৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০১:২৫:০৭ অপরাহ্ন


পত্রিকা চুরি!
হাবিব রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৪-১২-২০২৪
পত্রিকা চুরি!


কথায় আছে ‘চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা, যদি না পড়ে ধরা’। চুরি মানে, না বলে অন্যের জিনিস নেওয়া। পেশাদার চোরেরা একে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে এবং বিদ্যা হিসেবে শেখাতে পারে। চোর শব্দটি এসেছে সংস্কৃত চৌর, তস্কর শব্দ থেকে। চুরির ধরন বা প্রকার অনুসারে এটাকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। সিঁধ কেটে যারা চুরি করে তারা সিঁধেল চোর। এ পদ্ধতিতে চুরি করা সবচেয়ে কঠিন। সিঁধকাঠি অর্থাৎ শাবল বা খুন্তির মতো জিনিস দিয়ে এসব চোর মাটির কাঁচাবাড়ি বা দেওয়ালে গর্ত বা সুড়ঙ্গ করে। এরপর ঘরের ভেতরে গোপনে প্রবেশ করে চুরি করে। বর্তমানে এ ধরনের চুরি অনেকটাই কমে গেছে।

সিঁধ কাটা থেকে ছ্যাচর বা ছিঁচকে চোর শব্দ এসেছে। শব্দটি ছোটখাটো চুরি অর্থেও ব্যবহার হয়। চুরির করতে ব্যর্থ হয়ে ভাঙচুর ইত্যাদি ক্ষতি করলে তাকেও ছ্যাঁচড়ামো বলে। এক চোরের চোরাই মাল আরেকজন চুরি করলে দ্বিতীয়জনকে বাটপার বলা হয়। বাগধারা আছে, চোরের ওপর বাটপারি।

জুয়াচোর থেকে এসেছে জোচ্চুরি শব্দটি। তবে শুধু জুয়া খেলায় নয়, যে কোনো প্রতারণাকে জোচ্চুরি বলে। অন্যের স্বাক্ষর নকল করে যে কোনো অপকর্ম করা হলো সই চুরি। ইন্টারনেটে অন্যের তথ্য চুরি করাকে বলে হ্যাকিং।

অনেক চোর রয়েছে স্বভাবের বাইরে প্রয়োজনের কারণে চুরি করে। কিন্তু সমাজে অনেক ধনী বা সামর্থ্যবান মানুষ রয়েছেন তাদের মধ্যে ছোটখাটো চুরি করা একধরনের অদম্য ইচ্ছা রয়েছে। নিজের অজান্তেই তারা চুরি করেন। এটার একধরনের রোগ, যাকে বলে ক্লেপ্টোম্যানিয়া।

হরেক রকম চোর আছে আমাদের সমাজ। গরুচোর, পুকুর চোর, ছ্যাচরা চোর ইত‍্যদি। কিন্তু সম্প্রতি একটি অভিনব চুরির সংবাদ প্রকাশ করেছে নিউইয়র্কের একটি পত্রিকা।

খবরে জানা গেছে, লং আইল্যান্ড সিটির স্টেলার প্রিন্টিং প্রেস থেকে এক বাংলাদেশি পত্রিকার মালিক প্রেসকে না জানিয়ে রাতের অন্ধকারে পত্রিকা চুরি করে নিয়ে গেছেন। প্রেসের ম‍্যানেজার সূত্রে সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে উল্লিখিত পত্রিকা মালিকের কাছে প্রেসের বেশ কিছু বিল বাকি ছিল। পত্রিকার মালিক সে বিল পরিশোধ করে সেদিনের পত্রিকা ডেলিভারি নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি কাউকে না জানিয়ে পত্রিকাগুলো রাতের অন্ধকারে সরিয়ে নিয়ে যান। ম‍্যানেজার আরো জানিয়েছেন, এর আগেও আরেকটি পত্রিকার সম্পাদক একই ধরনের কাজ করেছিল। খবরটি কমিউনিটিতে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। এতক্ষণ চুরি বিষয়ে মন খারাপের কথা বললাম। এবার চুরির একটা গল্প বলে মনটা হালকা করে দিই।

