জাপানের রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন আকাসাকা প্রাসাদ ও স্ট্যাচু অব লিবার্টি
জাপানে আমার ট্যুর গাইড নিকিতা লাঞ্চের সময় জানালো-হাবিব আজ ট্যুর শেষে তোমার জন্য একটা চমক আছে। জানতে চাইলাম, কি চমক! মুখে একটা রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে বললো-এখন বলবো না, সময় হলেই দেখতে পাবে। আজ দিনব্যাপী ট্যুর ছিল। ৮ ঘণ্টার টোকিও সিটি ট্যুর। দিনশেষে মোটামুটি ক্লান্ত। শেষ ট্যুর ছিল জাপান উপসাগরে ক্রুজ ট্যুর। নিকিতা বলছিল দিন শেষে ক্রুজ ট্যুরে তোমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে।
সন্ধ্যার একটু আগে বাস থেকে নামলাম জাপান উপসাগরের তীরে। আমি সারপ্রাইজটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। নিকিতা আমার হাত ধরে টেনে আনলো সাগরপাড়ে। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি মূর্তি-স্ট্যাচু অব লিবার্টি। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম মুর্তিটির দিকে। আঙুল দিয়ে শরীরে চিমটি কাটলাম আমি নিউইয়র্কেই আছি নাতো! দেখলাম নিকিতা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। যেন চোখ দিয়ে বলছে, কেমন চমক দিলাম দেখলে তো!
নিকিতা জানায়, ওদাইবা দ্বীপে দাঁড়িয়ে থাকা এই বিশেষ প্রতীক-স্ট্যাচু অব লিবার্টি। যদিও এটি নিউইয়র্কের মূল ভাস্কর্যের ছোট সংস্করণ, তবে এর ইতিহাস এবং টোকিওর উপসাগরের পটভূমি এক অসাধারণ রোমান্টিক অভিজ্ঞতা দেয়। মূল স্ট্যাচু অব লিবার্টি ১৮৮৬ সালে ফরাসি ভাস্কর্যকার ফ্রেডেরিক অগাস্টে বারথোল্ডি দ্বারা তৈরি করা হয়। এটি স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে উপহার হিসেবে নিউইয়র্ককে দেওয়া হয়। টোকিওতে এই সংস্করণ ১৯৯৬ সালে ফ্রান্সের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে উদযাপন করে স্থাপন করা হয়। সুতরাং এটি কেবল একটি প্রতীক নয়, বরং আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব ও শান্তির বার্তাও বহন করে।
আমরা ততক্ষণে ক্রুজে উঠে বসেছি। জাহাজটি এগিয়ে যাচ্ছে ওদাইবা দ্বীপের দিকে। সমুদ্রের নোনা বাতাসে ভেসে আসছে শহরের কোলাহল। সামনে দাঁড়িয়ে আছে সোনালি রঙের প্রতীক-স্ট্যাচু অব লিবার্টি। ভাস্কর্যের দিক থেকে দৃি সরিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকালাম। দূরে রেইনবো ব্রিজ, ওদাইবার নান্দনিক স্থাপনা, আর সমুদ্রের নীরবতা-সব মিলিয়ে মনে হলো আমরা যেন এক জীবন্ত চিত্রকাব্যের মধ্যে আছি।
