০৪ জুলাই ২০১২, বৃহস্পতিবার, ৬:১৭:০৪ পূর্বাহ্ন


কত রঙ্গ দেখি নিউইয়র্কে
হাবিব রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-০৬-২০২৪
কত রঙ্গ দেখি নিউইয়র্কে হাবিব রহমান


আমরা জানি রঙধনুর সাত রঙ। কিন্তু নিউইয়র্কে কিছু মানুষকে দেখলে মনে হয় তারা যেন রঙের সমুদ্র। ক্ষণে ক্ষণে রঙ পাল্টায়, ভোল পাল্টায়। কত রঙ তাদের জীবনে! সাদা, কালো, লাল, নীল, হলুদ, বেগুনী...কি রঙ নেই তাদের! যেন রঙের মহাসমুদ্র। শুধু রঙ আর রঙ তাদের জীবনে।

দু’সপ্তাহ আগে নিউইয়র্ক উন্মাতাল ছিল ক্রিকেট খেলা নিয়ে। বাংলাদেশিদের খেলা দেখতে নাসাউ কাউন্টির স্টেডিয়ামে লাল সবুজের মেলা বসেছিল। ২০০ ডলারের ওপর টিকেট কেটে, কাজ বন্ধ করে বাংলাদেশিরা হাজির হয়েছিলেন সেখানে। দুঃখজনকভাবে সেদিন হেরেছিল বাংলাদেশ। সবাই বিষণ্ণবদনে ঘরে ফিরেছেন। পরদিন দেখি অনেক পরিচিত মুখের স্ট্যাটাস-বাংলাদেশ হারবে জানি এজন্যই খেলা দেখতে যাইনি। আরে ভাই, আপনি গণক নাকি! তাহলে যে পেশায় আছেন তা বদল করে এই পেশায় নাম লেখান না? গিরগিটি নাকি খোলস বদলায়। আপনি তো দেখি তার চেয়েও খারাপ!

বাংলাদেশ নেদারল্যান্ডকে ক্রিকেটে হারালো। গিরগিটিদের কেউ কেউ নতুন করে স্ট্যাটাস দিলো, আরে নেদারল্যান্ডস একটা দল হলো? অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেখাক না! সর্বশেষ নেপালকে হারিয়ে বাংলাদেশ সুপার এইটে পা রাখলো। তারপরও অনেকের মন্তব্য-অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলে দেখো মজা বুঝবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। আচ্ছা, আমরা এতো কৃপণ কেন। কেন আমরা ভালোকে ভালো বলতে পারি না? আমাদের ছেলেরা যত টুকু ভালো খেলেছে তার মুল্যায়ন করি। সাধুবাদ জানাই। আপনাকে বা আমাকে দিয়ে নয়, তাদের দিতেই নতুন করে বাংলাদেশকে চিনছে পৃথিবী। কেন আমাদের চরিত্রে কেন এতো দৈন্যতা? আসুন না চাঁদের কলঙ্কটাকে না দেখে জ্যোস্নার স্নিগ্ধ আলোটাকে গায়ে লাগাই!

অনেকের মতো সাকিবুল হাসানকে আমারও ভালো লাগে না। তার বেয়াদবি, টাকার পেছনে ছুটা ইত্যাদি নানাবিধ কারণ। তার বেয়াদবি নিয়ে সংবাদপত্রে আমি অনেক বড় বড় ফিচার লিখেছি। কিন্তু নেদারল্যান্ডের সঙ্গে খেলায় রান খরায় থাকা সাকিব যেভাবে জ্বলে উঠলেন, দলকে চ্যালেঞ্জিং পুঁজি পাইয়ে দিতে যে অপরাজিত ফিফটি খেললেন, সেজন্য আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়েছি। কারণ তার খারাপ কাজের জন্য যেমন নিন্দা জানিয়েছি তেমনি ভালো কাজের জন্য অকুণ্ঠ সমর্থনও দিয়েছি। শুধু আমি নই কিছু বর্ণচোরা ছাড়া আরো অনেকেই তা করেছেন।

