২৮ নভেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০২:৫২:২৯ পূর্বাহ্ন


নিউইয়র্কে গোপন অনলাইন মূল্যবৃদ্ধি রোধে প্রথম ‘সার্ভিল্যান্স প্রাইসিং’ আইন কার্যকর
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৬-১১-২০২৫
নিউইয়র্কে গোপন অনলাইন মূল্যবৃদ্ধি রোধে প্রথম ‘সার্ভিল্যান্স প্রাইসিং’ আইন কার্যকর নিউইয়র্কবাসীকে গোপন অনলাইন মূল্যবৃদ্ধির হাত থেকে রক্ষা করতে শীর্ষস্থানীয় নজরদারি মূল্য নীতি আইন কার্যকর ঘোষণা করেছেন গভর্নর হোচুল


নিউইয়র্কে অনলাইন কেনাকাটায় গোপন মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে সার্ভিল্যান্স প্রাইসিং প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম আইন কার্যকর করেছে গভর্নর ক্যাথি হোচুল। হলিডে ও ছুটির মৌসুমকে সামনে রেখে কার্যকর হওয়া জেনারেল বিজনেস ল’ ৩৪৯-এ-এর এই নতুন বিধান অনুযায়ী, এখন থেকে অনলাইন খুচরা ব্যবসায়ীরা স্পষ্টভাবে জানাতে বাধ্য যে কোনো পণ্যের দাম গ্রাহকের ব্যক্তিগত ডেটা ব্যবহার করে অ্যালগরিদমের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে কি না। গভর্নর হোচুল বলেন, ব্যস্ত ছুটির মৌসুমে নিউইয়র্কবাসী অনলাইনে কেনাকাটার সময় সঠিক দাম পাওয়ার নিশ্চয়তা চান। এই আইন লুকানো অ্যালগরিদমিক মূল্য নির্ধারণের মতো কৌশল উন্মোচন করবে। ব্যক্তিগত ডেটার ভিত্তিতে যখন দামের হিসাব করা হয়, তখন গ্রাহককে তা জানাতে বাধ্য করা হবে যাতে তারা সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং নিজেদের উপার্জিত অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করতে পারেন।

আজকের ডিজিটাল অর্থনীতিতে ভোক্তারা ব্রাউজিং ইতিহাস, অবস্থান, ক্রয়-আচরণসহ বিপুল পরিমাণ তথ্য অনলাইনে শেয়ার করেন। করপোরেশনগুলো এই বিপুল ডেটা সংগ্রহ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমের মাধ্যমে এমন মূল্য নির্ধারণ করে যা প্রতিটি ব্যক্তির যতটা দিতে রাজি, ততটাই দিতে হবে এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে। এভাবে একই পণ্যের জন্য দু’জন গ্রাহককে সম্পূর্ণ ভিন্ন দাম দিতে হতে পারে। ফেডারেল ট্রেড কমিশন এই পদ্ধতিকে সার্ভিল্যান্স প্রাইসিং নামে চিহ্নিত করেছে।

এ ধরনের অস্বচ্ছ মূল্য নির্ধারণ গ্রাহকদের তুলনামূলক বাজার বিশ্লেষণের সুযোগ কমিয়ে দেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, একই বিমানে পাশাপাশি বসা দুজন যাত্রীর একজনকে বেশি ভাড়া দিতে হয়েছে কারণ তার ওয়েব সার্চ দেখাচ্ছিল তিনি সম্ভবত জরুরি পারিবারিক কাজে ভ্রমণ করছেন। আবার এক মা অনলাইনে শিশুর অসুস্থতা নিয়ে তথ্য অনুসন্ধান করায় বেবি-কেয়ার পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং বৃহৎ অ্যালগরিদমিক মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থারই অংশ।

ফেডারেল ট্রেড কমিশনের প্রতিবেদন দেখায়, স্ট্যাপলস একসময় গ্রাহকের অবস্থান অনুযায়ী দাম বাড়িয়েছিল, যখন দেখা গেছে ওই এলাকায় কম বিকল্প রয়েছে। অ্যামাজনও লাখ লাখ ব্যক্তিগত ডেটার ওপর ভিত্তি করে মিনিটে মিনিটে দামের পরিবর্তন ঘটায়-প্রতিদিন প্রায় ২৫ লাখবার মূল্য সংশোধন করা হয়। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যক্তিগতকৃত মূল্য এয়ারলাইন শিল্পে আয় ৪-৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায়, যা বছরে ৭ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে নিউইয়র্ক অ্যালগরিদমিক মূল্য বৈষম্য বন্ধে পথপ্রদর্শক হতে চাইছে। গভর্নর হোচুলের সমর্থনে আনা প্রিভেন্টিং অ্যালগরিদমিক ডিসক্রিমিনেশন প্রাইসিং অ্যাক্টএ ৬৭৬৫/এস ৭০৩৩-এর মাধ্যমে অনলাইন খুচরা বিক্রেতাদের পণ্যের দামের ঠিক পাশে স্পষ্টভাবে লিখতে হবে: এই দামটি আপনার ব্যক্তিগত ডেটা ব্যবহার করে অ্যালগরিদম দ্বারা নির্ধারিত। আইনটি সংবেদনশীল তথ্য যেমন-লিঙ্গ, জাতিগত পরিচয়, বয়স, গর্ভাবস্থা ইত্যাদি-মূল্য নির্ধারণে ব্যবহার নিষিদ্ধ করবে। পাশাপাশি অ্যাটর্নি জেনারেলের দফতরকে তদন্ত ও জরিমানা আরোপের ক্ষমতা দেবে, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান আইন না মানে।