ভাবছিলাম স্ট্যাচু অব লিবার্টি কেবল স্বাধীনতার প্রতীক নয়। এটি টোকিওর সমুদ্রপৃষ্ঠে দাঁড়িয়ে ইতিহাস, সংস্কৃতি, বন্ধুত্ব এবং প্রেমের মিলনক্ষেত্র তৈরি করেছে।
নি-চোমে : টোকিওর গে টাউন
আমার ট্যুর গাইড নিকিতা বললো, চলো, তোমাকে আজ টোকিওর অন্যরূপ দেখিয়ে আনি-দেখবে এমন এক টোকিও, যাকে দিনের আলো চেনে না। আমি বিস্মিত চোখে তাকালাম তার দিকে। দিনভর আমরা ঘুরেছি মন্দির, পার্ক, প্রাসাদ। দেখেছি জাপানের শৃঙ্খলা ও নীরবতার শহর। কিন্তু এবার রাতের বেলা নিকিতা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে? টোকিওর ব্যস্ত শিনজুকু স্টেশন থেকে কিছুটা হেঁটে নিকিতা আমাকে নিয়ে এলো একটা সরু গলির ভেতর। যেখানে নিয়ন আলো ঝলমল করছে, বাতাসে মিশে আছে সংগীত, হাসি আর কফির গন্ধ। দেওয়ালে উড়ছে ছোট ছোট রেইনবো পতাকা, যেন ঘোষণা দিচ্ছে-এখানে ভালোবাসা মানে স্বাধীনতা। রাস্তায় নরম আলো, মাঝেমধ্যে হাসির শব্দ, আর কিছু মানুষ একে অপরের কাঁধে হাত রেখে হেঁটে যাচ্ছে-স্বাভাবিক, সহজ, উজ্জ্বল জীবনের প্রতিচ্ছবি যেন।
নিকিতা হেসে বললো, এটাই টোকিওর গে টাউন।
যেখানে কেউ লুকিয়ে থাকে না বরং গর্বের সঙ্গে বলে-‘আমি আমি’। নিকিতা বলে, এটি টোকিওর ব্যস্ততম অঞ্চলের একটি-নাম শিনজুকু। দিনভর মানুষের ভিড়, উঁচু উঁচু বিল্ডিং, অফিস, দোকান, রেস্তোরাঁ-সবকিছু যেন একসঙ্গে ছুটছে এই শহরের হৃদস্পন্দনের সঙ্গে। কিন্তু এই ব্যস্ততার ভেতরেই আছে এই ছোট্ট পাড়া, যেখানে রাত নামে অন্য এক রঙে। এটি জাপানের গে কালচারের কেন্দ্রস্থ। আর বলা যায়, পুরো এশিয়ার অন্যতম উন্মুক্ত সমকামী অঞ্চল।
এটা রঙের, হাসির, এবং মুক্ত আত্মার এক পাড়া—যার নাম শিনজুকু নি-চোমে। রাত নামতেই এখানে জ্বলে ওঠে নিয়ন বাতির আলো। সরু গলির ভেতর একের পর এক ছোট বার, ক্যাফে, নাচের ক্লাব আর রেইনবো পতাকা উড়তে থাকে গর্বের সঙ্গে। এখানে কেউ লুকিয়ে থাকে না, বরং নিজেকে প্রকাশ করাই নিয়ম। নিকিতা জানায়, এক সময় জাপানে সমকামী জীবনযাপন ছিল গোপনীয় আর নীরব এক জগৎ। কিন্তু নি-চোমে সেই দেওয়াল ভেঙেছে বহু বছর আগে। এখন এখানে প্রায় ৩০০-এর বেশি গে বার ও ক্লাব রয়েছে। প্রতিটি জায়গার নিজস্ব পরিবেশ কোথাও জ্যাজ সংগীত, কোথাও ড্রাগ শো, আবার কোথাও শান্তভাবে কফির কাপে গল্পের আসর।