প্রসঙ্গ : বাংলাদেশ ডে প্যারেড

গত কয়েকদিন আগে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হলো বাংলাদেশ ডে প্যারেড। এ নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। আমি সেদিকে যাবো না। তবে নিউইয়র্কের একটি পত্রিকায় প্যারেডের আয়োজক শাহ শহীদুল হকের একটি সাক্ষাৎকার দেখলাম। তিনি বলেছেন, প্যারেডে ৮০ হাজার ডলার খরচ হয়েছে। অনেকেই কথা দিয়ে কথা রাখেননি। সেজন্য ৪০ হাজার ডলার আমার পকেট থেকে দিতে হয়েছে। আবার আগামী বছর ম্যানহাটনে একই প্যারেড করার ঘোষণা দেন তিনি। আমার প্রশ্ন হলো, আপনার কি দায় পকেট থেকে ৪০ হাজার ডলার ভর্তুকি দেওয়ার? প্রথম প্যারেডে যদি ৪০ হাজার ভর্তুকি দিতে হয়, তাহলে আবার কেন প্যারেডের ঘোষণা? কি মধু এই প্যারেডে?

বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচন

প্রবাসের মাদার সংগঠন হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচনী ডঙ্কা বেজে উঠেছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে তিনমাস পর আগামী অক্টোবরেই সেই নির্বাচন। প্যানেল চূড়ান্ত না হলেও সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পদচারণা বেড়েছে কমিউনিটিতে। নিজেদের পকেটের অর্থ ব্যয় করে ভোটার বানানোর মিশনে নেমেছেন তারা। লাখ লাখ ডলার ব্যয় হবে এই নির্বাচনে। কিন্তু এই নির্বাচনের আউট পুট কি? গেল বার যারা নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন কমিউনিটির জন্য তাদের অর্জন কি? একটা প্যারেডও কি তারা করতে পেরেছেন? চোখে পড়ে এমন অন্য কিছু? তাই যদি না হয় তবে কেন তারা লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ করে একই চেনা মুখ বার বার নির্বাচন যুদ্ধে নামছেন?

হাতে হাতে টিভি, ঘরে ঘরে সাংবাদিক

নিউইয়র্কে আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে সংবাদপত্রের প্রকাশনা। প্রবাসী বিত্তবান ব্যবসায়ীদের কাছে এটা এখন সিম্বল অব প্রেস্টিজ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একটা সংবাদপত্রের জন্য যে ন্যূনতম মানদণ্ড থাকে তার কত টুকু এসবে রক্ষা হচ্ছে। যারা এসব সংবাদপত্রের মালিক মিডিয়ায় সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতা কতটুকু? ক’জন প্রফেশনাল সাংবাদিক তাদের এখানে কাজ করেন। এসব সংবাদপত্রের আউটপুট কি?

সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। পেশা হিসেবে সংবেদনশীলতা সাংবাদিকতাকে অন্য সকল পেশা থেকে আলাদা করেছে। সাংবাদিকতা দেশ ও জাতির দর্পণ স্বরূপ। সাংবাদিকতা যেমনি মানুষের অধিকার রক্ষায় কাজ করে তেমনি এর একটি ভুল সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আনতে পারে চরম দুর্ভোগ। যে কারো হাতে ছুরি কাঁচি তুলে দিয়ে যেমন সার্জন বানিয়ে দেওয়া যায় না, তেমনি যে কারো হাতে পরিচয়পত্র, কলম, ক্যামেরা বোম তুলে দিয়েও সাংবাদিক বানানো যায় না। সাংবাদিকতা শাস্ত্রের পন্ডিতরা মনে করেন, একজন পেশাদার সাংবাদিককে অবশ্যই সংবাদ সংগ্রহ, লিখন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে যেমন দক্ষতা প্রদর্শন করতে হয়, তেমনি মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের সুষ্ঠু প্রয়োগও অপরিহার্য। আর এগুলোর ঘাটতি থাকলে সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের কমিউনিটিতে নিত্যনতুন যেসব সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে এসব স্ট্যান্ডার্ড রক্ষা হচ্ছে কি?

