ধর্ম অবমাননার অভিযোগে বাউল আবুল সরকারকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ
মানিকগঞ্জে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার বাউলশিল্পী আবুল সরকারের ভক্ত-অনুরাগীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে তিন ভক্ত-অনুরাগীসহ মোট চারজন আহত হয়েছেন। গণমাধ্যমের খবরে দেখা গেছে যে, সম্প্রতি ‘মানিকগঞ্জ জেলার সর্বস্তরের আলেম-ওলামা ও তৌহিদী জনতা’ ব্যানারে থাকা একদল ব্যক্তি এবং আবুল সরকারের ভক্ত-অনুরাগীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার দিন বেলা পৌনে ১১টার দিকে জেলা শহরের দক্ষিণ সেওতা এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। এই ঘটনার সর্বশেষ খবর হলো সংগীত পরিবেশনের সময় ধর্ম অবমাননা ও কটূক্তির অভিযোগে করা মামলায় বাউলশিল্পী আবুল সরকারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন সে কারাগারে।
দেশে বিদেশে প্রতিক্রিয়া
মানিকগঞ্জে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার বাউলশিল্পী আবুল সরকারের ভক্ত-অনুরাগীদের ওপর হামলার ঘটনা দেশের মধ্যেও যেমন তোলপাড় হচ্ছে তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হচ্ছে। বিষয়টি আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ইমেজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছে।
টিআইবি’র প্রতিক্রিয়া
মানিকগঞ্জে বাউল শিল্পী আবুল সরকারের গ্রেপ্তার এবং তাঁর সমর্থকদের ওপর শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন চলাকালে সংঘটিত সমন্বিত মব-হামলা দেশব্যাপী ধর্মীয় সহাবস্থান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যবিরোধী শক্তির ক্রমবর্ধমান বিকাশ, ধর্মান্ধতা ও সংখ্যাগুরুতান্ত্রিক অসহিষ্ণুতার বিপজ্জনক বিস্তৃতির উদ্বেগজনক উদাহরণ। এ ধরনের ঘটনা দেশের ধর্মীয় ও সামাজিক, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও সর্বোপরি মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি চরম হুমকি বলে মন্তব্য করেছে করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে শিল্পীকে দ্রুত গ্রেপ্তার করা হলেও, প্রকাশ্য দিবালোকে সংগঠিত হামলা থেকে আহত বাউল শিল্পীদের রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্কিয় পর্যবেক্ষকের ভূমিকা ও এ প্রসঙ্গে সরকারের নীরবতা আইনের শাসন, মানবাধিকার, মত প্রকাশ ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের সাংবিধানিক অধিকারকে পদদলিত করেছে। বিষয়টিকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা হিসেবে দেখানোর সুযোগ নেই উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ’অবস্থাদৃষ্টে এমন মনে হওয়া অমূলক নয় যে এ ঘটনা একটি সুসংগঠিত কৌশলের অংশ। দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, লোকঐতিহ্য, আধ্যাত্মিক অনুশীলন এবং সংখ্যালঘু বিশ্বাসের ওপর চাপ বিভিন্ন সময়ে সামনে এসেছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, গত বছর কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর এ প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে চলেছে। স্থানীয়ভাবে ধর্মান্ধতানির্ভর আক্রমণাত্মক ব্যানারের পেছনে সক্রিয় শক্তিগুলো কার্যত ধর্মীয় বৈচিত্র্য, গোষ্ঠীগত ভিন্নমত, সাংস্কৃতিক বহুত্ব, লোকায়ত ও আধ্যাত্মিক বৈচিত্র্যকে দমন করার উগ্র মিশন চালাচ্ছে। বিভিন্ন জেলায় মাজার ভাঙচুর, কবর থেকে মৃত পীরের দেহ উত্তোলন ও অগ্নিসংযোগ, বাউল আসর বন্ধ, বাদ্যযন্ত্র জব্দ, গ্রামীণ মেলা, নাটক বন্ধ করা, ভিন্নমতের প্রকাশ্য হেনস্তার মতো ঘটনা নিয়মে পরিণত হয়েছে। সরকার নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে ধর্মান্ধ, উগ্র ও অশোভন তৎপরতার প্রতি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। কেন- এ প্রশ্নের যেমন জবাব পাওয়া যায়নি, তেমনি ধর্মান্ধ মহলের উগ্রচাপের মুখে সরকারি প্রাথমিক