০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, শনিবার, ১০:৫২:৪৪ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
বিশ্বকাপের ড্র অনুষ্টিত , সহজ গ্রুপে ব্রাজিল - যুক্তরাষ্ট্র ডি গ্রুপে স্ন্যাপ সুবিধা ফিরলেও কঠোর নিয়মে বিপাকে ৪০ মিলিয়ন মানুষ মসজিদে ধারাবাহিক হামলা, উদ্বেগে মুসলিম সম্প্রদায় ফেব্রুয়ারি ১ থেকে রিয়েল আইডি ছাড়া বিমানযাত্রায় লাগবে ৪৫ ডলারের ফি নিউইয়র্কে শীতকালে ঘর গরম রাখার জন্য এনার্জি সহায়তার আবেদন শুরু দারিদ্র্যপীড়িত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থায়ীভাবে বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের ১৯ দেশের গ্রিনকার্ডধারীদের পুনর্মূল্যায়ন শুরু তারেকের ‘ফেরা ইস্যু’ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে চেষ্টা বিডিআর বিদ্রোহের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কমিশন রিপোর্টে তোলপাড় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মর্যাদায় খালেদা জিয়া


সাহিত্য একাডেমির যুগ পূর্তি
পলি শাহীনা:
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩০-১১-২০২২
সাহিত্য একাডেমির যুগ পূর্তি সাহিত্য একাডেমির অনুষ্ঠানে কবি, সাহিত্যিক ও লেখকরা



গত ২৫ এবং ২৬ নভেম্বর যথাক্রমে গুলশান ট্যারেস ও জুইশ সেন্টারে ’সাহিত্য একাডেমি নিউইয়র্ক’র দুই দিনব্যাপী  যুগ পূর্তি আয়োজনটি সম্পূর্ণ হয়। প্রথম দিনের অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন আবৃত্তিকার মুমু আনসারী ও আনোয়ারুল হক লাভলু। আগত অতিথিদেরকে ফুলেল শুভেচ্ছায় বরণ করা হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল মুক্তিযোদ্ধা, ভাষা সৈনিক, বীরাঙ্গনাদের স্মরণ করা হয় শ্রদ্ধার সঙ্গে। স্মরণ করা হয় করোনা মহামারিতে যাঁদের হারিয়েছি তাঁদেরকে, তাঁদের আত্মার চিরশান্তি কামনা করা হয়। 

লেখক রাণু ফেরদৌসের পরিচালনায় যুগ পূর্তির কেক কাটেন সাংবাদিক মোহাম্মদ উল্লাহ এবং তরুণ প্রজন্মের সাফওয়ান নাহিন। তাঁদের সঙ্গে এই আনন্দ আয়োজনে উপস্থিত অন্যরাও যোগ দেন। 

সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, সাহিত্য একাডেমির এই যুগ পূর্তি একটি বিরাট অর্জন। এই প্রবাসে নিয়মতান্ত্রিকভাবে স্বদেশীয় ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে যাওয়াটা খুব সহজ নয়। মান্না দে’র বিখ্যাত  ’কফি হাউজের সে আড্ডাটা আজ আর নেই’ গানের লাইনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আমাদের সাহিত্য একাডেমি যেন দীর্ঘজীবী হয়। আমরা যেদিন থাকবো না সেদিনও যেন সাহিত্য একাডেমির সাহিত্য আসর বহাল থাকে। উত্তর আমেরিকার লেখক, সাহিত্যপ্রেমী তথা সকল বাঙালি সাহিত্য একাডেমির কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। লেখকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, রেসিজম, প্রবাসীদের জীবন সংগ্রাম এবং আদিবাসীদের কথা যেন তাদের সাহিত্যে উঠে আসে। 