রাত তখন নরম হয়ে এসেছে। রাস্তার পাশে ছোট বারগুলোয় মানুষ বসে গল্প করছে, কেউ গাইছে, কেউ নাচছে, কেউ কেবল একে অপরের চোখে তাকিয়ে হাসছে। সবকিছু এতটাই স্বাভাবিক যে, কোনো অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ে না। কোথাও ড্রাগ শো চলছে, কোথাও কবিতা পাঠ, আবার কোথাও নীরব আলোয় দুইজন বসে আছে শুধু চোখের ভাষায় কথা বলার জন্য। সবকিছু এত স্বাভাবিক, এত সুন্দর-যেন পৃথিবীটা একটু বেশি সহনশীল হয়ে উঠেছে এই গলির ভেতরেই।
নিকিতা জানায়, প্রায় তিন শতাধিক গে বার ও ক্লাব রয়েছে এই এলাকায়। একটি বারে ঢুকে দেখি, দেওয়ালে ঝোলানো ছোট পোস্টার, তাতে লেখা- ‘Love is not a sin, its a song.’ মালিক মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক হালকা হাসিতে বললেন, এখানে সবাই আসে একটাই কারণে, ভালোবাসার স্বাধীনতা অনুভব করতে’। অন্য একটি ছোট বারে দেখলাম মালিক নিজেই অতিথিদের সঙ্গে কথা বলছেন। জানালেন, এখানে শুধু সমকামী মানুষ নয়, যে কেউ আসতে পারে, যতক্ষণ সে সম্মান দেখাতে জানে। তাদের কথায় বারবার ফিরছিল একটাই শব্দ-’acceptance’, অর্থাৎ গ্রহণযোগ্যতা। আমি দাঁড়িয়ে দেখি-একটি দম্পতি নাচছে, অন্য এক কোণে কেউ কাঁদছে চুপচাপ। আবার কেউ হাসছে এমনভাবে, যেন অনেকদিন পর সত্যিকারের মুক্তি পেয়েছে।
নিকিতা বলে, নি-চোমে শুধু একখণ্ড বিনোদন এলাকা নয়, এটি জাপানের সামাজিক পরিবর্তনের প্রতীক। প্রতি বছর এখান থেকেই শুরু হয় টোকিও প্রাইড প্যারেড, হাজারো মানুষ রেইনবো পতাকা হাতে রাস্তায় নেমে আসে ভালোবাসার স্বাধীনতা উদযাপন করতে। প্রতি বছর এপ্রিলের শেষ দিকে হাজারো মানুষ রাস্তায় নামে রেইনবো পতাকা হাতে, গেয়ে ওঠে তাদের মুক্তির সুর-Love wins.
টোকিওর এপ্রিল মাস মানেই বসন্তের রঙ, চেরি ফুলে ছাওয়া পার্ক আর নরম রোদে ভিজে থাকা দুপুর। কিন্তু এই সময়টা জাপানের রাজধানীতে আরো এক রঙের আগমন ঘটায় রেইনবো রঙের। শহরের বাতাসে ভেসে ওঠে হাসি, সংগীত, আর একটাই বার্তা-‘Love is Love’ হ্যাঁ, শুরু হয় টোকিও রেইনবো প্রাইড (ToKzo Rainbow Pride) ভালোবাসা, স্বাধীনতা আর সমতার এক মহোৎসব। রেইনবো রঙে সাজে শহর। প্রতি বছর এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে শিনজুকু নি-চোমে ও ইয়োইয়োগি পার্কের চারপাশে জমে ওঠে প্রাইড উৎসবের রঙিন মেলা। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন টোকিওর হৃদয় রঙে রঙে ভরে উঠেছে। রাস্তার দুই পাশে তরুণ-তরুণী, দম্পতি, পরিবার-সবাই হাতে থাকে রেইনবো পতাকা। কারো গালে আঁকা হৃদয়চিহ্ন, কারো পোশাকে লেখা-‘Equality for All’.
