ এবং বৃহত্তর ফরিদপুর অবহেলিত অঞ্চলের উন্নয়নের স্বর্ণ দুয়ার উন্মুক্ত করবে পদ্মা বহুমুখী সেতু। ২০২৬-২৭ নাগাদ ঢাকা রিং রোড চালু হলে দক্ষিণ বাংলার সঙ্গে উত্তর পূর্ব এবং দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের যোগাযোগ আরো সুগম হবে।

কর্ণফুলী যদি তলদেশের সুড়ঙ্গ সংযোগ

সাংহাই এ দেখেছি, দেখেছি হংকংয়ে। দেখেছি কীভাবে নদী তলদেশের সুড়ঙ্গ একটি অঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট সম্পূর্ণ পাল্টে দায়। কর্ণফুলী নদীতলদেশের সুড়ঙ্গপথ ২০২২ ডিসেম্বরনাগাদ চালু হলে পতেঙ্গা আনোয়ারা যুক্ত হবে যমজ উন্নয়নের সাথী হয়ে। সর্বোপরি চট্টগ্রামের সঙ্গে পর্যটননগরী কক্সবাজারের যোগাযোগ অনেক সুগম হবে। প্রকল্পের শুভ প্রভাব বিশাল পরিসরেঅনুভূত হতে শুরু করবে মিরেরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মিত হবার পর। আমরা জানি, কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ প্রান্তে কোরিয়ান ইপিজেডসহ কাফকো, সিইউএফএল রয়েছে। আরেকটি বোরো শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠছে। মহেশখালী থেকে গ্যাস পাইপলাইন আমদানি করা এলএনজি নিয়ে আসছে। গ্যাস, বিদ্যুতের সহজলভ্যতা এবং বন্দর সুবিধার কারণে রফতানি-নির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ার ব্যাপক সুযোগ উন্মুক্ত করবে সুড়ঙ্গপথটি। সর্বোপরি দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম তলদেশে সুড়ঙ্গপথের গর্বিত অধিকারী হবে বাংলাদেশ। তাই টাকার অঙ্কে বিনিয়োগ দেখে এই প্রকল্প বিষয়ে মন্তব্য করা সুবিবেচনা প্রসূত হবেনা।

আমি আশা করি, শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা না করে বাস্তবতার কঠিন জমিনে দাঁড়িয়ে দায়িত্বশীল মন্তব্য করবেন সবাই।


শেয়ার করুন