২৮ মার্চ ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৮:২০:১৪ অপরাহ্ন


কথার কথকতা
মাইন উদ্দিন আহমেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০২-০৪-২০২২
কথার কথকতা


একটা লেখা মৃত্যু সংবাদ দিয়ে শুরু হোক, এটা কেউ চায় না। হয়তো প্রশ্ন করবেন, কেন চায় না? এটা তো অবধারিত এবং এড়িয়ে যাবার মতো কোনো বিষয় নয়। তারপরও কোনো মানুষ মৃত্যু সংবাদ দিয়ে কিছু শুরু করতে চায় না। মারা যাওয়া কথাটি সহজভাবে কেউ নিতে পারে না বলে এটি প্রকাশের জন্য হরেক রকমের ভঙ্গি ও ভাষা ব্যবহার করে মানুষ। চলে যাওয়া, ইন্তেকাল করা, পরলোক গমন করা, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা, পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া, ঊর্ধ্বলোকে গমন, দেহত্যাগ করা, ইহলীলা সাঙ্গ হওয়াÑ আরো কতো রকম প্রকাশভঙ্গি মানুষ এই ঘটনাটিকে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করে! অবশ্যম্ভাবী জানার পরও বিষয়টি মানুষের খুব অপ্রিয়। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলে হয়তো উত্তর দেবে, না ভালো নেই, এ জীবন আর সহ্য হয় না। যদি বলা হয়, তাহলে চলে যান, মরে যান, তাহলে অস্থির হয়ে বলে উঠবে, না আমি যেতে চাই না। ইহধাম কিছুতেই মানুষ ত্যাগ করতে চায় না। আপনারা জানেন, পৃথিবীতে আসার সময় এবং পৃথিবী ছেড়ে যাবার সময়, এ দুটো সময়ের হিসাব কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জানেন না। এভাবেই সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ আসে আর যায়।

আহসান বললো- করিম আর নাই, ও চলে গেছে আজ দুপুরে। চল দেখে আসি। প্রশ্ন করলাম, চলে গেলে দেখে আসবি কি করে? সে-তো চলেই গেছে, তো দেখবি কাকে? আরে গাধা চল, ওদের বাসায় যাই। একটা উবার ট্যাক্সি ডেকে দুজনই রওয়ানা দিলো করিমদের বাসার দিকে।

ওদের বাসায় গিয়ে আমি দেখলাম, করিম শুয়ে আছে, নড়াচড়া করছে না! আহসানকে জিজ্ঞেস করলাম, ওই যে করিম শুয়ে আছে। তুই যে বললি, চলে গেছে? আহসান আমাকে একপাশে টেনে নিয়ে অনেকটা ফিসফিস করার মতো করে বললো, মৃত্যু নিয়ে ন্যাকামি করিস নাতো! করিম মরে গেছে, ওটা করিমের দেহ। এটা কবর দিয়ে দেবে যথারীতি, মাটির শরীর মাটিতে মিশে যাবে আর স্রষ্টার দেয়া প্রাণ স্রষ্টার কাছে চলে গেছে।

জানতে চাইলাম, মাটির শরীর মাটিতে মিশে যাবে আর যেটা প্রাণ তা স্রষ্টার সম্পদ, ওনার কাছে চলে গেছে, তাহলে করিম কই? একটা হলো মাটির শরীর আর একটা হলো বিদায় হওয়া রুহ বা প্রাণ, তাহলে করিম কই? সে যে পরিচয় দিতো ‘আমি করিম’ বলে, সেই ‘আমি’ কই?

আহসান এবার খুব বিরক্ত হলো, বললো- দেখ করিম চলে গেছে, আমারও খুব মন খারাপ, জানি তোরও মন খারাপ, আয় ওর প্রস্থান প্রক্রিয়ায় সবাইকে সহযোগিতা করি, ওর জন্য দোয়া করি।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। বুঝলাম, আহসান খুব মনোকষ্টে আছে। করিমের সাথে আর দেখা হবে না ভেবে আমারও মন বেশ খারাপ। কিন্তু আমার মাথা থেকে এ প্রশ্ন যাচ্ছেই না যে, দেহ মাটির তৈরি, প্রাণ স্রষ্টার দেয়া, এর মধ্যে ‘আমি’ নামক লোকটা কই, যে বলতো, ‘আমি করিম’?

করিমের দাফন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ওর আত্মীয়স্বজনকে সান্ত¡না দিয়ে বাসায় ফিরলাম। কিন্তু কিছুতেই একটা প্রশ্ন মাথা থেকে যাচ্ছিলো না যে, ‘আমি’ নামক সত্তাটি কোথায়? ‘আমি’ নামক ব্যক্তিটি কই?

