সেলফি নয়, ঐতিহাসিক বৈঠক হলো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে। নিউ ইয়র্কে ওয়ান টু ওয়ান বৈঠকটি হয়েছে গত ২৪ সেপ্টেম্বর সকাল ১১টায়। জাতিসংঘ ভবনে অনুষ্ঠিত সেই বৈঠকে জো বাইডেন ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বতী সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান এবং সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক বার্তায় এই তথ্য জানিয়েছে। বৈঠকের সময় ড. ইউনূস ও বাইডেনের কুশল বিনিময়ের ছবিও প্রচার করে প্রেস উইং।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কোনো দেশের শীর্ষ নেতার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের তেমন নজির নেই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তো এমন বৈঠক বিরল। মঙ্গলবার সেই বিরল বৈঠকটিই অনুষ্ঠিত হয়েছে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এদিন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কাছে পেয়ে বুকে টেনে নেন। হাতে হাত রেখে বলেন, বাংলাদেশের সংস্কারের যে লক্ষ্য নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ঠিক করেছেন, তাকে বাস্তবে রূপ দিতে সব ধরনের সহযোগিতা করবে হোয়াইট হাউস। কূটনীতিক সূত্র এবং জাতিসংঘে কর্মরত কর্মকর্তারা জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সাধারণত জাতিসংঘ অধিবেশনে তাঁর নির্ধারিত বক্তৃতার দিন সকালে নিউইয়র্কে পৌঁছান। তিনি সেদিন সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তৃতা দেন। এরপর বিকেলে জাতিসংঘের অধিবেশনে আসা রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সম্মানে সংবর্ধনার আয়োজন করেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলার ফাঁকে কোনো দেশের শীর্ষ নেতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দ্বিপক্ষীয় সাক্ষাৎ নজিরবিহীন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক একাধিক কূটনীতিকের মতে, চিরাচরিত প্রথা ভেঙে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বতী সরকারেরপ্রধান উপদেষ্টার বৈঠক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুই নেতার বৈঠক এই বার্তাই দিচ্ছে যে হোয়াইট হাউস বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
প্রেস উইংয়ের বার্তায় বলা হয়, বৈঠকে ড. ইউনূস বিগত সরকারের আমলে সকল ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের সাহসী ভূমিকা ও বাংলাদেশ পুনর্গঠনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে অবহিত করেন। অধ্যাপক ড. ইউনূস জোর দিয়ে বলেন, দেশ পুনর্গঠনে তার সরকারকে অবশ্যই সফল হতে হবে। এসময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন যেকোনো সাহায্যে বাংলাদেশ সরকারের পাশে থাকার আশ্বাস দেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, শিক্ষার্থীরা যদি দেশের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করতে পারে, তাহলে তাদেরও (যুক্তরাষ্ট্র সরকার) পূর্ণ সহযোগিতা করা উচিত।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা জুলাই বিপ্লব চলাকালীন ও এরপরে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আঁকা দেয়ালচিত্রের ছবি-সংবলিত ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ শীর্ষক আর্টবুক যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে উপহার দেন।
ঢাকা ও নিউ ইয়র্কের কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সংবর্ধনায় দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। সেখানে সেলফি তোলা হয়েছে এবং সেলফি বৈঠক বলে নিউজ করা হয়েছে। কিন্তু নিউ ইয়র্কে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের ঘটনা এটাই প্রথম। ৭৯তম জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের বিতর্ক সেশন শুরু হয়েছে ২৪ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার সকাল থেকে। ওই অধিবেশনে অংশ নিতে প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ২৩ সেপ্টেম্বর সোমবার রাতে নিউ ইয়র্ক পৌঁছেছেন। মূলত প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকের সূচি ঠিক হওয়ায় পূর্ব-নির্ধারিত সময় একদিন এগিয়ে ২৩শে সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে পৌঁছান তিনি। অবশ্য তার অন্য কর্মসূচিও এগিয়ে আনা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টাকে এয়ারপোর্টে অথ্যর্ত্থনা জানান, জাতিসংঘে নিযুক্ত স্থায়ী প্রতিনিধি আব্দুল মুহিত, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিত হোসেন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ; সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা। সফরের প্রথমদিনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছাড়াও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের প্রধান ভলকার তুর্ক, মরিশাসের প্রেসিডেন্ট পৃথ্বিরাজ সিংহ রূপন, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা ডি সিলভা, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলনের সঙ্গেও বৈঠক হয় তার।
জাতিসংঘ মহাসচিবের আয়োজিত সংবর্ধনায় যোগ দিলেন ড. ইউনূস
