০২ অক্টোবর ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ০৮:২৯:২১ অপরাহ্ন


মসজিদ-মন্দির, মাজার-আখাড়ায় হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ সরকার
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৪-০৯-২০২৫
মসজিদ-মন্দির, মাজার-আখাড়ায় হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ সরকার


মন্দির-মসজিদ, মাজার-আখাড়া ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। উপরন্তু মাত্রা বিবেচনায় অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে মাজার-দরগাহ, আখাড়া ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরর ওপর উগ্রবাদীদের সংঘবদ্ধ আক্রমণ বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে আক্রমণকারী মবকে “প্রেশার গ্রুপ” সাব্যস্ত করে সবধরনের নিপীড়নবাদী তৎপরতাকে বৈধতা দিয়ে চলেছে সরকার।

“মসজিদ, মন্দির, মাজার, আখাড়া ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় সম্প্রীতি যাত্রার ডাক এবং আসন্ন দুর্গাপূজায় ঝুঁকি পর্যালোচনা ও করণীয়” বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন, সংস্কৃতিকর্মী, লেখক-অ্যাক্টিভিস্ট ও পেশাজীবী নাগরিকরা।

গত ২০ সেপ্টেম্বর শনিবার সকাল ১১টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে নাগরিক নেতৃবৃন্দ বলেন, ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ছিল বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ। ধর্ম-জাতি-লিঙ্গ ও সংস্কৃতি-পরিচয় নির্বিশেষ মানুষের নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত হবে, সব ধরনের নিপীড়ন থেকে নাগরিকরা রক্ষা পাবে— এ ছিল আশা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের মতো বিভাজন ও নিপীড়নের নীতিতেই এগোচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। আওয়ামী লীগ যেমন তার সরকারের আমলে সাম্প্রদায়িক হামলা, ভিন্নমতের ওপর নিপীড়নের একটি ঘটনারও বিচার করেনি, তেমনি অন্তর্বর্তী সরকারও একই পথে চলেছে। এ অবস্থা থেকে নাগরিকদের রক্ষা করতে প্রয়োজন গণপ্রতিরোধ।

সংস্কৃতিকর্মী ও শিল্পী বীথি ঘোষের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন লেখক, গবেষক মীর হুযাইফা আল মামদূহ। সম্প্রতি কুমিল্লায় মাইকে ঘোষণা দিয়ে মাজার ভাঙা এবং রাজবাড়িতে মাজারের কবর থেকে লাশ তুলে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরেরও বেশি সময়ে মন্দির-মন্ডপ, হিন্দু পল্লী, সুফি, বাউল আখাড়া, আদিবাসীসহ অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার মাত্রা বেড়েছে। সামনে জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরেও সংখ্যালঘু আবাসিক এলাকা, ব্যবসায়িক কেন্দ্র, উপাসনালয়, এবং মাজার দরবার টার্গেটে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বিগত দশ বছরে (২০১৪-২৫) বিভিন্ন গণমাধ্যম ও মানবাধিকার রিপোর্টে প্রকাশিত পূজা ও অন্যান্য সময়ে পূজামণ্ডপ, শোভাযাত্রা বা সংখ্যালঘু বাড়িঘরে হামলার ঘটনাসমূহ বিশ্লেষণ করে একটা ঝুঁকি মানচিত্র তুলে ধরেন তিনি। বলেন, দেখা গেছে, ২৯ জেলা ঝুঁকিপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যার মধ্যে উচ্চ ঝুঁকিতে আছে ৫টি জেলা— ঢাকা, রংপুর, যশোর, চাঁদপুর ও নোয়াখালী। এবং মাঝারি ঝুঁকিতে আছে ২৪ টি জেলা— গাজীপুর, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ি, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, পাবনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, কুষ্টিয়া, সুনামগঞ্জ, বরিশাল, পটুয়াখালি ও নেত্রকোনা। দেশের বাকি জেলাগুলোকে নিম্নঝুঁকির বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, সংবিধানের ৪১(১) অনুচ্ছেদে প্রতিটি নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার এবং ২৩ক অনুচ্ছেদে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি রক্ষার অধিকার স্বীকৃত। সুতরাং যে কোনো ধরনের আক্রমণ প্রতিরোধ করা ও ধর্মীয়, জাতিগত, ভাষিক এবয় সাংস্কৃতিক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব।

