০২ অক্টোবর ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ০৬:৩২:০৮ অপরাহ্ন


২০২৪ সালে ১১ হাজার ২৮০ জন বাংলাদেশির মার্কিন নাগরিকত্ব
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ০১-১০-২০২৫
২০২৪ সালে ১১ হাজার ২৮০ জন বাংলাদেশির মার্কিন নাগরিকত্ব ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্বপ্রাপ্ত বাংলাদেশি নাগরিকদের সংখ্যা


যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে অভিবাসীদের ‘মেল্টিং পট’ হিসেবে স্বীকৃত। দেশটির ইতিহাসে নতুন নাগরিক গ্রহণ কেবল একটি প্রশাসনিক প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি আমেরিকান জাতীয় ঐক্যের প্রতীকী প্রতিফলন হিসেবে ধরা হয়। নাগরিকত্ব অর্জন একজন অভিবাসীর জীবনের অন্যতম বড় মাইলফলক। কারণ এর মাধ্যমে তিনি শুধু ভোটাধিকারই পান না, বরং পূর্ণাঙ্গভাবে আমেরিকান গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনের অংশ হয়ে ওঠেন। ২০২৪ সালে নতুন করে ১১ হাজার ২৮০ জন বাংলাদেশি মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করেছেন। ত্রৈমাসিকভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের প্রথম কোয়ার্টারে ২ হাজার ৭৭০ জন, দ্বিতীয় কোয়ার্টারে ৩ হাজার ২৯০ জন, তৃতীয় কোয়ার্টারে ৩ হাজার ৬০ জন এবং চতুর্থ কোয়ার্টারে ২ হাজার ১৬০ জন নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। দীর্ঘদিনের অপেক্ষা ও আইনি প্রক্রিয়ার পর এ বাংলাদেশিরা আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন নাগরিক হন। এর আগে ২০২১ সালে ১০ হাজার ১১০ জন, ২০২২ সালে ১৪ হাজার ১৮০ জন এবং ২০২৩ সালে ১২ হাজার ৬৪০ জন বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন। 

নাগরিকত্ব প্রাপ্তি কেবল আইনি মর্যাদা নয়; এটি প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ভোটাধিকার, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ, মার্কিন পাসপোর্ট সুবিধা এবং পরিবারের জন্য স্পনসরশিপের বড় মাধ্যম। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশি-আমেরিকানদের নাগরিকত্বের এই ধারাবাহিক বৃদ্ধি তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব আরো দৃঢ় করবে। ২০২১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত এই ধারাবাহিক বৃদ্ধি প্রমাণ করে যে, প্রবাসী বাংলাদেশিরা মার্কিন সমাজে স্থায়ী ও সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। তারা কেবল ভোটাধিকারই প্রাপ্ত হননি, বরং অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও শ্রমবাজারে দীর্ঘমেয়াদি অবদান রাখছেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের বহুমাত্রিক ও শক্তিশালী সমাজ নির্মাণে সহায়ক। 

২০২৪ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে ৮ লাখ ১৮ হাজার নতুন নাগরিকত্ব : বিশ্লেষণ ও প্রেক্ষাপট

যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ইতিহাসে ২০২৪ অর্থবছর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হলো। ইউএসসিআইএস (যুক্তরাষ্ট্র নাগরিকত্ব ও অভিবাসন পরিষেবা) প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে মোট ৮ লাখ ১৮ হাজার ৫০০ জন অভিবাসী নতুন মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করেছেন। যদিও এটি ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ৭ শতাংশ কম, তবুও কোভিড-১৯ পরবর্তী স্বাভাবিক উৎপাদন ক্ষমতায় ফেরার পর এ সংখ্যা মার্কিন নাগরিকত্ব নীতির ধারাবাহিকতা ও বহুজাতিক জনসংখ্যার বৃদ্ধিকে প্রতিফলিত করে। 

নতুন নাগরিকত্বপ্রাপ্তদের প্রায় ৭০ শতাংশ মাত্র ১০টি অঙ্গরাজ্যে বসবাস করতেন। শীর্ষে রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়া (১,৫০,২০০ জন), ফ্লোরিডা (৯৩,৩০০ জন), নিউইয়র্ক (৮৭,১০০ জন), টেক্সাস (৭৯,৮০০ জন) এবং নিউজার্সি (৪৫,৬০০ জন)। অন্য গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের মধ্যে রয়েছে-ইলিনয়, ভার্জিনিয়া, জর্জিয়া, ম্যাসাচুসেটস এবং ওয়াশিংটন। এ প্রবণতা স্পষ্ট করে যে, অভিবাসীরা সাধারণত বড় শহরকেন্দ্রিক রাজ্যগুলোতে বেশি বসতি স্থাপন করেন, যেখানে কর্মসংস্থান, অভিবাসী সম্প্রদায়ের উপস্থিতি এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র‍্য বিদ্যমান। 

শহরভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মায়ামিতে ১৭ হাজার ৭০০ জন, ব্রুকলিনে ১৬ হাজার ৫০০ জন, ব্রঙ্কসে ১২ হাজার ১০০ জন, হিউস্টনে ১১ হাজার ৬০০ জন এবং লস অ্যাঞ্জেলেসে ৯ হাজার ৩০০ জন নতুন নাগরিকত্ব নিয়েছেন। জন্মভূমির বিচারে, ২০২৪ সালে সর্বাধিক নাগরিকত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন মেক্সিকো থেকে (১,০৭,৭০০ জন), এরপর ভারত (৪৯,৭০০ জন), ফিলিপাইন (৪১,২০০ জন), ডোমিনিকান রিপাবলিক (৩৯,৯০০ জন) এবং ভিয়েতনাম (৩৩,৪০০ জন)। এ পাঁচ দেশ মিলেই মোট নাগরিকত্বপ্রাপ্তদের ৩৩ শতাংশ। এর বাইরে কিউবা, চীন, এল সালভাদর, জ্যামাইকা ও কলম্বিয়া শীর্ষ তালিকায় রয়েছে। 

নতুন নাগরিকদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ (৩৭ শতাংশের বেশি) ৩০ থেকে ৪৪ বছর বয়সীদের। গড় বয়স দাঁড়িয়েছে ৪২ বছর। উল্লেখযোগ্য হলো, ২৩ জন নাগরিক ছিলেন ১০০ বছর বা তার বেশি বয়সী। লিঙ্গভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নারীরা ৫৫ শতাংশের বেশি অংশ দখল করেছেন এবং প্রায় প্রতিটি বয়স গোষ্ঠীতেই তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। 

যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ও জাতীয়তা আইনের অনুযায়ী, নাগরিকত্বের সাধারণ যোগ্যতা হলো অন্তত পাঁচ বছর বৈধ স্থায়ী বাসিন্দা থাকা। ২০২৪ সালে নতুন নাগরিকদের ৮৩ দশমিক ৮ শতাংশ এই শর্ত পূর্ণ করেছিলেন। ১৪ শতাংশ ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকের স্ত্রী/স্বামী হিসেবে মাত্র ৩ বছর বৈধ বাসিন্দা থাকার পর আবেদনকারী এবং ২ শতাংশ সামরিক সেবা-সম্পর্কিত বিশেষ বিধান অনুযায়ী যোগ্য হয়েছিলেন। সবচেয়ে বেশি মানুষ এসেছেন ইউএস নাগরিকের নিকটাত্মীয় হিসেবে (২,৪২,৪০০ জন), পরিবারভিত্তিক পছন্দ বিভাগে এসেছেন ১ লাখ ৫৪ হাজার ৯০০ জন, কর্মসংস্থানভিত্তিক ভিসা ক্যাটাগরিতে ৯৭ হাজার এবং শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থী মিলিয়ে ৭৭ হাজার জন। বৈচিত্র‍্য ভিসা (ডিভি) প্রোগ্রামের মাধ্যমে ৩৩ হাজার নাগরিকত্ব পেয়েছেন। 

নাগরিকত্ব পরীক্ষার দুটি অংশ থাকে-ইংরেজি ভাষা দক্ষতা এবং মার্কিন ইতিহাস ও সরকার (সিভিক্স)। ২০২৪ সালে প্রথমবার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার হার ছিল ৮৯ দশমিক ৭ শতাংশ। পুনঃপরীক্ষা মিলিয়ে চূড়ান্ত সফলতার হার বেড়ে ৯৪ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে। ১৭ দশমিক ৮ শতাংশের ক্ষেত্রে একজন অ্যাটর্নি বা স্বীকৃত প্রতিনিধি আবেদন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেছেন, যেখানে অধিকাংশই ৪০ বছরের বেশি বয়সী ছিলেন। অর্থনৈতিকভাবে অক্ষমদের জন্য ইউএসসিআইএস ফি মওকুফের সুযোগ রেখেছে। ২০২৪ সালে নাগরিকত্বপ্রাপ্তদের ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ ফি মওকুফ পেয়েছেন, নারীরা অধিকাংশ (৯ শতাংশ) সুবিধা নিয়েছেন। ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে ফি মওকুফের হার সবচেয়ে বেশি। 

নতুন নাগরিকরা কেবল ভোটাধিকারপ্রাপ্তই হননি, বরং যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রতিরক্ষা খাতে দীর্ঘমেয়াদি অবদান রাখবেন। অভিবাসীরা প্রায় সব খাতেই অপরিহার্য শ্রমদাতা হিসেবে কাজ করছেন, যা নাগরিকত্ব প্রাপ্তির পর আরো স্থায়ী ও বিস্তৃত হবে। যদিও কিছু সমালোচনা রয়েছে। যেমন দীর্ঘ অপেক্ষার সময় ও ফি। তবে এটি যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক চরিত্র ও অভিবাসীবান্ধব ঐতিহ্যের প্রতিফলন। নতুন ৮ লাখের বেশি নাগরিক শুধু সংখ্যা নয়, তারা দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি, সমাজ ও গণতন্ত্রকে আরও প্রাণবন্ত ও বহুমাত্রিক করে তুলবেন। 

শেয়ার করুন