উৎসবের মঞ্চে বাজে সংগীত, বিখ্যাত জাপানি শিল্পীরা পরিবেশন করেন ভালোবাসার গান। ড্রাগ পারফরমারদের রঙিন পোশাক, আর নাচের ছন্দে মিশে যায় মানুষের উচ্ছ্বাস। এ যেন এক দিন, যেদিন টোকিও নিজেই ঘোষণা দেয় ভালোবাসার কোনো সীমারেখা নেই।
দুপুরের পর শুরু হয় টোকিও প্রাইড প্যারেড। রাস্তায় ভালোবাসার মিছিল। শত শত সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও মানুষ রেইনবো পতাকা হাতে হাঁটতে থাকে টোকিওর প্রধান সড়ক ধরে। তাদের স্লোগান-Be Yourself, Love Wins, We are All Equal-মিছিলের ভেতরে থাকে এলজিবিটিকিউ কমিউনিটির মানুষ, তাদের বন্ধু, পরিবার, এমনকি অনেক বিদেশি পর্যটকও। নিকিতা জানায়, টোকিও প্রাইড এখন শুধু উৎসব নয়, এটি এক সামাজিক আন্দোলন। জাপানে এখনো সমলিঙ্গ বিবাহ বৈধ নয়, কিন্তু এই উৎসব সেই পরিবর্তনের প্রতীক। প্রতিবছর এই দিনে মানুষ দাবি তোলে, সমান অধিকার, সম্মান ও নিরাপত্তার। করপোরেট প্রতিষ্ঠান, স্কুল, সরকারি সংস্থাও এখন অংশ নিচ্ছে প্রাইডে, যা প্রমাণ করে জাপানও বদলাচ্ছে, ধীরে হলেও দৃঢ়ভাবে। আমি নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলাম। নিয়ন আলোয় মুখে পড়ছিল রঙের ছায়া, আর মনে হচ্ছিল- এই টোকিও, যে শহর নিখুঁতভাবে সাজানো, তারও এক গোপন হৃদয় আছে, যেখানে ভালোবাসা নিজের ভাষায় বাঁচে।
যখন স্টেশনের পথে ফিরছিলাম, বাতাসে তখনো ভেসে আসছিল সুর আর হাসির প্রতিধ্বনি। মনে হচ্ছিলো এই শহরের সবচেয়ে সত্যিকারের জীবন বেঁচে আছে ঠিক এখানেই শিনজুকু নি-চোমের এই রঙিন, মুক্ত রাতের ভেতরে। নিকিতা বলল, তুমি আজ টোকিওর সবচেয়ে মানবিক জায়গাটা দেখলে। আমি চুপচাপ মাথা নাড়লাম। সত্যিই, শিনজুকু নি-চোমে যেন এক আয়না, যেখানে মানুষ নিজেকে দেখে, ভয় ছাড়া, মুখোশ ছাড়া।
টোকিওর শহর ছেড়ে জাপানের গ্রাম্য টেবিলে
টোকিওর ঝলমলে শহর ঘুরতে ঘুরতে একদিন গাইড নিকিতাকে বললাম, আমি জাপানের ঐতিহ্যবাহী খাবার খেতে চাই-যেমনটা তোমাদের পূর্বপুরুষরা খেতেন।
সে মুচকি হেসে বললো, তাহলে শহর থেকে একটু দূরে যেতে হবে। পরদিন সকালে আমরা দুজনে টোকিওর ইকিবুকুরো (Ikebukuro) স্টেশন থেকে একটি ঔজ লাইনে উঠি। নিকিতা বললো, আজ আমাদের গন্তব্য আসামি (Asami) নামের একটি গ্রামঢু এলাকায়। জানালার পাশে গিয়ে বসলাম। ধীরে ধীরে শহরের কোলাহল ফিকে হয়ে আসছে। কংক্রিটের বিল্ডিংয়ের জায়গায় জায়গায় সবুজ ধানক্ষেত, বাঁশবন, আর নীল পাহাড়ের রেখা দেখা যাচ্ছে দূরে। বাতাসে কেমন এক শান্ত গন্ধ-মাটির আর কাঠের মিশ্র ঘ্রাণ। ট্রেন আমাদের নামিয়ে দিলো ‘আসামি-গাও (Asami)’ নামের একটি রেল স্টেশনে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে প্রায় পনেরো মিনিট হাঁটার পর পৌঁছালাম আসামি গ্রামের পুরোনো একটি কাঠের বাড়িতে। এখানে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ফুটো কাঠের দরজা, ধূধূ ধোঁয়ার গন্ধ, জানালায় বাতাসে