২৮ নভেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৪:২০:২১ পূর্বাহ্ন


মসজিদে হুমকির অভিযোগে কেনেথ গ্যার্কে গ্রেফতার
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-১১-২০২৫
মসজিদে হুমকির অভিযোগে কেনেথ গ্যার্কে গ্রেফতার ইসলামিক ইনস্টিটিউট অব আমেরিকা, (ইনসেটে) কেনেথ গ্যার্কে


মিশিগানের গ্র্যান্ড ব্ল্যাঙ্ক টাউনশিপের ল্যাটার-ডে সেইন্টস চার্চে নৃশংস হামলার মাত্র একদিন পরই ডিয়ারবর্ন হাইটসের ফোর্ড রোড ও কিনলক স্ট্রিটের কাছে অবস্থিত ইসলামিক ইনস্টিটিউট অব আমেরিকা মসজিদে নতুন করে সহিংসতার আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর মসজিদের ঠিকানায় একটি হুমকিমূলক বার্তা পাঠানো হলে স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। ঘটনার পর দ্রুত তদন্ত নামে ডিয়ারবর্ন হাইটস পুলিশ বিভাগ। অবশেষে প্রায় ছয় সপ্তাহব্যাপী অনুসন্ধান, মিশিগান ও ইলিনয় দুই অঙ্গরাজ্যের যৌথ অভিযান এবং ফেডারেল তদন্তকারী এজেন্সি এফবিআই’র সহযোগিতায় ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের এলজিন শহরের বাসিন্দা ৬৩ বছর বয়সী কেনেথ গ্যার্কেকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্যার্কেকে গত ১০ নভেম্বর ডিয়ারবর্ন হাইটস পুলিশ মিশিগান অ্যাভিনিউয়ের ২৫৬৩৭ নম্বর এলাকা থেকে আটক করে। পরে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাসী হুমকি প্রদান, হেট ক্রাইম এবং অ্যাগ্রাভেটেড স্টকিং। ঘটনাটি দেশব্যাপী উপাসনালয়গুলোতে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে। ডিয়ারবর্ন হাইটস পুলিশ জানায়, ২৯ সেপ্টেম্বর সকালে মসজিদ কর্তৃপক্ষ একটি অজ্ঞাত নম্বর থেকে আসা বার্তা পান, যাতে সহিংসতার ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করা হয়। বার্তাটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মসজিদ প্রশাসন পুলিশকে অবহিত করলে কয়েক মিনিটের মধ্যে অফিসাররা ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রাথমিক প্রতিবেদন নথিভুক্ত করেন। হুমকির সুনির্দিষ্ট ভাষা তদন্তের স্বার্থে প্রকাশ না করলেও পুলিশ বলে, বার্তাটি যথেষ্ট উদ্বেগজনক ছিল এবং সরাসরি নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম। এ কারণেই ঘটনাটি সঙ্গে সঙ্গে ডিয়ারবর্ন হাইটস পুলিশ বিভাগের ডিটেকটিভ ব্যুরোতে হস্তান্তর করা হয়। ডিটেকটিভরা বার্তার উৎস বিশ্লেষণ করতে ডিজিটাল ফরেনসিক টিমকে যুক্ত করেন। তদন্তের প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তারা নিশ্চিত হন, বার্তাটি এসেছে ইলিনয়ের এলজিন শহর থেকে। এরপরই দুই অঙ্গরাজ্যের মধ্যে সমন্বিত তদন্ত শুরু হয়।

ডিয়ারবর্ন হাইটস পুলিশ এলজিন পুলিশ বিভাগকে সম্ভাব্য সন্দেহভাজন সম্পর্কে তথ্য পাঠায়। তাদের অনুরোধে এলজিন পুলিশ গ্যার্কের ঠিকানায় যান এবং তার বাড়িতে গিয়ে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ ও অনুসন্ধান চালান। এ সময় তারা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পান, যা পরে শনাক্তকরণ প্রক্রিয়াকে সহজ করে। তদন্তকারীরা ডিজিটাল রেকর্ড, বার্তার উৎস ও সময়সূচি মিলিয়ে দেখেন। এতে স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় যে, বার্তাটি গ্যার্কের অবস্থান থেকে পাঠানো হয়েছে। পরে এফবিআইও তদন্তে যুক্ত হয়, কারণ ঘটনাটি আন্তঃঅঙ্গরাজ্য হুমকি এবং এতে ধর্মীয় ঘৃণার সম্ভাবনা রয়েছে। ডিয়ারবর্ন হাইটস পুলিশের পক্ষ থেকে সংগৃহীত সব তথ্য ও প্রমাণ ওয়েইন কাউন্টি প্রসিকিউটরস অফিসে পাঠানো হয়। তারা অভিযোগের যথেষ্ট ভিত্তি রয়েছে বলে নিশ্চিত হয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। তার পর কয়েক দিনের মধ্যেই গ্যার্কে নিজে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তবে পরে তাকে ডিয়ারবর্ন হাইটসে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেফতার করা হয়।

