ফরমায়েশি গণতন্ত্রের দুর্নীতি কবলিত বাংলাদেশে শত তাজাপ্রাণের বিসর্জনের বিনিময়ে অবশেষে বীর ছাত্রসমাজের ঐতিহাসিক আন্দোলনের ফসল সরকারি চাকরির কাঙ্ক্ষিত কোটা সংস্কার অর্জিত হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছে কোটা প্রথা বাতিল করে ৯৩ শতাংশ চাকরি মেধারভিত্তিতে নির্ধারিত রাখার, ৫ শতাংশ কোটা থাকবে বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং পোষ্যদের জন্য, ১ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ও অবশিষ্ট ১ শতাংশ অন্যদের।
অনেকটা এভাবেই কোটা সংস্কারের জন্য নিয়মতান্ত্রিকভাবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করেছিল বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ। সরকার সেই আন্দোলনের স্বরূপ অনুধাবনে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। সঠিক সময়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা না করে যে ভুল করেছিল, তার খেসারত গুনছে এখন দেশ ও সরকার। সঠিক সময়ে সঠিক বিষয় অনুধাবন না করেই ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলন পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে সংঘাতপূর্ণ করা হয়েছে সরকারের কিছু মন্ত্রী ও উপদেষ্টার ভুল পরামর্শে। এর রেশ টানতে হলো ক্রমেই ফুলেফেঁপে ওঠা ছাত্র আন্দোলন গোটা বাংলাদেশে ছড়িয়ে যাওয়া এবং নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে সরকার সমর্থক সন্ত্রাসী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আর সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিকে পুঁজি করে মাঠে নেমে পড়ে সরকারবিরোধী ছাত্রশিবির, জামায়াত এবং অনেকের মতে ভিনদেশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। এরপর যে নরকীয় ঘটনাপ্রবাহ সেটা আর নতুন করে বলার নেই।
একের পর নির্বিচারে গুলি হত্যা, অগ্নিকাণ্ড, ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগ সরকারের কপালে লেগেছে খুনির তিলক। এখন মূল সমস্যার সমাধান হলেও হত্যাকাণ্ডের দায়-দায়িত্ব বহন করতে হবে সরকারকে এটা আর বলারও অপেক্ষা রাখে না। অনুসন্ধান করে বের করতে হবে কেন নিরীহ ছাত্র আন্দোলন সন্ত্রাস বিরোধী সশস্ত্র, ধ্বংসাত্মক রূপ নিলো? কেন অন্তত শত শত নিরীহ প্রাণ বিসর্জন দিতে হলো বা কেড়ে নেওয়া হলো?
ইন্টারনেট সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হয়তো সাধারণ মানুষ বিভিন্ন মাধ্যমে সব খবর জানতে পারেনি। কিন্তু বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমে বড় হিডিংয়ে বাংলাদেশের খবরে তোলপাড়। এতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের গত দেড় দশকে সরকারের অর্জিত যে সফলতা ও ভাবমূর্তি সেটা দারুণভাবে কালিমালিপ্ত হয়েছে। খবরগুলো বিশ্বমিডিয়ায় নগ্নভাবে প্রচারিত হয়েছে। বলা হয়েছে নিরীহ ও নিরস্ত্র ছাত্রদের আন্দোলন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের নিদারুণ ব্যর্থতা এবং নৃশংসতার খবর। দেশে দেশে অনাবাসী বাংলাদেশিরা সোচ্চার হয়েছে আন্দোলনে। প্রবাসে দারুণ ক্ষোভ এখন রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের। জানিনা সরকার কীভাবে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করবে?
চাপের মুখে আদালত যদি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাহলে আন্দোলনের শুরুতে কেন এটি করা হয়নি? সরকারের কাছে অবশ্যই আন্দোলনের সূত্রপাত আদিঅন্ত গোয়েন্দাদের মাধ্যমে পাওয়ার কথা। কিন্তু কেন অনুধাবন করা হলো না। কেন ১৯৬৯ গণআন্দোলন এবং ১৯৯০ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হলো নিতান্ত নিরীহ গোছের ছাত্র আন্দোলনকে? ১৯৬৯ গণআন্দোলনের ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ, ১৯৯০ আন্দোলনের ফসল স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন। সবই যে শেষ হয়ে গেছে এটা ভাবার অবকাশ নেই। এর রেশ কতদূর যায় সরকার কীভাবে এটা মোকাবেলা করবে সেটা এখন দেখার পালা শুরু। ফলে দেখতে হবে ২০২৪ রক্তাক্ত জুলাই মাসের আন্দোলনের পরিণতি কি হয়?