সাংবাদিক বা গণমাধ্যম কর্মী হতে হলে প্রয়োজনীয় জ্ঞান, পেশাগত প্রশিক্ষণ ও প্রাতিষ্ঠানিক অনুশীলনের কোনো বিকল্প নেই। প্রতিটি পেশাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ, মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানজনক। প্রতিটি পেশার নিজস্ব কিছু নিয়ম-কানুন, বিধিবিধান, পেশাগত আচরণবিধি, আলাদা বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা আছে। সাংবাদিকতাও এর বাইরে কিছু নয়। বর্তমান যুগ অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগ। ইন্টারনেটের বদৌলতে অনলাইন, ডিজিটালাইজেশন, আইসিটি এ সময়ের চরম বাস্তবতা। আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায়, ব্লগ সাইটে লিখুন, কথা বলুন, ডিভাইস ব্যবহার করে ছবি তুলুন, ভিডিও আপলোড করুন। সমস্যা নেই। এটা আপনার বাকস্বাধীনতা। ফান্ডামেন্টাল রাইটস। কিন্তু সাংবাদিক না হয়ে নিজেকে সাংবাদিক দাবি করছেন কেন? বরঞ্চ আপনি নিজেকে লেখক, ব্লগার, অনলাইন সোশ্যাল অ্যাকটিভিস্ট বা আলোকচিত্রী পরিচয়ে অভিষিক্ত করুন। অনেক অনেক সম্মান বয়ে আনবে।

একই অবস্থা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্ষেত্রেও

আমাদের কমিউনিটিতে এখন অনেক টেলিভিশন। টেলিভিশন বলছি এই অর্থে যে পুরো টেলিভিশন কথাটিই আছে নামকরণে। আমাদের কমিউনিটির মসজিদের একজন বাংলাদেশি ইমাম। তার নাম দিয়েই পুরো টেলিভিশনটির নামকরণ। কিন্তু তার এই টেলিভিশনের কি কাজ? মাঝেমধ্যে অদক্ষ হাতে জুমার খুতবা লাইভ করেন। এরকম অনেক অনেক টেলিভিশন আছে আমাদের কমিউনিটিতে। ফেস বুকে একটা অ্যাকাউন্ট অথবা ইউটিউবে একটি চ্যানেল, হাতে একটি স্মার্টফোন, একটি মাইকক্রোফোন আর ইন্টারনেট সংযোগ। হয়ে গেল একটা টিভি।

তারপর ‘হ্যালো ভিউয়ার্স’

এরা হানা দেয় রেস্টুরেন্টে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। ভুল শুদ্ধ মিলিয়ে যা মুখে আসে বলে গেল কিছু সময়। লাইভ রিপোর্টিং। এরা প্রমোট করে ব্যবসায়ীদের। কি দিয়ে ভাত খাচ্ছে। বাসা মুভ করছে, ছেলের খতনা, মেয়ের গায়ে হলুদ, পিকনিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠানে এরা হাজির। এক একটা টেলিভিশনের কি গালভরা নাম! এরা টকশোও করে। মানসম্মত কনটেন্ট, ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার যোগ্যতা, আকর্ষণীয় উপস্থাপনা দিয়ে দর্শক-শ্রোতাকে ধরে রাখার কোনো চেষ্টা কারো মধ্যে আছে কি? এখন অনেক অনলাইন পোর্টাল বা আইপি টিভির সংবাদের ভাষা আর কনটেন্ট দেখলে মনে হতে পারে সাংবাদিকতা বুঝি অশিক্ষিত লোকের পেশায় পরিণত হয়েছে।

এখন লাইভের নামে একটা অসুস্থ সাংবাদিকতা শুরু হয়েছে। বলা যায়, লাইভের নামে লাইফটাই অস্থির। এই সাংবাদিকতার নেই কোনো গ্রামার, কোনো ইথিকস বা নীতিমালা। অথচ সাংবাদিকতা একটি গ্রামারের মধ্যে করতে হয়। সাংবাদিকতার ডিগ্রি থাকতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে তার শেখার ইচ্ছা এবং পেশার প্রতি গভীর আগ্রহ ও শ্রদ্ধা থাকতে হবে। একজন পেশাদার সাংবাদিক হতে হলে কলম পিষতে হয় বহু বছর, বুম আর ক্যামেরা নিয়ে দৌড়াতে হয় বহুদিন। কাজের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। সাংবাদিকতার কোনো শর্টকাট রাস্তা নেই।