ট্রেনে এক হকার বই বিক্রি করছেন। হকার একজন যাত্রীর উদ্দেশে বললেন, ভাই, দেবো নাকি একখানা বই? খুব ভালো বই, কাজের বই। বইয়ের নাম ‘চুরি করলে ধরা পড়বেন না’। এই বইটা পড়ে দেখুন, চুরি করে ধরা না পড়ার সমস্ত নিয়ম আছে। খুব সহজেই আপনি কৌশল আয়ত্ত করতে পারবেন।

মনে করুন আপনার পকেটে কিছু আছে। বলেই তিনি ওই যাত্রীকে বললেন, ভাই আপনার পকেটে কী আছে, একটু বলুন। 

যাত্রীটি বললো, মানিব্যাগে ৫০০ টাকা আছে। এরপর ওই হকার যাত্রীটির পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগটি বের করে ফেললেন। এরপর বললেন, এবার আমার দিকে লক্ষ করুন, এই নিলাম (বলেই, হকার চলন্ত ট্রেন থেকে নিচে লাফ দিলো)। দেখলেন তো কীভাবে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দিলাম, তবে এই কাজটি করতে হবে অত্যন্ত সাবধানে।

যাত্রীটি এবার চিৎকার করে বললেন, এই মিয়া করো কী, আমার মানিব্যাগটা...।

হকার : (হাসতে হাসতে) ধরতে পারবেন না, ভাই। সব নিয়মাবলি বইটায় দেওয়া আছে।

দাও ফিরে সে অরণ‍্য, লও এ নগর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতায় লিখেছেন, ‘দাও ফিরে সে অরণ‍্য লও এ নগর/লও যত লৌহ, লোস্ট্র,কাষ্ঠ ও প্রস্তর/হে নব সভ‍্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী/দাও সেই তপোবন পুণ‍্যচ্ছায়া রাশি..।’

সভ‍্যতা মানুষকে যেমন অনেক কিছু দিয়েছে, তেমনি‍ কেড়েও নিয়েছে অনেক। ভোগের নানা উপকরণ মানুষের জীবনে ছড়ানো। কিন্তু নগর সভ‍্যতার বেড়াজালে মানুষ হারিয়েছে প্রকৃতির নিসর্গবেষ্টিত জীবনের শান্ত সৌন্দর্য। হারিয়েছে প্রকৃতির মুক্তাঙ্গনে দেহ-মনের অবাধ ও স্বচ্ছন্দ বিকাশের সুযোগ। মানুষের জীবনে এসেছে অনেক অনাকাক্সিক্ষত জটিলতা। আদিম মানুষের বসবাস ছিল অরণ্যে। সেখানে প্রকৃতির দান ছিল অফুরন্ত। উন্মুক্ত প্রান্তর, খরস্রোতা তটিনী, সীমাহীন নীলাকাশ মানুষকে আনন্দ দিতো। মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল সীমিত, বর্তমানের মতো এতো রেষারেষি, এতো বিদ্বেষ তখন ছিল না।

বর্তমানে মানুষ উন্নতির শীর্ষে উঠেছে। এজন‍্য চলছে প্রতিযোগিতা। চলছে হানাহানি। তাই লক্ষ-কোটি বছর পরও মানুষ অরণ্যের প্রতি টান অনুভব করছে। চাইছে সেই ফেলে আসা দিনগুলোতে ফিরে যেতে। আধুনিক সভ‍্যতার পাষাণ পিঞ্জরে অবরুদ্ধ মানুষ তাই মুক্তি প্রত‍্যাশায় কবিগুরুর ভাষায় বলছে-দাও ফিরে সে অরণ‍্য লও এ নগর।