পুলিশ জানিয়েছে, গ্যার্কের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো অত্যন্ত গুরুতর। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-সন্ত্রাসী হুমকি বা মিথ্যা রিপোর্ট, বলপ্রয়োগ, শারীরিক ক্ষতি বা স্টকিংয়ের উদ্দেশে হেট ক্রাইম, ও অ্যাগ্রাভেটেড স্টকিং (ফেলনি)। প্রসিকিউটররা বলেন, উপাসনালয়ে সহিংসতার হুমকি শুধু একটি সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে না, বরং জনসাধারণের মধ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করে। এ ধরনের অভিযোগের ক্ষেত্রে শাস্তি সাধারণত কঠোর হয়।

ডিয়ারবর্ন হাইটস পুলিশ প্রধান আহমেদ হায়দার এক বিবৃতিতে বলেন, আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে সন্দেহভাজনকে শনাক্ত করে সফলভাবে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। এই তদন্তে স্থানীয়, কাউন্টি, স্টেট এবং ফেডারেল সংস্থার অসাধারণ সমন্বয় কাজ করেছে। আমাদের কমিউনিটির নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। সার্জেন্ট আহমাদ মাজলুম ও তার টিমকে আমি বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তিনি আরো উল্লেখ করেন, ধর্মীয় উপাসনালয়ে হুমকি কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না এবং সেই অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

হুমকির এই ঘটনা ঘটে এমন এক সময়ে যখন মিশিগান জুড়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরাপত্তা নিয়ে অস্বস্তি বাড়ছিল। ২৮ সেপ্টেম্বর, ডিয়েরবর্ন হাইটসের ঘটনার মাত্র একদিন আগে, গ্র‍্যান্ড ব্ল্যাঙ্ক টাউনশিপে এক ব্যক্তি ট্রাক নিয়ে একটি গির্জায় ঢুকে ভবনে আগুন লাগান এবং পরে গুলি করে বেশ কয়েকজনকে হত্যা করেন। এফবিআই পরে জানায়, ওই হামলাকারীর উদ্দেশ্য ছিল মরমন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি গভীর বিদ্বেষ। হামলাকারী পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এই ঘটনার পর বিভিন্ন উপাসনালয়ে পুলিশি টহল বাড়ানো হয় এবং সতর্কতা জারি করা হয়। ধর্মীয় ঘৃণা ও সন্ত্রাসী হুমকির ক্রমবর্ধমান প্রবণতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কমিউনিটি লিডাররা বলেন, এমন পরিস্থিতিতে নীতিনির্ধারক এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে আরো কঠোর ও সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

ডিয়ারবর্ন হাইটসের মুসলিম সম্প্রদায় স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে জানান, ঘটনাটি তাদের গভীরভাবে আতঙ্কিত করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মসজিদ কর্মকর্তা বলেন, গির্জায় যখন বড় ধরনের হামলা হলো, তার পরদিন আমাদের মসজিদে হুমকি পাওয়া সত্যিই খুব ভয়ের। আমরা শুধু নিরাপদে আমাদের ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করতে চাই। কমিউনিটি লিডাররা পুলিশকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন যে, দ্রুত পদক্ষেপের কারণে সম্ভাব্য বড় ধরনের বিপদ এড়ানো গেছে।

তদন্ত এখনো চলমান ডিয়ারবর্ন হাইটস পুলিশ ও এফবিআই জানিয়েছে, গ্যার্কে কি এককভাবে হুমকি দিয়েছিলেন নাকি তার পেছনে আর কেউ ছিল-তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তার ডিজিটাল ডিভাইস, ফোন রেকর্ড ও অনলাইন কার্যক্রম পরীক্ষা করা হচ্ছে। পুলিশ আরো জানায়, হুমকি বাস্তবায়নের কোনো প্রস্তুতির প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি, তবে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সব সম্ভাবনা বিবেচনায় রাখা হচ্ছে।

মিশিগান ও ইলিনয়ে দুই অঙ্গরাজ্যের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সমন্বিত পদক্ষেপের ফলে ডিয়ারবর্ন হাইটসের মসজিদে সম্ভাব্য সহিংসতার হুমকি মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে। ২৯ সেপ্টেম্বরের হুমকি, ১০ নভেম্বর গ্রেফতার, এই পুরো ঘটনাপ্রবাহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, তারই একটি প্রতিচ্ছবি।

শেয়ার করুন