নিরিবিলি এক জায়গায় বসলাম, মনে মনে নিজের মৃত্যুটাকে ভাববার চেষ্টা করলাম আর ‘আমি’ নামের ব্যক্তিটিকে খুঁজতে থাকলাম। খুঁজে না পেয়ে ইন্টারনেটে ঢুকলাম প্রাণের সন্ধানে। সৃষ্টির শুরু সম্পর্কে জানার জন্য অনুসন্ধান করে দেখলাম, সৃষ্টিকর্তা মাটি দিয়ে একটা মানুষ বানালেন এবং তার পাঁজরের হাড় দিয়ে এক নারী বানালেন আর তাদের দেহনিঃসৃত নির্যাস থেকে আরো মানুষ তৈরির প্রক্রিয়া চালু করে দিলেন। মাটি দিয়ে মানুষ বানিয়ে তার নাসারন্ধ্রে জীবন সঞ্চার করে দিলেন অর্থাৎ শ^াস চালু করলেন। আর পৃথিবীর মানুষ প্রত্যেকটি মডেল আলাদাভাবে চিহ্নিত করার জন্য একটা করে নাম দিতে শুরু করলো। নিজেকে সে পরিচয় দেয়, আমি অমুক। বস্তুত আমি বলতে কেউই নেই এবং এ কারণেই পার্থিব দুঃখকষ্ট থেকে মুক্তি লাভের জন্য সাধনা করে অহংমুক্ত হবার জন্য দার্শনিক ও বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ উপদেশ দিয়ে থাকেন।

স্রষ্টা শুনেছি মনের আনন্দে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্ট মানুষও আনন্দ লাভের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানব সৃষ্টির ধারাবাহিক প্রণালিতে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় নিজেকে নিয়োজিত করে। তার মনে হয়, সে হচ্ছে ‘আমি’ আসলে সে কিন্তু কিছুই নয়।

এরপরও আমি অনেক দিন অনেকভাবে বুঝবার চেষ্টা করেছি, উপলব্ধিতে আনতে চেয়েছি যে, ‘আমি মাইন উদ্দিন’ কই?

আজকের লেখাটি দীর্ঘ করে ‘আমি’ নামক সত্তাটি খুঁজে বের করার জন্য অনেক ভেবেছি। মানব ইতিহাসের পাতাগুলো চোখ খুলে এবং চোখ বন্ধ করে, দু’ভাবেই দেখার কসরৎ করলাম। কোথাও ‘আমি’ খুঁজে পেলাম না। অনুসন্ধানের সর্বশেষ প্রক্রিয়ায় নিরিবিলিত বসে ভাববার পরও দেখি কে যেন বলছে, ওরে বোকা, একটা সহজ-সরল বিষয়ের মধ্যে জটিলতা খুঁজছিস কেন? বিধাতা মাটি দিয়ে শিল্পীর মতো একটি মানবাকৃতি বানালেন এবং তাতে তাঁর ইচ্ছা সঞ্চারিত করে শ্বাসায়ন প্রক্রিয়ার সংযোগ ঘটালেন। মানুষের জ্ঞানের বাইরের একটা সময়ের পর ওই শ্বাস প্রণালি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্রষ্টার দফতরে চলে যাবে আর মাটির দেহ মাটিতে মিশে যাবে। সেই মাটিতে উৎপাদিত ফলফলাদি খেয়ে জীবিত মানুষ আপন দেহ নির্যাসে আরো মানুষ বানানোর প্রক্রিয়ায় কাজ করে যাবে। আর এ কাজটি সে এড়িয়ে যাবার শক্তি রাখে না। কারণ একটা মানুষ ‘আমি’ বলতে যাকে ভাবে, সে কিন্তু আসলেই ‘আমি’ শব্দে চিহ্নিত হবার মতো কেউ নয়। ‘আমি’ একটি ভুল শব্দ যেটি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়।

আবার চোখ বন্ধ করে বসলো মাইন উদ্দিন আহমেদ। সমাপ্তিটা বোঝবার চেষ্টা করলো। দেখা গেলো, স্রষ্টার ইচ্ছানির্ভর শ্বাসায়ন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলো, নিথর দেহ মাটিতে মিশে গেলো, ‘আমি’ নামক কাউকে পাওয়া গেলো না। কিন্তু রহস্যের বিষয় হলো এই যে, এই আমিবিহীন মানুষটির কর্মকাÐের জন্য আমাকেই নাকি জবাবদিহি করা হবে! ভেবেই পাচ্ছি না যে, এ অবস্থায় কি করা যায়?


শেয়ার করুন