লেখক ফেরদৌস সাজেদীন সকলকে প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, প্রচলিত একটি কথা আছে, সময় ও ¯্রােত কারো জন্য অপেক্ষা করে না, কিন্তু মাঝেমধ্যে এর উল্টোটাও হয়, কখনো কখনো সময় থমকে যায়। পুরনো কোন অঞ্চলে হঠাৎ করে গেলে চেনা রাস্তা সময়কে থমকে দেয়। পুরনো এলবাম, পুরনো দৃশ্য দেখলে সময় থমকে যায়। আজকে সাহিত্য একাডেমির এই যুগ পূর্তিতে আমাদের সময় আগামীতে কোন একদিন থমকে যাবে। আর এই থমকে যাওয়ার অংশীদারত্বে আমরা সকলে থাকবো। সৃজনশীলতা যার যার একান্ত তার তার। সাহিত্য একাডেমির প্রধান কাজ হচ্ছে যারা লেখালেখি করে তাদেরকে একটু নাড়া দেয়া, আন্দোলিত করা, অনুপ্রাণিত করা। গত বারো বছর ধরে লেখকরা যেভাবে সাহিত্য একাডেমিতে এসে অনুপ্রাণিত হয়ে এসেছে, একইভাবে সামনের দিনগুলোতেও হবে। 

সংগীত অনুষ্ঠানের শুরুতে নতুন প্রজন্মের মুন জাবিন হাই’র কবিতা আবৃত্তি সকলে তন্ময় হয়ে শুনেছে। কন্ঠশিল্পী শাহ মাহবুব, ম্যারিষ্টলা আহমেদ শ্যামলী, রূপাই, আলভান চৌধুরী ও সবিতা দাসের দেশাত্মবোধক গান, রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত সহ অন্যান্য গানগুলো উপস্থিত সকলকে নস্টালজিক করে তুলেছে। সম্মিলিতভাবে জাতীয় সংগীত এবং নৈশ ভোজের মধ্য দিয়ে প্রথম দিনের আয়োজন শেষ হয়। 

সাহিত্য একাডেমির দ্বিতীয় দিনের আয়োজনের উদ্বোধন করেন  মুক্তিযোদ্ধা ও একুশে পদক প্রাপ্ত লেখক ডক্টর নুরুন্নবী। সাহিত্য একাডেমিকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, সাহিত্য একাডেমি একটি মহাকাজ করে যাচ্ছে। বিদেশের মাটিতে একটি সাহিত্য সংগঠন নিয়মিতভাবে বারো বছর ধরে চালিয়ে নেয়া একটা বিরাট অর্জন। একটি সংগঠন পরিচালনা করা যে কী কঠিন সে অভিজ্ঞতাও আছে। প্রবাসে লেখকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, নতুন গল্প, কবিতা, উপন্যাস পাচ্ছি, এটি আনন্দের বিষয়। নিউইয়র্ক বইমেলা, ডিসি বইমেলা, টরেন্টো বইমেলার কথা উল্লেখ করে বলেন, ভবিষ্যৎতে হয়ত অন্যান্য অঞ্চলেও বইমেলা হবে, এবং এগুলো পরস্পরের সহযোগী হবে। এই আয়োজনগুলোর মধ্য দিয়ে লেখালেখির সম্প্রসারণ ঘটবে। 

কবি মিশুক সেলিম ও রওশন হাসানের সঞ্চালনায় বইএর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে ২০২২ এ প্রকাশিত লেখকদের বইএর মোড়ক উন্মোচন করা হয়। 

সাহিত্যে সংকট ও সম্ভাবনা বিষয়টি নিয়ে কবি এবিএম সালেহ উদ্দিনের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন, লেখক হাসান ফেরদৌস, সাংবাদিক মোহাম্মদ ফজলুর রহমান ও পলি শাহীনা। 