স্কুলে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত কেন বাতিল করে এ ধরনের অপশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করলো, তারও কোনো সদুত্তর নেই। এর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, সরকারের নীরবতা এবং দুর্বল আইনপ্রয়োগ একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় তোষণ হিসেবে ব্যবহার করছে। এমতাবস্থায়, অবিলম্বে বাউলদের ওপর হামলাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শান্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সাংবিধান অঙ্গীকারের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রমাণ রাখতে আহ্বান জানাই আমরা।’ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘চিন্ত ও বিবেকের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ বৈচিত্র্যপূর্ণ লোকায়ত সংস্কৃতি চর্চা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ, ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা বহুমুখী চাপে প্রতিনিয়ত ভূলুন্ঠিত হচ্ছে। মানিকগঞ্জের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, হামলার মুহূর্তে পুলিশ দৃশ্যত অনাগ্রহী ও পর্যবেক্ষক ভূমিকায় অবস্থান করেছে-যা পরিস্থিতিকে আরো গুরুতর করে তোলে। প্রকাশ্য হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর দৃশ্যমান অনীহা ও সরকারের নীরবতাকে গোষ্ঠীগত সহিংসতার একটি অনানুষ্ঠানিক অনুমোদন হিসেবে ব্যাখ্যা করার ঝুঁকি তৈরি করে।
ফরহাদ মজহারের হুঁশিয়ারি
মানিকগঞ্জে বাউল সম্মেলনের ঘোষণা দিয়ে ‘পেটালে পিটুনি খাব’ বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন কবি-চিন্তক ফরহাদ মজহার। বললেন, একটা শিক্ষা দিয়ে যাব।’ পালাকার আবুল সরকারের মুক্তির দাবি এবং মানিকগঞ্জে বাউলশিল্পীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ২৪ নভেম্বর সোমবার ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। সিধুগুরুভক্ত ও ওলি-আওলিয়া আশেকান পরিষদের ডাকে এই সমাবেশ হয়। এতে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘মানিকগঞ্জে যারা এই নিরীহ বাউলদের পেটাচ্ছেন, আমি থাকব, আমাকে পেটাবেন, আমি পিটুনি খাব। আমরা প্রতিহিংসা করি না। কিন্তু আপনাদের একটা শিক্ষা দিয়ে যাব।’ এই সময় ফরহাদ মজহার আরও বলেন, ‘আপনারা যেটাকে ইসলামের নামে চালাচ্ছেন, এর সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। আপনি নিজে মনে করেন ঠিক, এটাই মনে করতেছেন কোরআনে আছে, এটাই ভাবতেছেন হাদিসে আছে। এগুলা নেই।’ সহিংসতা ইসলামের পথ নয় মন্তব্য করে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘যারা নিরীহ মানুষের ওপর জুলুম করে, সহিংসতা করে, তারা কখনোই রসুলের উম্মত হিসেবে নিজেকে দাবি করতে পারে না। ফলে আমি আপনাদের সকলকে অনুরোধ করব, আজ যেভাবে আমাদের ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে একটা শক্তিশালী ধর্মবাদী ফ্যাসিস্ট ধারা হামলা করছে, আমাদের সঙ্গে থাকুন, আমাদের সঙ্গে এই লড়াইটা চালিয়ে যান।’
আসকের প্রতিবাদ
মানিকগঞ্জে বাউল শিল্পীকে গ্রেফতারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার ভক্ত ও অনুরাগীদের আয়োজিত শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনে “তৌহিদি জনতা” পরিচয়ে একদল লোকের হামলা, মারধর ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনায় আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) গভীর উদ্বেগ ও নিন্দা জানাচ্ছে। শান্তিপূর্ণ মতপ্রকাশের অধিকার ও গণজমায়েতে হামলা করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়; বরং এটি সংবিধান স্বীকৃত নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের সুস্পষ্ট উদাহরণ।