কথাটা বলছি সাম্প্রতিক একটা প্রসঙ্গে। গত সপ্তাহে একটা ফার্মাস মার্কেটে কেনাকাটার জন‍্য গিয়েছিলাম। আপনারা জানেন, এ মার্কেট বসে সাধারণত রাস্তার পাশে বা কোনো খোলা জায়গায়। সাধারণত কাছাকাছি এটিএম মেশিন বা ব‍্যাংক থাকে না। এজন‍্য সিটি চালু করেছে একটা বুথ। আপনার কাছে নগদ টাকা না থাকলে আপনি বাজার করে সেই বুথে গিয়ে আপনার ক্রেডিট-ডেবিট বা ইবিটি কার্ড দিলে তারা তা চার্য করে কাগজে ছাপানো এক-দুই ডলারের নোট (ডলার নয়) এবং হার্ডবোর্ডের মতো শক্ত কাগজে ৫-১০ ডলার লেখা কাগজ কয়েন দেবে মূল‍্য পরিশোধের জন‍্য। দোকানিরা পরে তা ফেরত দিয়ে ডলার নিয়ে নেবে। দেখলাম, অনেকেই কার্ডচার্জ করে কাগুজে মুদ্রা নিয়ে মহানন্দে বাজার-সওদা করছেন। অনেকে সেই কাগুজে মুদ্রা হাতে নিয়ে সেলফি তুলে প্রিয় জনকে পাঠিয়ে আনন্দ করছেন। এই অভিনবত্বে বয়স্করাও নগর সভ্যতা থেকে একটু ক্ষণের জন‍্য হারিয়ে গিয়ে নব আনন্দে মেতে উঠছেন।

পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ

মুঘল সম্রাট শাহজাহানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, দুনিয়ায় সবচেয়ে ভারী বস্তু কি? তার উত্তর ছিল, পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ। দিনের শেষে পড়ন্ত বিকালে সূর্য যেমন তার সবপাঠ চুকিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। দিবাকরের অস্তপথ যেমন কেউ রুখতে পারে না, ঠিক তেমনই মৃত্যুও। যার মৃত্যুর সময় আসন্ন হয়, এ নশ্বর পৃথিবীর বিদায় ঘণ্টা যখন কারো বেজে ওঠে, তখন কেউ আর তাকে ঠেকাতে পারে না। পারে না তা ত্বরান্বিত করতে, পারে না তা বিলম্বিত বা প্রলম্বিত করতে। মৃত্যুর সে মিছিলে আমাদের সবাইকে যাত্রী হতেই হবে। সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা স্রষ্টার সুন্দর বিচিত্র এই অপরূপ বসুন্ধরার শেষ নিঃশ্বাস বিয়োগের অনিবার্য স্বাদ আস্বাদন করতেই হবে। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সবাইকে মৃত্যুর পেয়ালা পান করতেই হবে। যে জন্মেছে সে মরবেই। যে এসেছে সে যাবেই। এটাই মহাবিশ্বের চিরকালীন চিরন্তন মহাবিস্ময়। এটাই মহান আল্লাহ চিরন্তন অমোঘ অজেয় অবধারিত বিধান। কবির ভাষায়- 

‘জন্মিলে মরিতে হবে,/ চিরদিন কে কোথায় রবে?’ মানুষ মরিবে সবে,/ নহে সে অমর ভবে’।

জীবন ও মৃত্যুর পার্থক্য সাদা ও কালোর মধ্যকার পার্থক্যের মতো সরল নয়। কিছু মৃত্যুর কষ্ট মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর। যদি সে মৃত্যু হয় পিতার জীবদ্দশায় তার কলিজার টুকরা প্রিয় শিশু সন্তানের তবে সে মৃত্যু আরো বহুগুণ কষ্টের, অব্যক্ত বেদনা আর সীমাহীন বিষাদের। আর যদি সে সন্তান হয় জীবনের পড়ন্ত প্রহরের কিনারে ভাসমান এক হতভাগ্য অসহায় পিতার একমাত্র শিশু ছেলের। তবে সে মৃত্যু সে পিতার জন্য হয়ে দাঁড়ায় তার জগত অন্ধকারাচ্ছন্ন বিভীষিকাময় বিনাশী ভারী কেয়ামতসম। যদি সে সন্তান হয় অসহায়-ব্যাকুল, পাগলপারা মায়ের, রবের দরবারে দীর্ঘ প্রার্থিত আদরের দুলাল নাড়িছেঁড়া ধন, তবে সে মৃত্যু কীভাবে সহ‍্য করবে অবুঝ সে মায়ের মন!

পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ কতটা ভারী-একজন হতভাগ্য পিতাই কেবল তা বুঝতে পারে। দুনিয়ার স্বাভাবিক নিয়ম হলো সন্তান একদিন বড় হবে। পিতার সেবা করবে। তার কোলে পিতার মৃত্যু হবে। সে পিতার লাশ বহন করবে। জানাজা দেবে। নিজ হাতে মাটি দেবে।

কেউ কি জানে সন্তানের মৃতদেহ দেখতে একজন বাবার কাছে কেমন লাগে? একজন বাবার জন্য তা কতটা কঠিন তা কি আপনি অনুভব করতে পারেন? যে সন্তানকে পরম মমতায়, প্রবল ও পরম আদর যত্নে কোলেপিঠে করে মা-বাবা লালন-পালন করেন, প্রতিটা মুহূর্ত যে শিশুকে পরমানন্দে, আদরে যতনে সোহাগে বুকে চেপে রাখেন সেই সন্তানের মরামুখ যখন একজন পিতাকে দেখতে হয়, সেটা কতটা বেদনার হতে পারে, তা এই হতভাগা পিতা ছাড়া অন্য কেউ বুঝবে না। পিতার অন্তরের সে ব্যথা কেউ আন্দাজ করতে পারবে না। জীবনের পড়ন্ত বেলায় সন্তানের লাশ কাঁধে যিনি নিয়েছেন হয়তো তিনিই বুঝেছেন তার ভার কতটা? পিতা অপেক্ষা করছেন পুত্রের জন্য। পুত্রের লাশের জন্য। কী অপেক্ষা! যে ছেলের আঙুল ধরিয়ে হাঁটা শিখিয়েছিলেন, সেই ছেলের কবরে মাটি দেওয়ার অপেক্ষা। পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ সর্বদাই সবচেয়ে ভারী; কিন্তু এ অপেক্ষার লাশ বেশিই ভারী এক পিতার জন্য!

প্রসঙ্গটা এলো গত সপ্তাহে প্রবাসে দুটো মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে। প্রবাসের বিশিষ্ট লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাহমুদ রেজা চৌধুরী এবং সাবেক ব‍্যাংকার সুরাইয়া খানমের একমাত্র পুত্র তানজির রেজা চৌধুরী (৩৯)। তিনি হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন।

অন‍্যজন হলেন পেনসিলভানিয়া বিএনপির সভাপতি, কমিউনিটির অত‍্যন্ত পরিচিত মুখ শাহ ফরিদের একমাত্র সন্তান এস এম ওমর সাদীর মৃত্যু। তিনি মাত্র ২০ বছর বয়সে দুরারোগ্য ব‍্যাধি ক‍্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। এক সপ্তাহে দুটি অকাল এবং আকস্মিক মৃত্যুর খবর জানাজানি হলে গোটা এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।

আমাদের প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘বান্দার যখন সন্তান মারা যায়, আল্লাহ তার ফেরেশতাদের বলেন: তোমরা আমার বান্দার সন্তান কবচ করেছো? তারা বলে: হ্যাঁ। তিনি বলেন: তোমরা আমার বান্দার অন্তরের নির্যাস গ্রহণ করেছো? তারা বলে: হ্যাঁ। তিনি বলেন: আমার বান্দা কি বলেছে? তারা বলে: আপনার প্রশংসা করেছে ও ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়েছে। (অর্থাৎ আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা তার কাছেই ফেরত যাবো, এটা বলেছে।) অতঃপর আল্লাহ বলেন: তোমরা আমার বান্দার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করো, তার নাম রাখ বায়তুল হামদ।’ [তিরমিজি ও ইব্‌ন হিব্বান]।

সন্তান হারানো বাবাদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমাদের জানা নেই। শুধু বলবো, আল্লাহ আপনাদের শোক সহ‍্য করার জন‍্য শক্তি দিন।

শেয়ার করুন