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার সকাল আটটায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে অনুষ্ঠানটি শুরু হয়। যেখানে সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দেওয়া বিশ্বনেতাদের স্বাগত জানান গুতেরেস।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ড. ইউনূস ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা দা সিলভা, মরিশাসের প্রেসিডেন্ট পৃথ্বীরাজ সিং রূপন, জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্কসহ অন্যদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।
আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘে ভাষণ দেবেন। জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যে বিগত দুই মাসে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অভাবনীয় গণঅভ্যুত্থানের বিবরণ ও আগামী দিনে জনভিত্তিক, কল্যাণমুখী ও জনস্বার্থে নিবেদিত একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় বিশ্বদরবারে তুলে ধরবেন। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের বলিষ্ঠ অবস্থান, জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব, জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, বিশ্বব্যাপী সংঘাত, রোহিঙ্গা সংকট, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিকূলতা, উন্নয়নশীল দেশসমূহ থেকে সম্পদ পাচার প্রতিরোধ, নিরাপদ অভিবাসন, অভিবাসীদের মৌলিক পরিষেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রযুক্তির টেকসই হস্তান্তর এবং ফিলিস্তিন সম্পর্কিত বিষয়সমূহ তার বক্তব্যে উঠে আসতে পারে। এ ছাড়াও প্রধান উপদেষ্টা বেশ কয়েকটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। ডাচ প্রধানমন্ত্রী, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, নেপালের প্রধানমন্ত্রী, ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জাতিসংঘ মহাসচিব এবং ইউএসএইড’র প্রশাসকের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নিয়ে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।
নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কার কাজ শুরু করেছে। এ প্রেক্ষাপটে এবারের অধিবেশন নতুন বাংলাদেশের জন্য জাতিসংঘে বা বিশ্ব সভায় নতুন পদচারণা। বিশ্ব দরবারে বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশকে উপস্থাপনের জন্য এবারের অধিবেশন বাংলাদেশের জন্য বিরাট সুযোগ। জাতিসংঘের অগ্রাধিকার ইস্যুগুলো প্রত্যেকটি বাংলাদেশের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই ইস্যুগুলোর উপর যেসব ইভেন্ট আছে, বাংলাদেশ তার সবক’টিতেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ বহুপক্ষীয় কূটনীতিকে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে মনে করে। সার্বিক বিবেচনায় এবারের অধিবেশনে উপদেষ্টার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রকে বিস্তৃত ও সুদৃঢ় করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
নিউ ইয়র্কে দেখা হচ্ছে না ড. ইউনূস-মোদির, তবে বাংলাদেশ-ভারত বৈঠক হবে: ওদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে নিউ ইয়র্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দেখা হচ্ছে না বলে জানান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। তবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের তার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে বলে নিশ্চিত করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার দেখা-সাক্ষাৎ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, উনাদের দু’জনের নিউ ইয়র্কে উপস্থিতি একসঙ্গে হচ্ছে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিউ ইয়র্ক ছাড়ার পরপর প্রধান উপদেষ্টা পৌঁছান। কাজেই তাদের সেখানে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
৫৭ জন সফরসঙ্গী
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশগ্রহণের জন্য সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কে পৌঁছেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই সফরে প্রধান উপদেষ্টা ছাড়াও তার সঙ্গে ৫৭ জনের একটি বহর যাবে, যার মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী, গণমাধ্যমকর্মী এবং অন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা।
শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ব্যয় সংকোচনের নীতিতে বিশ্বাসী। তবে কিছু ক্ষেত্র আছে যেখানে ব্যয় সংকোচন করা সম্ভব নয়। নিরাপত্তা সবার আগে। সে প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখে ৫৭ জনের এ দলটি যাচ্ছে।
তৌহিদ হোসেন আরও বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে জাতিসংঘ অধিবেশনে অংশ নিতে যে বড় বহর নিয়ে যাওয়া হতো, তা ব্যাখ্যা করতে তিনি অপারগ।
তবে তিনি উল্লেখ করেন, ৭৩ ও ৭৪তম অধিবেশনে বাংলাদেশ থেকে যথাক্রমে ৩৪৪ ও ৩৩৫ জন সদস্যের দল গিয়েছিল। কোভিড-১৯ এর কারণে ৭৫তম অধিবেশন ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হলেও, ৭৬তম অধিবেশনে ১০৮ এবং ৭৭তম অধিবেশনে ১৩৮ জনের দল গিয়েছিল। এমনকি কোভিড পরবর্তী সময়ে যখন ব্যয় সংকোচনের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছিল, তখনো ১৪৬ জনের একটি দল নিউইয়র্কে পাঠানো হয়েছিল।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও বলেন, আমাদের এবারের দলটি শুধু প্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের নিয়েই গঠিত, যার মধ্যে একটি বড় অংশ নিরাপত্তা ও প্রেসের সদস্য। এ সফর সরকারের ব্যয় সংকোচনের নীতির প্রতিফলন।