০৬ জুলাই ২০১২, শনিবার, ০৯:৪৯:১১ পূর্বাহ্ন


১০ চুক্তি ‘গোলামির নবতর সংস্করণ’ : বিএনপির প্রতিক্রিয়া ও মূল্যায়ন
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৭-২০২৪
১০ চুক্তি ‘গোলামির নবতর সংস্করণ’ : বিএনপির প্রতিক্রিয়া ও মূল্যায়ন


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে যে ১০টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে একে ‘গোলামির নবতর সংস্করণ’ অভিহিত করে তা প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি। গত ৩০ জুন রোববার বিকালে গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সম্পাদিত চুক্তি ও সমঝোতার নানা দিক তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের এ সিদ্ধান্তের কথা জানান।

তিনি বলেন, জনগণের ভোটাধিকার হরণকারী বর্তমান অবৈধ মাফিয়া সরকার প্রধান শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে ১০টি সমঝোতা স্মারক সই করেছে, তা গোলামির নবতর সংস্করণ। কানেকটিভিটি নামে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের এক অংশ থেকে আরেক অংশ পর্যন্ত রেল যোগাযোগের নামে করিডোর প্রদানের মাধ্যমে যা করা হয়েছে, তাতে আমাদের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। আপনাদের নিশ্চয়ই ১৯৭২ সালের ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ২৫ বছরের চুক্তির কথা স্মরণ আছে। ৫২ বছর পর সে ধারাবাহিকতায় গত ২২ জুন ভারতের সঙ্গে সমঝোতার আড়ালে যেসব চুক্তি করা হলো তা বাংলাদেশকে আজীবনের জন্য ভারতের গোলামে পরিণত করবে। এর ফলে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমরা পুনর্ব্যক্ত করতে চাই, সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তাবিরোধী এসব চুক্তি জনগণ কখনো মেনে নেবে না। বিএনপি এসব দেশবিরোধী চুক্তি-সমঝোতা প্রত্যাখ্যান করছে।

গত ২২ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরকালে দুই দেশের মধ্যে ১০টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে দলিলগুলো বিনিময় করা হয়। সাধারণত এ ধরনের অনুষ্ঠানের আগেই চুক্তিগুলো সই হয় এবং অনুষ্ঠানে সেটি বিনিময় হয়।

দু’পক্ষের মধ্যে চুক্তিগুলো হচ্ছে-‘বাংলাদেশ-ভারত ডিজিটাল পার্টনারশিপ’ এবং ‘বাংলাদেশ-ভারত গ্রিন পার্টনারশিপ’। সমঝোতা স্মারকের মধ্যে রয়েছে-‘মেরিটাইম কো-অপারেশন’, ‘মহাকাশ সহযোগিতা’, ‘রেলওয়ে কানেকটিভিটি’, ‘ওশানোগ্রাফি সহযোগিতা’ এবং ‘মিলিটারি শিক্ষা সহযোগিতা’। এছাড়া তিনটি সমঝোতা স্মারক পুনঃনবায়ন করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে-‘স্বাস্থ্য ও ওষুধ সহযোগিতা’, ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা’ এবং ‘মৎস্য খাতে সহযোগিতা’।

‘এসব দেশের জন্য বিপজ্জনক’

ভারতের চুক্তি ও সমঝোতার বিভিন্ন বিষয়গুলো দেশের স্বার্থের সম্পূর্ণ বিরোধী উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, এসব চুক্তি-সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে আমাদের দেশের প্রতিরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি ভারতের জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার অংশে পরিণত করা হয়েছে, যা খুবই বিপজ্জনক এবং দেশের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি। এটি শান্তির সহাবস্থান ও জোটনিরপেক্ষ নীতির পরিপন্থী। বস্তুত এসব সমঝোতা-চুক্তির মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে নিরাপত্তার কৌশলগত ‘বাফার স্টেট’ হিসেবে ভারতকে ব্যবহারের সুযোগ দিতে চায়। এর ফলে বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জটিলতার মধ্যে জড়িয়ে পড়বে। যে সাতটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে সেগুলোর প্রায় সবই দেশের উত্তরাঞ্চলকেন্দ্রিক। প্রয়োজনের সময়ে বাংলাদেশ ভূখ-কে ভারতের সামরিক ও বেসামরিক পণ্য পরিবহনের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘চিকেন নেক’কে বাইপাস করে ব্যবহার করার সুদূরপ্রসারি মহাপরিকল্পনা থেকেই এসব চুক্তি করা হয়েছে বলে আমরা মনে করি। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে দীর্ঘ মেয়াদে ভারতের গোলামি চুক্তির গভীর ফাঁদে ফেলার সেই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।

‘দেশের প্রাপ্তি শূন্য’