গোপন অ্যালগরিদমিক মূল্যবৈষম্য যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েই চলেছে। এরই মধ্যে ওয়াশিংটনে বহু ভোক্তা সুরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায়, নিউইয়র্ক নতুন করে শক্ত অবস্থান নিতে চাইছে। গভর্নর হোচুলের মতে, গ্রাহকদের প্রোফাইল করে বেশি দাম নেওয়া চলতে পারে না। এটি ডিজিটাল অর্থনীতির প্রতি আস্থা নষ্ট করে। নতুন আইন কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে নিউইয়র্ক আবারও বহুত্ববাদ, স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও ভোক্তা সুরক্ষায় জাতীয় নেতৃত্বের অবস্থান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করল। এখন দেখার বিষয়, অন্যান্য রাজ্যও কি এই পথ অনুসরণ করে অনলাইন বাজারে স্বচ্ছমূল্য নির্ধারণ নিশ্চিত করতে এগিয়ে আসে।

অ্যালগরিদমিক মূল্যবৃদ্ধি কীভাবে হয়

একই বিমানে পাশাপাশি বসা দুই যাত্রী। একই এয়ারলাইন, একই রুট-কিন্তু একজনকে টিকিটের জন্য ১০০ ডলার বেশি দিতে হয়েছে। কারণ তার ওয়েব সার্চ ইতিহাসে দেখা গেছে, তিনি শোকসভায় যোগ দিতে জরুরি ভ্রমণের পরিকল্পনা করছেন। আবার এক মায়ের শিশুর অসুস্থতা নিয়ে সার্চ করার কারণে অনলাইনে বেবি–সাপ্লাই কেনার সময় দাম বেড়ে গেছে। এগুলো কোনো বিরল ঘটনা নয়; বরং ‘সার্ভিল্যান্স প্রাইসিং’ নামে পরিচিত গোপন মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থার অংশ, যা প্রতিদিন লাখো গ্রাহকের অজান্তে কার্যকর হয়। ডিজিটাল যুগের করপোরেশনগুলো জটিল অ্যালগরিদম ব্যবহার করে গ্রাহকের ব্রাউজিং ইতিহাস, অবস্থান, দিনের সময়, এমনকি ব্যবহৃত ডিভাইস পর্যন্ত বিশ্লেষণ করে একই পণ্যের জন্য ব্যক্তিভেদে আলাদা দাম ধার্য করে। কখনো কয়েক সেন্ট, কখনো আবার কয়েকশ ডলার পর্যন্ত পার্থক্য দেখা যায়। বাজারের চাহিদা সরবরাহ নয়, বরং ব্যক্তিগত তথ্যই হয়ে দাঁড়ায় মূল্য নির্ধারণের মূলভিত্তি।

ব্যবসায়ীরা যে কৌশলে ব্যক্তিগত ডেটা ব্যবহার করে দাম বাড়ায়

ফেডারেল ট্রেড কমিশনের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সার্ভিল্যান্স প্রাইসিং কোনো ‘কাল্পনিক সমস্যা’ নয়। উদাহরণ হিসেবে স্ট্যাপলস একই স্ট্যাপলারের জন্য বেশি দাম ধার্য করেছিল যখন তাদের ডেটা জানায় যে গ্রাহকটির এলাকায় বিকল্প দোকান কম। আবার অ্যামাজন প্রতিদিন প্রায় ২৫ লাখ দামের পরিবর্তন ঘটায় এবং প্রতিটি পরিবর্তনের পেছনেই কাজ করে গ্রাহকের অবস্থান, ব্রাউজিং অভ্যাস ও ক্রয় ইতিহাসের মতো তথ্য। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, শুধু ব্যক্তিগতকৃত মূল্য নির্ধারণের কারণে এয়ারলাইন শিল্প বছরে ৭ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়তি আয় করছে। অর্থাৎ ভোক্তার তথ্যই হয়ে উঠছে মুনাফা বাড়ানোর হাতিয়ার। ফলে ভোক্তার কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না, থাকেন ক্ষমতাহীন।

শেয়ার করুন