কাঁচা ঘাস ও পাতার সুবাস-সব মিলিয়ে যেন আমাকে এক অন্য জগতে নিয়ে গেলো। এটি নিকিতার এক আত্মীয়ের বাড়ি। কাঠের তৈরি পুরোনো বাড়িটির নিচু ছাদ, সামনে ছোট্ট জেন বাগান, যেখানে পাথর সাজানো, পাশে ছোট্ট পুকুরে সাদা কোই মাছ সাঁতার কাটছে। ভেতরে ঢুকে দেখি, মাটিতে বিছানো তাতামি ম্যাট, মাঝখানে নিচু কাঠের টেবিল। হালকা আলো, ধূপের গন্ধ, জানালার ওপারে পাহাড়ের চূড়া-পুরোটা যেন সময়ের ঘড়ি পেছনে নিয়ে গেল।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার পরিবেশন হলো। কাঠের ট্রেতে সাজানো ছোট ছোট বাটিতে একেকটি পদ- গরম ভাপে রান্না করা ভাত, পাশে মিসো স্যুপ, গ্রিলড স্যামন মাছ, টেম্পুরা সবজি, আর একটু পিকল করা মূলা। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল ‘নাট্টো’- ফারমেন্টেড সয়াবিন, যা একটু গন্ধযুক্ত হলেও তাদের কাছে গভীর ঐতিহ্যের অংশ। খাবারের প্রতিটি পদ এত নিপুণভাবে সাজানো, যেন একেকটি ছোট্ট শিল্পকর্ম। খেতে খেতে নিকিতা বললো, আমাদের জন্য খাওয়াটা শুধু পেট ভরানোর ব্যাপার না, এটা প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। এই খাবারগুলো শুধু স্বাদে নয়-এগুলোর মধ্যে আছে ইতিহাস, কৃরি গোপন গল্প। ওই অঞ্চলে ধান চাষের ধারা, বনজ গাছের ব্যবহার ও স্থানীয় মশলা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলে এসেছে।
বিকেল অবধি আমরা নিকিতার আত্মীয় মহিলার সঙ্গে গল্প করি। ধোঁয়া ওঠা মাটির চুলায় পানি সিদ্ধ হয়, একচু পর পর গ্লাসে হালকা চা আসে। বিকাল গড়িয়ে যখন সূর্য পাহাড়ের পেছনে হারিয়ে যাচ্ছিল। আমরা রওয়ানা দিলাম টোকিওর পথে। তখনো সেই বাড়ির শান্তি, কাঠের ঘ্রাণ, আর খাবারের উতা মন ভরিয়ে রেখেছিল। মনে হচ্ছিলো আমি ফিরে আসছি, এক এমন জাপান থেকে, যেখানে ঐতিহ্য এখনো নিঃশব্দে বেঁচে আছে।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন-আকাসাকা প্রাসাদ
খুব সকালেই টোকিও মেট্রোর Marunouchi Line ধরে রওয়ানা দিলাম আকাসাকা প্রাসাদ ভ্রমনণে। টোকিও শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই প্রাসাদটি জাপানের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ স্থাপনা, যা বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান ও ভিআইপি অতিথিদের আতিথেয়তার জন্য ব্যবহৃত হয়। একে জাপানের ‘রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন’ বলা হয়। আকাসাকা প্রাসাদ জাপানের কূটনৈতিক কৌশল ও মর্যাদার প্রতীক। যেমন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, ভারতের প্রধানমন্ত্রী বা ইউরোপের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান জাপান সফরে গেলে সাধারণত এখানেই থাকেন অথবা সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
