স্ন্যাপ
যুক্তরাষ্ট্রে চলমান ফেডারেল সরকার শাটডাউন বা বন্ধের কারণে আগামী নভেম্বর মাসেই প্রায় ৪২ মিলিয়ন আমেরিকান নাগরিক খাদ্যসহায়তা ফুড স্ট্যাম্প (স্ন্যাপ) হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছেন। কৃষি মন্ত্রী ব্রুক রোলিন্স গত ১৬ অক্টোবর হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সরকারের খাদ্যসহায়তা তহবিল (স্ন্যাপ ) বা সাপ্লিমেন্টাল নিউট্রিশন অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামের অর্থ আর দুই সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, এটি কোটি কোটি দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারের জন্য ভয়াবহ সংকট তৈরি করবে। ক্ষুধার্ত মানুষরা তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা থেকে বঞ্চিত হবে এ বন্ধের কারণে। প্রেস ব্রিফিংয়ের পর নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পোস্টে রোলিন্স ডেমোক্র্যাটদের ওপর দায় চাপিয়ে বলেন, ‘ডেমোক্র্যাটরা তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডাকে আমেরিকান পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তার ওপরে স্থান দিচ্ছে।’ তবে ডেমোক্র্যাটরা পাল্টা অভিযোগ করে বলেছে, রিপাবলিকানরা ব্যয় সংক্রান্ত আইন নিয়ে সমঝোতায় রাজি না হওয়াতেই সরকার বন্ধ হয়েছে। তারা বলছে, ট্রাম্প প্রশাসন যদি ‘অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট’-এর (অবামাকেয়ার) প্রিমিয়াম ভর্তুকি সম্প্রসারণে রাজি থাকত, তবে এই অচলাবস্থা এড়ানো যেত।
এক সপ্তাহ আগেই যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ স্টেট সরকারগুলোকে জানিয়ে দেয় যে, নভেম্বর মাসে ফুড স্ট্যাম্পের পূর্ণ অর্থ প্রদান করার মতো অর্থ তহবিলে নেই। ফলে নভেম্বরের পেমেন্ট স্থগিত রাখতে স্টেটগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়। বর্তমানে প্রতি আটজন আমেরিকানের মধ্যে একজন এই খাদ্যসহায়তা কর্মসূচির আওতায় আছেন। ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত প্রতি জনে গড়ে ১৮৮ ডলার মাসিক সহায়তা পাচ্ছিলেন তারা। স্ন্যাপ হলো যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় খাদ্যসহায়তা কর্মসূচি। এই কর্মসূচির হাতে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের জরুরি তহবিল রয়েছে, কিন্তু নভেম্বরে প্রয়োজন হবে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের শাটডাউন পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, বহুবর্ষ মেয়াদি জরুরি তহবিল ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে সেটি সীমিত।
একজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে আংশিক পেমেন্ট দেওয়ার মতো অবস্থাও নেই। নিউইয়র্কের গভর্নর ক্যাথি হোচুল ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, এটি একটি পরিকল্পিত এবং নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত, যার উদ্দেশ্য হলো সাধারণ পরিবারগুলোর কষ্ট বাড়ানো। ফেডারেল সরকারকে এখনই এগিয়ে এসে এ তহবিল পুনঃস্থাপন করতে হবে।