কবি বেনজির শিকদারের সঞ্চালনায় স্বরচিত কবিতা পাঠ প্রথম পর্বের সূচনা বক্তব্যে কবি তমিজ উদদীন লোদী বলেন, রসায়ন শাস্ত্র কিনা পদার্থ বিজ্ঞানের মতো কবিতার যদি নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা থাকতো, খুব ভালো হতো। এও ঠিক নির্দিষ্ট সংজ্ঞা থাকলে কবিতা বিষয়ে পরস্পর বিপরীতধর্মী অনেক কিছু জানা হতো না। যেমন, সাত্রে বলেছেন, কবিতায় কোন অর্থ খুঁজতে যেও না, অর্থ খুঁজতে গেলে অনর্থ বাঁধবে। কবিতায় খুঁজবেন, কান আছে শুনবেন, মনের চোখে কবিতা অনুধাবন করবেন। অন্যদিকে ব্যালেরি বলছেন, না, অর্থের যেমন প্রয়োজন নেই, ছন্দের কিংবা শব্দেরও প্রয়োজন নেই কবিতায়। তিনি বলেছেন, সিলেবল এবং ছন্দের বৈচিত্র খুঁজতে হবে কবিতায়। আবার মালার্মি বলেছেন, শব্দই হবে আসলে কবিতা। শব্দ দিয়েই কবিতা রচিত হবে। শব্দের সন্নিবেশই হলো কবিতা। তাই বলে আমরা কবিতার ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হবো? না, মোটেও না। ছন্দ সহ যেমন কবিতা লিখছি, পড়ছি, ছন্দ ছাড়াও কবিতাও পড়ছি। কবিতা আসলে কবিতা হয়ে উঠলো কী না সেটাই বিবেচ্য বিষয়, সেটি ছন্দ সহ হোক, অথবা ছন্দ ছাড়া হোক, কিংবা একেবারে নিটোল গদ্য কবিতা হোক। 

প্রথম পর্বে কবিদের স্বরচিত পাঠ উপস্থিত সকলে মুগ্ধ হয়ে শুনেছেন। ংংএরপর, কবি মিশুক সেলিমের সঞ্চালনায় 'কেন লিখি ' মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন, কবি খালেদ সরফুদ্দীন, লেখক রিমি রুম্মান, কবি ফারহানা ইলিয়াস তুলি, লেখক স্মৃতি ভদ্র ও লেখক মনিজা রহমান। 

আবৃত্তিকার পারভীন সুলতানার সঞ্চালনায় কবিতা আবৃত্তির সূচনা বক্তব্যে আবৃত্তিকার মিথুন আহমেদ বলেন, বারো বছর একটি দীর্ঘ সময়। দীর্ঘ পথ সাহিত্য একাডেমি সাহিত্য নিয়ে কাজ করছে। তাদের কাজ, তাদের পথচলা, সাহিত্য এবং সাহিত্যের জায়গাটি তৈরি করবার প্রতি এই অভিবাস জীবনে তাদের নিষ্ঠা দেখেছি, শুনেছি। ’তোমার অভিসারে যাব অগম পারে’ কবিগুরুর চরণের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, তাঁর কাছে আবৃত্তি হচ্ছে অগম পারের মতো। অগম যেখানে যাওয়া যায় না, কিন্তু যাওয়ার তীব্র ইচ্ছে হয়। আবৃত্তি একটি প্রায়োগিক শিল্প। এই শিল্প সাহিত্যকে কেন্দ্র করে কিংবা বোধ এবং চিন্তারাজ্যে আমাদের যে উপলব্ধি, সে উপলব্ধির সবচেয়ে স্বচ্ছতম, সবচেয়ে বিস্তারিত যে রূপান্তর তাকেই আবৃত্তি শিল্প বলতে বুঝি। আবৃত্তি শিল্পে আমরা চারটি দশক পার করেছি। মধ্য আশি কিংবা প্রারম্ভিক আশির যুগে আমরা যে আবৃত্তি চর্চাটি শুরু করেছি সে আবৃত্তির একধরনের এলায়িত ঢং ছিল, সে ঢংটিকে একটু একটু করে সম্ভবত কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। আবৃত্তির জন্য চর্চাটা খুব প্রয়োজন। শিল্প শেখানো যায় না, কিন্তু শিল্পের কৌশলগুলো রপ্ত করার জন্য চর্চাটা প্রয়োজন। আমরা যখন আবৃত্তি করি শুধু ছন্দ নয়, আমরা বক্তব্য, কথাগুলো যেন পৌঁছে দিতে পারি। 