নিউইয়র্কে প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিলিয়ে কতগুলো মিডিয়া? তাতে ক’জন সাংবাদিক কর্মরত? ফোবানা, সোসাইটি বা জালালাবাদের নির্বাচন বা সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান কভার করতে যারা গলায় কার্ড ঝুলিয়ে প্রথম সারির আসনগুলো দখল করে থাকেন, তাদের কত জন পেশাদার! তাদের কত জন অনুষ্ঠানের খবর রিপোর্ট করেন? এগুলো কোন পত্রিকা বা টিভিতে প্রচারিত হয় কেউ কি কার হদিস রাখেন?

সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী এলে যাদের আইডি পেতে জাতিসংঘ মিশন সহায়তা করেন, যাদের জন্য প্রকৃত সাংবাদিকরা বসতে পর্যন্ত পারেন না অনেক অনুষ্ঠানে। যাদের সাংবাদিক হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা নেই, তারা যখন সাংবাদিক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়, তখন প্রকৃত সাংবাদিকরা লজ্জিত হন। সাধারণ মানুষ তখন ভুয়া আর ভুঁইফোঁড় সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রকৃত সাংবাদিকদের গুলিয়ে ফেলেন। গণমাধ্যমের প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থা, অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধা তৈরি হয়। আমার বলতে দ্বিধা নেই ডিজিটালাইজেশন সাংবাদিকতার চিরচেনা জগতকে বদলে দিচ্ছে। তৈরি করছে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। স্মার্টফোন জার্নালিজম, সিটিজেন জার্নালিজম, রোবট সাংবাদিকতা, অটোমেটেড সাংবাদিকতা, বহু মাধ্যমকেন্দ্রিক জার্নালিজম ইত্যাদি নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করছে। সাংবাদিকতা এখন আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়েছে। এসেছে নতুন নতুন সফ্টওয়ার। কনভারজেন্স টেকনোলজি, ওয়ার্ডস্মিথ সফটওয়্যার, কুইল প্রযুক্তি, পারস্পেকটিভ এপিআই  টুল, স্বয়ংক্রিয় ভিডিও কনটেন্টসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি সাংবাদিকতাকে অনেক আধুনিক করেছে।

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্ল্যাটফর্ম পরিবর্তন হচ্ছে। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক (সাউন্ড ও মোশন) আর এখন অনলাইন মিডিয়া। এভাবে সময়ে সময়ে রূপের পরিবর্তন হচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে বাহনের চিত্র পাল্টাচ্ছে। কিন্তু সাংবাদিকতার মৌলিকত্ব বা বিশেষত্ব হারিয়ে যায়নি। যে মিডিয়া বা যে ধরনের গণমাধ্যমে কাজ করেন না কেন, সাংবাদিকতার বুনিয়াদি মৌলনীতি সব জায়গায় সব সময়ে এক ও অভিন্ন। সাংবাদিকতার পাঠ ভিন্ন ভিন্ন প্ল্যাটফর্মে উপস্থাপনা, কলাকৌশল ও রচনারীতিতে কিছুটা বৈসদৃশ থাকলেও মূল বিষয় তথা, সাংবাদিকতার মৌলিক ধারণার ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য নেই। আগে সাংবাদিকদের নিয়ে গর্ব করা হতো। মিডিয়া ছিল হাতেগোনা আর এখন? প্রযুক্তির কল্যাণে সবার হাতে হাতে টিভি আর ঘরে ঘরে সাংবাদিক। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। পত্রিকার মানের দিকে যেমন কারো খেয়াল নেই, তেমনি সাংবাদিক বাছাইয়েও কোনো তাগিদ নেই। কি দুর্ভাগ্য আমাদের!

শেয়ার করুন