উইক কর্মসূচি সাময়িকভাবে বাঁচানো গেলেও ফুড স্ট্যাম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। চলমান অচলাবস্থায় এটি দ্বিতীয় পুষ্টি সহায়তা কর্মসূচি, যা তহবিল সংকটে পড়েছে। এর আগে উইক (উইমেন, ইনফ্যান্টস অ্যান্ড চিলড্রেন) কর্মসূচি, যা প্রায় ৭ মিলিয়ন নারী ও শিশুকে খাদ্যসহায়তা দেয়, সেটিও বন্ধের মুখে পড়েছিল। ট্রাম্প প্রশাসন তখন শিশু পুষ্টি কর্মসূচির জন্য নির্ধারিত ৩০০ মিলিয়ন ডলার শুল্ক রাজস্ব থেকে সরিয়ে এনে উইক চালু রাখে। তবে ইউএসডিএ জানিয়েছে, সেই রাজস্ব ফুড স্ট্যাম্পের ঘাটতি পূরণে যথেষ্ট নয়।
ইতিমধ্যে অন্তত ১৭টি স্টেট নতুন আবেদন গ্রহণ বন্ধ করে দিয়েছে, কারণ তাদের সিস্টেম অক্টোবরের আংশিক পেমেন্ট নভেম্বরের সঙ্গে মিশে যাবে। অন্যান্য স্টেট গুলো আপাতত আলাদা করে অক্টোবরের সহায়তা বিতরণ করছে। এর আগেও এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া দীর্ঘতম শাটডাউনের সময় ইউএসডিএ প্রথমে জানায়, জানুয়ারির শেষে ফুড স্ট্যাম্প শেষ হয়ে যাবে। পরে সংস্থাটি বিশেষ বিধান ব্যবহার করে ফেব্রুয়ারির সহায়তা সময়মতো প্রদান করেছিল। কিন্তু এবার সেই বিকল্প ব্যবস্থাও সম্ভব হচ্ছে না। খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক সংগঠন ফুড রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাকশন সেন্টার (ফ্র্যাক)-এর নির্বাহী পরিচালক জিনা প্লাতা-নিনো বলেন, থ্যাংক্সগিভিং ডে -এর আগেই যদি এই সহায়তা বন্ধ হয়ে যায়, তবে তা লাখ লাখ পরিবারের জন্য ভয়াবহ হবে। খাদ্য ব্যাংকগুলো ইতিমধ্যেই চাপে রয়েছে, তারা এ ঘাটতি পূরণ করতে পারবে না।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার অন বাজেট অ্যান্ড পলিসি প্রায়োরিটিজের ভাইস প্রেসিডেন্ট টাই জোনস কক্স বলেন, সরকার ইতোমধ্যেই অন্য অগ্রাধিকারগুলোতে বিকল্প ব্যবস্থা নিচ্ছে, তবে খাদ্যসহায়তার মতো জরুরি কর্মসূচির ক্ষেত্রে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। আমরা পরিবারগুলোকে এই বন্ধের বলি হতে দিতে পারি না। বর্তমানে সরকারের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে ১ অক্টোবর থেকে। কারণ কংগ্রেসে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে কোনো সমঝোতা হয়নি। এ অচলাবস্থা যদি আরো দীর্ঘায়িত হয়, তবে নভেম্বরেই যুক্তরাষ্ট্রের কোটি মানুষের খাদ্যসহায়তা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে।
গভর্নর হোচুলের তীব্র প্রতিক্রিয়া : নিউইয়র্কে ৩০ লাখ মানুষের খাদ্যসহায়তা বন্ধের আশঙ্কা
নিউইয়র্কে প্রায় ৩০ লাখ মানুষের খাদ্যসহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় স্টেট জুড়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ফেডারেল বাজেট স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর ওয়াশিংটনের রিপাবলিকানদের সিদ্ধান্তে গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, নিউইয়র্কের গভর্নর ক্যাথি হোচুল। তিনি বলেন, ওয়াশিংটনের রিপাবলিকানরা ইচ্ছাকৃতভাবে নিউইয়র্কের সাধারণ মানুষের মুখ থেকে খাবার ছিনিয়ে নিচ্ছে। লাখ লাখ নিউইয়র্কবাসীর