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৭ ও ৩৯ অনুচ্ছেদে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার এবং সংস্কৃতি চর্চার স্বাধীনতা সুস্পষ্টভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে। বাউল ঐতিহ্যসহ দেশের সকল সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক ধারা রক্ষা করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কোনো গোষ্ঠীর মতাদর্শিক অবস্থান বা সামাজিক চাপের অজুহাতে শিল্প-সংস্কৃতির ওপর হামলা বা বাধা দেওয়ার প্রচেষ্টা আইন ও মানবাধিকারের পরিপন্থী। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) লক্ষ করছে যে, সম্প্রতি সময়ে বাউল শিল্পী ও সংস্কৃতি কর্মীদের উপর হুমকি ও হামলার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় কার্যকর ও সময়োপযোগী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় দেশে শিল্প সংস্কৃতি বিরোধী গোষ্ঠী আরও উৎসাহিত হয়ে উঠছে এবং একই সঙ্গে হামলার ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটছে। চলমান এই প্রবণতা আইনের শাসন, মানবাধিকার সুরক্ষা ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার জন্য গভীর হুমকি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
ভুল বার্তা যাচ্ছে দেশের বাইরে
এদিকে দেশের ভেতরে এই ধরণের ঘটনা যেমন তোলপাড় তেমনি দেশের বাইরেও না নানান ধরণের গুঞ্জন রয়েছে এনিয়ে। প্রতিবেশী দেশের একটি প্রতিক্রিয়া বেশ গুরুত্ব দিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে। এতে নিউজের হেডিং এ বলা হয়েছে ‘আক্রান্ত বাউল-ভক্তেরা’।
অন্যদিকে আরেকটি পত্রিকায় তথ্য দেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশে উগ্রপন্থীদের হামলা ও হুমকির মুখে গত আড়াই মাসে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে একের পর বাউল গানের অনুষ্ঠান পন্ড হয়ে গেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের থেকে নিয়ে তথ্য তুলে ধরে বলা হয় যে, “অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত দেশে ৩২১ টি বাউল অনুষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে ঢাকা বিভাগে; ৯১ টি”। বলা হচ্ছে যে, এই সময়ের মধ্যে ময়মনসিংহে ৩৪, খুলনায় ৩৯, রংপুরে ৩৩, চট্টগ্রামে ৩৭, রাজশাহীতে ৩৩, বরিশালে ১৭ এবং সিলেটে ৩৭টি বাউল অনুষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। কোনো কোনো গণমাধ্যমে লেখা হচ্ছে ‘ঢুকছে ধর্মীয় মৌলবাদ, সঙ্গে রাজনৈতিক মদত, বিপদে বাউল-ফকিররা” । বলা হচ্ছে এপর্যন্ত কয়েশ মাজার উগ্রপন্থীরা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি পবিত্র রমজান মাসেও মাজার ও ওরসে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট থেমে থাকেনি। নেত্রকোনায় একটি মাজারে ওরস হওয়ার কথা ছিল। ৬৪ বছর ধরে ওরসটি হয়ে আসছে। রমজান মাসের কারণে ওরসের আয়োজনও সীমিত করে শুধু দোয়া-মাহফিলের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। এরপরও স্থানীয় কথিত গোষ্ঠীর মন গলেনি। হামলা চালিয়ে সবকিছু ভন্ডুল করে দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এসব ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মারাত্মকভাবে দাগ ফেলবে। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার রক্তঝরা আন্দোলনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। বলা হচ্ছে এই আন্দোলনের পরই দেশে উগ্রবাদি মৌলবাদিরা চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। অভিযোগের আঙ্গুল তোলা হচ্ছে ফ্যাসীবাদের পতরে পেছনে মৌলবাদীদের তৎপরতা ছিল। তাদের মদদেই এখন মাজার, মন্দির ও বাউলদের ওপর হামলা ভাঙ্গুর হচ্ছে। দেশের বাইরে থাকার অনেক বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আকুল আবেদ জানাচ্ছে। বিদেশে অবস্থানরত শিক্ষার্থীসহ প্রবাসী বাংলাদেশীরা বলছেন, দেশের ভেতরে এসব ঘটনা বেড়ে যাওয়া তারা বিপাকে পড়েছে। বলা হচ্ছে বাংলাদেশে মৌলবাদ ঘাটি গেড়েছে, যার পেছনে মৌলবাদীরা আছে। ফলে বাংলাদেশ সর্ম্পকে এমন ভুল বার্তা অনেককে বিভ্রান্ত করছে, দেশের বাইরে তাদের কার্যক্ষেত্র সীমিত হয়ে যাচ্ছে।