হুযাইফা আল মামদূহ জানান, মসজিদ, মন্দির, মাজার, আখাড়া ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও সাংস্কৃতিক অধিকার সুরক্ষার প্রয়োজনে নাগরিকদের তরফ থেকে “সম্প্রীতি যাত্রা” নামের একটি ক্যাম্পেইন শুরু হচ্ছে সারা দেশে। যে ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক উসকানি ও বিভ্রান্তি রুখতে ফ্যাক্টচেকিং টিম তৈরি করা, ঝুঁকিপূর্ণ জেলাসমূহের স্থানীয় নাগরিক সমাজ, মাইনরিটি সংগঠন, সুফি ও মাজারভিত্তিক সংগঠন, বাউল-ফকির সম্প্রদায়, আদিবাসী, নারী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, পেশাজীবী ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর প্রগতিশীল অংশকে একটি অভিন্ন নেটওয়ার্কে সংযুক্ত করে সম্প্রীতি ও সংহাবস্থানের কাঠামোগত সংস্কারের একটি দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।

পূজা, শোভাযাত্রা, মাজার, ওরস ও আখাড়ার নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারি প্রশাসন ও নাগরিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে গুজব ও উগ্রবাদী মব সন্ত্রাস প্রতিরোধের আহবান জানান এবং এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেন মামদূহ।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যের পাশাপাশি সম্পূরক বক্তব্য রাখেন, গবেষক ও শিক্ষক মাহা মির্জা, চিন্তক ও শিল্পী অরূপ রাহী, সাংস্কৃতিক সংগঠক জামসেদ আনোয়ার তপন, কবি ফেরদৌস আরা রুমী ও লেখক অ্যক্টিভিস্ট বাকি বিল্লাহ।

মাহা মির্জা বলেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, মাজার-দরগাহ ও সাধারণ মানুষের ওপর উগ্রবাদী আক্রমণ বা মব ঠেকাতে অন্তর্বর্তী সরকার সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। অথচ জুলাই অভ্যুত্থানের প্রধান আকাঙ্ক্ষা ছিল ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর বিলোপ। জুলাই অভ্যুত্থানে দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকা গ্রাফিতিতেই আমাদের প্রজন্ম তাদের আকাঙ্ক্ষাকে বিবৃত করেছে। তারা সেখানে সকল জাতি-গোষ্ঠী, সংস্কৃতি, ধর্ম-বর্ণের মানুষের অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের কথা বলেছে। অথচ আজ ভিন্নমত, ধর্ম ও সংস্কৃতির লোকজন, ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীদের আক্রমণের লক্ষবস্তু হচ্ছে। সরকার সেসব ঠেকাতে পারছে না।

আগের ফ্যাসিবাদী সরকারের চেয়ে বর্তমান পরিস্থিতি আরো ভীতিকর মন্তব্য করে মাহা মির্জা বলেন, মানুষ ভয়ের মধ্যে জীবনযাপন করছেন। প্রতিটি উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসী হামলাকে নরমালাইজ করা হচ্ছে। অথচ এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে তার দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল সরকারের। সরকার সে দায়িত্ব নিচ্ছে না, উপরন্তু চুপচাপ থেকে সেগুলোকে ঘটতে দিচ্ছে।

অরূপ রাহী বলেন, সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে একটা গোষ্ঠী সামাজিক ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে। তারা অন্য ধর্ম, বিশ্বাস ও সংস্কৃতির স্বাধীনতা খর্ব করে চলেছে। মানুষের ঐক্যবদ্ধতার মধ্য দিয়ে এদের রুখে দিতে হবে। এ দেশের সম্প্রীতির সংস্কৃতি কোনোভাবেই নস্যাৎ হতে দেওয়া যাবে না।

জামসেদ আনোয়ার তপন বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে হওয়া সাম্প্রদায়িক হামলা বা নিপীড়নের একটা ঘটনার বিচার তো দূরে থাক তদন্তও হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের সে নীতিকে অন্তর্বর্তী সরকারও অক্ষুণ্ন রেখেছে। উপরন্তু এ সরকারের আমলে মাজার-আখাড়াগুলোতে হামলা বেড়েছে। সরকার এসব থামাতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এখন সামাজিক প্রতিরোধ ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।

লেখক ও অ্যক্টিভিস্ট বাকী বিল্লাহ প্রশ্নোত্তর পর্বে কথা বলতে গিয়ে বলেন, এ দেশে ধর্মীয় অনুভূতি বলতে বোঝানো হয় কেবল সংখ্যাগুরু মুসলমানদের অনুভূতিকে। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরও যে অনুভূতি থাকতে পারে, সে বিষয়টি বেমালুম ভুলে যান উগ্রবাদী গোষ্ঠী। এমন কি রাষ্ট্র বা সরকারও তাদের অনুভূতির দু’পয়সার মূল্য দেয় না। অনুভূতির দোহাই দিয়ে এ পর্যন্ত যত সাম্প্রদায়িক ও উগ্রবাদী হামলা হয়েছে তার সবগুলো ভুয়া, ভিত্তিহীন অভিযোগের ভিত্তিতে ঘটেছে।

শেয়ার করুন