লাল রঙের ট্রেন গুনগুন শব্দে ছুটে চললো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম Yotsuza স্টেশনে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে অল্প পথ, গাছপালা ঘেরা রাস্তা ধরে এগোলেই সামনে ভেসে উঠল প্রাসাদের ফটক। প্রশস্ত ফটক, রক্ষীদের কড়া পাহারা, আর তার ওপাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন-আকাসাকা প্রাসাদ। নিকিতা জানায়, প্রাসাদটি টোকিওর মিনাতো জেলায় আকাসাকা এলাকায় অবস্থিত। ১৯০৯ সালে সম্রাট মেইজির নির্দেশে এটি রাজপুত্র (পরবর্তী সম্রাট তাইশো) এর আবাসস্থল হিসেবে নির্মিত হয়। ইউরোপীয় নিও-বারোক (Neo-Baroque) ধাঁচে তৈরি, যা ফ্রান্সের ভার্সাই প্রাসাদ বা ইংল্যান্ডের বাকিংহাম প্যালেসের মতো জাঁকজমকপূর্ণ।
জাপান সরকার এটিকে মূলত বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী, রাজা-মহারাজাদের আতিথেয়তার জন্য ব্যবহার করে থাকে। আন্তর্জাতিক সম্মেলন, রাষ্ট্রীয় নৈশভোজ ও কূটনৈতিক বৈঠক এখানেই অনুষ্ঠিত হয়। সে আরো জানায়, প্রথমে এটি টোশি প্রাসাদ নামে পরিচিত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জাপানের সরকারিভাবে বিদেশি অতিথিদের স্বাগত জানানোর জন্য এটি নতুনভাবে সাজানো হয়। ১৯৭৪ সালে সরকার একে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘State Guest House’ হিসেবে ঘোষণা করে। এটি জাপানের জাতীয় সম্পদ (National Treasure) হিসেবে স্বীকৃত, যা অত্যন্ত মর্যাদার প্রতীক। ফটকের ভেতরে ঢুকতেই চারপাশে সাজানো বাগান, গাছপালা আর নান্দনিক ঝরনার জলধ্বনি আমাদের স্বাগত জানালো। ইউরোপীয় নিও-বারোক স্থাপত্যে গড়া সাদা-ধূসর রঙের প্রাসাদটি সূর্যের আলোয় চকচক করছিল। দূর থেকে মনে হচ্ছিল, যেন ফ্রান্সের ভার্সাই প্রাসাদ বা ইংল্যান্ডের বাকিংহাম প্যালেসের প্রতিরূপ দাঁড়িয়ে আছে টোকিওর বুকে।
ভেতরে ঢুকেই চোখে পড়লো বিশাল হলঘর-Asahi-no-ma। সোনালি ঝাড়বাতির আলোয় কক্ষটি যেন রূপকথার রাজপ্রাসাদ। প্রতিটি দেওয়াল, ছাদ আর স্তম্ভে ইউরোপীয় শিল্পকলার ছাপ, কিন্তু কোথাও কোথাও জাপানি নকশার সূক্ষ¥ ছোঁয়া। মনে হলো, পূর্ব-পাশ্চাত্যের মিলন যেন এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমাকে অভিভূত করছে।
আমি কক্ষ থেকে কক্ষে হাঁটছিলাম। প্রতিটি কক্ষে একেকটি গল্প লুকানো-রাষ্ট্রপ্রধানদের বৈঠক, নৈশভোজের উজ্জ্বল মুহূর্ত, বিশ্বের নানা দেশের রাজা-মহারাজাদের পদচারণা। ইতিহাস যেন মৃদু স্বরে ফিসফিস করছে আমার কানে। বাইরে বের হয়ে যখন বাগানে দাঁড়ালাম, হালকা বাতাসে ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসছিল। প্রাসাদের সামনের প্রশস্ত চত্বর থেকে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, আভিজাত্যের প্রতীক এই স্থাপনা জাপানের আধুনিক কূটনীতির মুকুটে সত্যিই এক রত্নখচিত রত্ন। নিকিতা জানায়, এখানে বহু বিশ্ব নেতার পদচিহ্ন পড়েছে। এখানে এসেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন, জাপানের সঙ্গে নতুন যুগের সম্পর্ক গড়তে। এসেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, যার কথায় মিলেছিল বন্ধুত্বের সেতু। ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ দ্বিতীয়ও হেঁটেছিলেন এই একই বাগানের পথে- তার সফরে টোকিও ভেসেছিল উচ্ছ্বাসে। আর আধুনিক সময়ে, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা থেকে শুরু করে ভারতের নরেন্দ্র মোদি, অনেকে এই হলঘরে আলোচনায় মিলিয়েছেন ভবিষ্যতের রূপরেখা। আকাসাকা প্রাসাদে এসে বুঝলাম, শুধু একটা ভবন নয়, এটি জাপানের মর্যাদা ও আতিথেয়তার জীবন্ত প্রতীক। টোকিওর হৃদয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই রাজকীয় সৌধ আমাকে মনে করিয়ে দিল- ভ্রমণ মানে শুধু স্থান দেখা নয়, ইতিহাস, সংস্কৃতি আর কূটনীতির মেলবন্ধনও অনুভব করা।
জাপান-নিয়মের ভেতর নান্দনিক জীবন
জাপান এমন এক দেশ যেখানে নিয়ম-কানুন শুধু আইনে নয়, সংস্কৃতি ও মানসিকতার গভীর শিকড়ে গাঁথা। বিদেশিদের কাছে এই নিয়মগুলো অনেক সময় অবাক করা মনে হয়। টোকিওর এক সকাল। রাস্তায় নামতেই প্রথম চমকটা খেলাম-ব্যস্ত শহর, অথচ আশ্চর্য নীরবতা। হাজার মানুষ চলেছে, ট্রেন ছুটছে মিনিটের নির্ভুলতায়, কিন্তু কোথাও হট্টগোল নেই। মনে হলো, শহরটা যেন কোনো অদৃশ্য সুরে বাঁধা, যেখানে প্রত্যেক মানুষ তার নিজের ছন্দে নিঃশব্দে বাজছে।
জাপানে হাঁটতে হাঁটতে বা ট্রেনে বাসে খাওয়া অভদ্রতা হিসেবে ধরা হয়। খাবার মানেই বসে শান্তভাবে খাওয়া- তা হোক পার্কে, অফিসে বা রেস্তোরাঁয়। স্টারবাকস থেকে এক কাপ কফি নিয়ে রাস্তায় হাঁটছিলাম। হঠাৎ পাশের এক জাপানি ভদ্রলোক চোখে ইশারা করে জানালেন- ওটা এখানে নয়। বুঝলাম, রাস্তার হেঁটে কফি খাওয়া এখানে অনুচিত। খাওয়া মানেই নির্দি জায়গায় বসে, মনোযোগ দিয়ে খাওয়া। সেই মুহূর্তে উপলব্ধি করলাম-ওদের জন্য খাওয়াও একপ্রকার ধ্যান।
ট্রেনে টোকিও থেকে হিরোশিমা যাচ্ছি। চোখে পড়লো অদ্ভুত দৃশ্য- পুরো কামরা ভরা মানুষ, অথচ সবার মুখে নীরবতা। কেউ ফোনে কথা বলছে না, কেউ হাসছে না। সবাই নীরবে বই পড়ছে, কিংবা জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। ট্রেনে পাশাপাশি দুটো করে সিট। আমার পাশের সিটে বসা তরুণীকে দেখলাম নিঃশব্দে বই পড়ছে। অন্য কেউ ফোনে নয়, চোখে চোখও নয়-সবাই নিজের জগতে ডুবে। জাপানিরা বিশ্বাস করে, নীরবতা হলো সম্মানের ভাষা। পরে জেনেছিলাম ট্রেন, বাস বা পাবলিক প্লেসে ফোনে কথা বলা খুবই অশোভন বলে গণ্য হয়। মানুষজন সাধারণত মেসেজ করে কথা বলে বা নীরবে যাত্রা করে। প্রায় সব জাপানি ঘর, স্কুল এমনকি কিছু রেস্তোরাঁয়ও জুতো খুলে ঢুকতে হয়। এটি পরিচ্ছন্নতা ও সম্মানের প্রতীক।