সম্পাদিত চুক্তি ও সমঝোতায় মির্জা ফখরুল বলেন, নানা নাম দিয়ে যে ১০টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হলো, তাতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি শূন্য। দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের চেয়ে ভারতের কাছে শেখ হাসিনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দায়বদ্ধতা থেকে এসব স্মারক সই হয়েছে, তা জনগণের কাছে স্পষ্ট। এগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের আকাক্সক্ষা পূরণের ন্যূনতম সংশ্লিষ্টতা নেই। সে কারণেই বহুপূর্বে ভারত ঘোষিত সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলারের ভারতীয় চুক্তি (লাইন অব ক্রেডিট-এলওসি) বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার বিষয়ে এ সফর (শেখ হাসিনার সফর) ছিল নীরব। ডলারকে পাশ কাটিয়ে ভারতীয় মুদ্রায় বাণিজ্য পরিচালনার বিষয়ে উঠে এসেছে আলোচনায়, অথচ বাংলাদেশের রফতানি ও প্রবাসী আয়ের অন্যতম প্রধান মুদ্রাই হচ্ছে মার্কিন ডলার। এভাবে একতরফা আগ্রাসী বাণিজ্যে বাংলাদেশকে ভারতের বাজারে পরিণত করা হয়েছে। ট্যারিফ, নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার পরিহার করে বিপুল বাণিজ্যিক ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার কিছুই এসব সমঝোতায় স্থান পায়নি।

‘তিস্তা চুক্তি হলো না’

মির্জা ফখরুল বলেন, এবারে সরকার প্রধানের সফরে তিস্তার পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি এজেন্ডাতেই ছিল না। অথচ এটাই হওয়া উচিত ছিল সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরকালে তিস্তা চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। এরপর গত ১৪ বছরে তিস্তা শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হলেও এই সংকটের সমাধান হয়নি। এহেন অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার লক্ষ্যে তিস্তা পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প গ্রহণ করা হলো। প্রশ্ন হলো, যাদের বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে তিস্তার ন্যায্য পানি থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে, সে তাদেরই তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত করলে তা যে স্বার্থ সাংঘর্ষিক ও আত্মঘাতী সেটা দেশের মানুষ বোঝে। তিস্তা প্রকল্প নিয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার বর্তমান অবৈধ সরকার প্রকারান্তরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ওপর অর্পণ করেছে বলে প্রতীয়মান হয়, যা বর্তমান গণবিচ্ছিন্ন সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির বহিঃপ্রকাশ। সীমান্ত হত্যা বন্ধ নিয়ে সরকারের নিশ্চুপ ভূমিকারও সমালোচনা করেন বিএনপি মহাসচিব।

ভারত সফর-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্য ভারত যদি তিস্তা প্রজেক্টটা করে দেয়, তাহলে আমাদের সব সমস্যাই তো সমাধান হয়ে গেল’ এবং তিস্তার পানি অভাবে পর্যুদস্ত অসহায় মানুষের আর্তনাদকে প্রধানমন্ত্রী ‘প্যাঁ প্যাঁ’ বলে আখ্যায়িত করাকে ‘উনি সমগ্র জাতির সঙ্গে তামাশা ও হাস্য রসিকতা করেছে’ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, বিএসএফের গুলিতে প্রতি বছর রেকের্ড পরিমাণ সীমান্ত হত্যাকা- সংঘটিত হওয়ার পরও প্রধানমন্ত্রীর সফরে এ বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকার চূড়ান্তভাবে নির্লিপ্ত থেকেছে। ভারত-নেপাল, ভারত-চীন ও ভারত-পাকিস্তান সীমান্তেও এ পরিমাণ হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটতে দেখা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে অহরহ সীমান্তে হত্যা হচ্ছে।

‘সব চুক্তি-সমঝোতা জনসমক্ষে প্রকাশ করুন’

মির্জা ফখরুল বলেন, এবারে শেখ হাসিনার ভারত সফরটি কাযর্ত ছিল একপাক্ষিক। এ সফরে স্বাক্ষরিত কিংবা চুক্তি বাংলাদেশের ন্যূনতম স্বার্থ সুনিশ্চিত করে না। সামরিক সহযোগিতার নামে জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ইতিপূর্বে আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ আমদানির অন্যান্য চুক্তি, জ্বালানি ও বিদ্যুতের মতো অধিকতর কৌশলগত পণ্যের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা করে তোলার চলমান উদ্যোগ দেশবাসী এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মহল গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে। ঢাকা ও দিল্লি নতুন যাত্রা শুরু করেছে, উভয় দেশ দেশ রূপকল্প ২০৪১ ও ভারত ২০৪৭ অনুসরণ করে একটি স্মার্ট বাংলাদেশ নিশ্চিত করার জন ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়েছে, শেখ হাসিনার এ বক্তব্যের মাধ্যমেই তার ভারত সফরের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে, যা দেশবাসী গভীরভাবে উপলব্ধি করেছে বলে বিএনপি বিশ্বাস করে। আমরা এ সফরসহ ভারতের সঙ্গে ইতিপূর্বে স্বাক্ষরিত সব চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশের দাবি জানাচ্ছি।

‘দেশের স্বার্থ ঠিক রেখেই সব হতে হবে’

মির্জা ফখরুল বলেন, বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির এ যুগে সব বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অংশীদারিত্ব বাড়াতে নানাভাবে কানেকটিভিটি তৈরি করার পক্ষেই বিএনপির অবস্থান। কিন্তু সড়কপথ, নৌপথ বা রেলপথে যেভাবে কানেকটিভিটি বাড়ানো হোক না কেন, তাতে জাতীয় স্বার্থকে বিবেচনা করতে হবে সর্বাগ্রে। কোনোভাবেই সার্বভৌমত্বের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করা যাবে না। কিন্তু বর্তমান অবৈধ শেখ হাসিনার সরকার অবৈধ ক্ষমতা অটুট রাখার হীনস্বার্থে জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ ও জহির উদ্দিন স্বপন উপস্থিত ছিলেন।

শেয়ার করুন