আবৃত্তিকারদের আবৃত্তি সকলের মনে আনন্দের দোল দিয়ে যায়। 

আবৃত্তিকার নজরুল কবীরের উপস্থাপনায় স্বরচিত কবিতা পাঠ দ্বিতীয় পর্বের সূচনা বক্তব্যে কবি ফকির ইলিয়াস বলেন, লেখালেখির পাশাপাশি যে বিষয়টা আসে সেটি হচ্ছে সাধুসঙ্গ। যারা সাধনা করতে চান তারা সাধুসঙ্গ নেন। সাহিত্য একাডেমি হলো লেখকদের জন্য সাধুসঙ্গের মতো আশ্রম। একটি কবিতার যদি দুই-চারটা লাইন ঘাই না দেয়, কিংবা মননে, চেতনায় যদি কবিতাটি অনুরণন সৃষ্টি করতে না পারে, তাহলে সেটিকে কবিতা মনে করি না। কবিতার ঈর্ষণীয় শক্তি রয়েছে। ’এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ কবি হেলাল হাফিজ এই দুই লাইনের মধ্য দিয়ে আমাদের মননে যা ঢুকিয়ে দিয়েছেন তা অনেক বড় বড় উপন্যাসও পারবে না। কবিতাকে রাবারের মতো টেনে বড় করার দরকার নেই, কবিতা যেখানে শেষ হবে সেখানেই শেষ হওয়া দরকার। 

দ্বিতীয় পর্বের কবিদের স্বরচিত পাঠ সকলকে অপার আনন্দ দিয়েছে। 

লেখক, সাংবাদিক মনজুর আহমেদ বলেন, ২০০১ সালে প্রথম এই দেশে এসে যখন একটি পত্রিকার দায়িত্ব পাই তখন সাহিত্য পাতাটি বের করতে পারি নি। না কবিতা, না গল্প, না গদ্য, কোন লেখাই খুঁজে পেতাম না। আজও একটি পত্রিকার দায়িত্বে আছি। আজ এত লেখা পাই যে এখন সাহিত্য পাতার জন্য লেখা বাছাই করতে হয়। প্রবাসে সাহিত্য চর্চায় বাঙালিদের একটি বড় উত্তরণ ঘটেছে। 

কবি শামস আল মমীন বলেন, হাঁটি হাঁটি পা পা করে সাহিত্য একাডেমি বহুদূর এসেছে। আজ থেকে বারো বছর পর সাহিত্য একাডেমি নিশ্চয়ই আরো ভালো করবে। 

সাংবাদিক নিনি ওয়াহেদ বলেন, কবিতা যেমন কখনো প্রৌঢ হয় না, তেমনি সাহিত্য একাডেমিও আজীবন তরুণ থাকবে। সকলের কবিতা শুনেছি, খুব ভালো লেগেছে। সাহিত্যের প্রতি সকলের আগ্রহ দেখে আপ্লুত হোলাম। এই আগ্রহটাই একদিন তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দিবে। 

শিল্পী তাহমিনা শহীদের গান সকলে অভিভূত হয়ে শুনেছে। 

সাহিত্য একাডেমির দুই দিনব্যাপী আয়োজনের সমাপনী বক্তব্যে লেখক হাসান ফেরদৌস বলেন, লেখকের রচিত সৃষ্টি যেন সকলের হয়ে উঠে। যেমন ’তামাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ কবি শহীদ কাদরীর এই লাইনটি সকলের হয়ে উঠেছে। সম্মিলিতভাবে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে আয়োজনের সমাপ্তি টানা হয়।


শেয়ার করুন