খাদ্যসহায়তা জিম্মি করে রেখেছে রিপাবলিকানরা। প্রধানত নিম্নআয়ের পরিবারগুলোর জন্য পরিচালিত সাপ্লিমেন্টাল নিউট্রিশন অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রাম (স্ন্যাপ) যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ খাদ্যসহায়তা কর্মসূচি। নভেম্বরের ১ তারিখ থেকেই এই সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, স্টেট সরকারগুলোকে জানানো হয়েছে যে তারা আর স্ন্যাপ সুবিধাভোগীদের জন্য ফেডারেল তহবিল ব্যবহার করতে পারবে না।
গভর্নর হোচুল এক বিবৃতিতে বলেন, আমি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। ওয়াশিংটনের রিপাবলিকানরা ইচ্ছাকৃতভাবে নিউইয়র্কের লাখ লাখ মানুষের কাছ থেকে খাদ্যসহায়তার টাকা আটকে রেখেছে। এটি এক নির্মম ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত, যা অসংখ্য পরিবারকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলছে। তিনি আরো বলেন, এ তহবিল অবিলম্বে ছেড়ে দিতে হবে, যাতে রাজ্য সরকার স্ন্যাপ সুবিধাভোগীদের কাছে প্রয়োজনীয় সহায়তা পৌঁছে দিতে পারে। মানুষের জীবন এখানে প্রশ্নে, আর এই রাজনৈতিক খেলা বন্ধ হওয়া উচিত।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে চলমান ফেডারেল শাটডাউন পরিস্থিতি খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। অনেক রাজ্যেই স্ন্যাপ ও (উইক) বা উইমেন, ইনফ্যান্টস অ্যান্ড চিলড্রেন কর্মসূচির তহবিল হিমশিম খাচ্ছে। যেহেতু এই প্রোগ্রাম সম্পূর্ণ ফেডারেল অর্থায়নে পরিচালিত, রাজ্য সরকার এককভাবে ঘাটতি পূরণ করতে পারছে না। বিশ্লেষকদের মতে, যদি নভেম্বরের মধ্যে কংগ্রেসে বাজেট চুক্তি না হয়, তবে নিউইয়র্কসহ বহু রাজ্যে লাখ লাখ পরিবার খাদ্যসহায়তা থেকে বঞ্চিত হবে। এতে নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে খাদ্য অনিরাপত্তা ও দারিদ্র্য আরও গভীর আকার নিতে পারে। গভর্নর হোচুল ঘোষণা করেছেন যে, ফেডারেল অর্থ বন্ধ হয়ে গেলেও স্টেট প্রশাসন বিকল্প উপায়ে কিছু সময়ের জন্য জরুরি সহায়তা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, স্ন্যাপ একটি ফেডারেল প্রোগ্রাম। স্টেট গভর্নমেন্ট এককভাবে এই ঘাটতি পূরণ করতে পারবে না। ওয়াশিংটনের নেতৃত্বকেই দায়িত্ব নিতে হবে।
রাজনৈতিক টানাপড়েনের বলি হচ্ছে সাধারণ আমেরিকান পরিবার। অর্থনৈতিক চাপ, মুদ্রাস্ফীতি ও আয়ের বৈষম্যের মধ্যেই লাখো মানুষ এখন নির্ভর করছেন সরকারি খাদ্যসহায়তার ওপর। বিশেষ করে নিউইয়র্ক সিটির মতো মহানগরে, যেখানে জীবনযাত্রার ব্যয় দ্রুত বাড়ছে, স্ন্যাপ -এর তহবিল বন্ধ হয়ে গেলে পরিস্থিতি ‘বিপর্যয়কর’ হবে বলে সতর্ক করেছেন সমাজকর্মীরা। মানবিক সংকটের এই মুহূর্তে গভর্নর হোচুল ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন রিপাবলিকান নেতৃত্বের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে অবিলম্বে ফেডারেল তহবিল ছেড়ে দিতে। অন্যথায়, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ধনী অঙ্গরাজ্য নিউইয়র্কেও লাখো মানুষ শীতের শুরুতেই খাদ্য অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।