জাপানে আমার ট্যুর গাইড একদিন দাওয়াত করলো তার বাড়িতে। দরজার সামনে পৌঁছাতেই সে হেসে বললো-জুতা খুলে আস। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ঘরের ভেতর একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার। পরে জানলাম, তাদের কাছে বাইরে হাঁটা জুতার ধুলো মানে অশুদ্ধতা। রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েও পেলাম এক নতুন শিক্ষা। বিল মেটানোর পর টিপস দিতে যেতেই ওয়েটার হালকা মাথা নুইয়ে বলল, না, ধন্যবাদ। জাপানে ভালো সেবা মানেই কর্তব্য, টিপস নয়। এ যেন এক সংস্কৃতির মাধুর্য, যা টাকার চেয়ে বেশি দামি। রেস্তোরাঁ, ট্যাক্সি বা হোটেলে কাউকে টিপস দিলে তারা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। ভালো সেবার জন্য টিপ নয়, কৃতজ্ঞতা প্রকাশই যথে বলে তারা মনে করে।
রাস্তার পাশে যখন ডাস্টবিন খুঁজে না পেয়ে অবাক হচ্ছিলাম, তখন এক বৃদ্ধা হেসে বললেন, ময়লা নিজের ঘরেই নিয়ে যান। বুঝলাম, পরিচ্ছন্নতা এখানে সরকার নয়, মানুষের অভ্যাস। অদ্ভুত শোনালেও সত্যি। জাপানে পাবলিক ডাস্টবিন খুব কম। সবাই নিজের ময়লা ব্যাগে করে বাড়ি নিয়ে যায়। পরিচ্ছন্নতা সবার ব্যক্তিগত দায়িত্ব।
উপহার দুটি হাতে দিতে হয়, প্যাকেট খোলা হয় পরে, কখনোই উপহার দাতার সামনে বসে নয়। কারণ, সামনে খোলা অসম্মানের ইঙ্গিত হিসেবে ধরা হয়। একদিন আমার ট্যুর গাইড আমাকে একটি ছোট প্যাকেট দিলেন, দু’হাতে করে। আমি খুলতে যেতেই তিনি মৃদু হেসে বললো- এখন নয়, পরে খোলো। পরে বুঝলাম ওদের কাছে উপহার মানে শুধুই বস্তু নয়, সম্মানের প্রকাশ। সামনে খুলে ফেলা মানে যেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সৌন্দর্য্য নষ্ট করা।
জাপানে সময়ের মূল্য আমি নতুনভাবে শিখেছি। ট্রেন ঠিক নির্ধারিত সময়ে ছাড়ে, অফিসে দেরি মানে অসম্মান। আমার গাইড জানান, একবার মাত্র দুই মিনিট দেরি হওয়ায় একজন ট্রেনচালক যাত্রীদের কাছে লিখিত ক্ষমা চেয়েছিলেন। জাপানিরা সুমিমাসেন (দুঃখিত) শব্দটি প্রায়ই ব্যবহার করে-এমনকি ক্ষুদ্র ভুলের জন্যও। বিনয় তাদের সামাজিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একদিন আকিয়াবারার ব্যস্ত রাস্তা পার হওয়ার সময় সামান্য ধাক্কা লাগতেই লোকটি হালকা নুয়ে বলল, সুমিমাসেন। এই একটি শব্দ-দুঃখ প্রকাশ, ধন্যবাদ, সৌজন্য-সবকিছুর প্রকাশ। যেন বিনয়ের এক ভাষা, যা পুরো জাতির মর্মে বেঁচে আছে।
একদিন টোকিওর শিবুয়া ক্রসিংয়ের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে মনে হলো-এ সমাজের সৌন্দর্য আসলে তাদের নীরব নিয়মেই। এরা আইন মানে শাস্তির ভয়ে নয়, সৌন্দর্য্যরে জন্য। শৃঙ্খলা, নীরবতা, পরিচ্ছন্নতা-সব মিলিয়ে জাপান যেন এক চলমান কবিতা, যার প্রতিটি শব্দ সম্মান দিয়ে লেখা। দিনের শেষে টোকিওর আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে মনে হলো, এই শহরটা যেন নিয়মের নয়, শ্রদ্ধার। সময়, নীরবতা, পরিচ্ছন্নতা-সবকিছু তারা ভালোবাসে ভেতর থেকে। এ এক এমন সমাজ, যেখানে শৃঙ্খলা কোনো বাধা নয়, বরং জীবনযাপনের এক নান্দনিক রূপ।
২২ অক্টোবর ২০২৫