৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৪:৪৫:১৬ পূর্বাহ্ন


জোরপূর্বক হিজাব খুলে নেওয়ায় পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ১০-০৯-২০২৫
জোরপূর্বক হিজাব খুলে নেওয়ায় পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে (এএসইউ) চার নারীকে গ্রেফতারের পর পুলিশ তার হিজাব খুলে ফেলে।


অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির টেম্পে ক্যাম্পাসে ২০২৪ সালের এপ্রিলে প্রো-ফিলিস্তিন বিক্ষোভ চলাকালে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ওই সময় ক্যাম্পাসে ডজনখানেক শিক্ষার্থী ও কর্মীকে অনুপ্রবেশের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। পরে অনেক মামলাই খারিজ হয়ে গেলেও চার মুসলিম নারী-ফাতিমা জাবারদি, নূর ওদেহ, নূরা আবদাল্লা এবং সালাম জাবাইয়েহ অভিযোগ করেছেন যে গ্রেফতারের সময় পুলিশ কর্মকর্তারা জোরপূর্বক তাদের হিজাব খুলে নেন। এই ঘটনার পর গত ১১ আগস্ট চার নারী একটি বিস্তৃত দেওয়ানি মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামি করা হয়েছে অ্যারিজোনা বোর্ড অব রিজেন্টস, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, এএসইউ পুলিশ, অ্যারিজোনা ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক সেফটি (ডিপিএস), মেরিকোপা কাউন্টি শেরিফের অফিস (এমসিএসও) এবং একাধিক পুলিশ কর্মকর্তাকে। বাদীপক্ষের দাবি, এসব সংস্থা যৌথভাবে গ্রেফতার ও পরিবহনে জড়িত ছিল এবং তারা ইচ্ছাকৃতভাবে মুসলিম নারীদের ধর্মীয় অধিকার লঙ্ঘন করেছে।

বাদীপক্ষের আইনজীবী ডেভিড চামি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এটা কোনো অনুপ্রবেশের মামলা নয়; মূল প্রশ্ন হলো মত প্রকাশ ও ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার। তার ভাষায়, নারীদের হিজাব খুলে নেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা ছিল না। বরং এটি এমন এক অপমানজনক কাজ, যেন জনসমক্ষে কোনো নারীর জামা বা ব্রা খুলে ফেলা। ঘটনার পর চার নারী এখনো গভীর মানসিক আঘাত ও লজ্জার মধ্যে রয়েছেন। তাদের মতে, প্রকাশ্যে পুরুষদের সামনে হিজাব খুলে নেওয়ার অপমান ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। আইনজীবীর বক্তব্য, প্রয়োজনে হিজাব খোলার বিষয়টি ব্যক্তিগত স্থানে একই লিঙ্গের কর্মকর্তার মাধ্যমে করা যেত, কিন্তু এখানে তা ইচ্ছাকৃতভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে যা যুক্তরাষ্টের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন করে।

মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, শেরিফের একজন ডেপুটি অন্য কর্মকর্তাদের হিজাব খোলার নির্দেশ দেন এবং এটিকে এমসিএসওর নীতির অংশ হিসেবে উল্লেখ করেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ নীতিকে বৈষম্যমূলক এবং ধর্মীয় সংবেদনশীলতাকে অগ্রাহ্য করার মতো বলে সমালোচনা করেছে। তবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এমসিএসও নীতি পরিবর্তন করে নতুন নির্দেশনা জারি করে। সেখানে স্পষ্ট বলা হয়, হিজাব বা অন্য কোনো ধর্মীয় পোশাক খুলে তল্লাশি করার প্রয়োজন হলে তা অবশ্যই ব্যক্তিগত স্থানে এবং একই লিঙ্গের কর্মকর্তার উপস্থিতিতে করতে হবে।

ডেভিড চামি প্রশ্ন তোলেন, যদি এখন এ ধরনের নীতি কার্যকর করা সম্ভব হয়, তবে এক দশক আগে কেন তা করা হয়নি? তার মতে, অতীতে বহু মুসলিম নারী একই ধরনের অপমানের শিকার হয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও বলছে, এএসইউ ক্যাম্পাসের ঘটনাটি শুধু মুসলিম নারীদের নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (এসিএলইউ) এবং অন্যান্য সংগঠন বরাবরই সতর্ক করে আসছে, অনেক আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা এখনো ধর্মীয় পোশাক বা প্রতীকের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে।

মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা-নেত্রীরাও অভিযোগ করেছেন, এ ধরনের ঘটনা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভয়ের জন্ম দেয়। তাদের মতে, জনসমক্ষে হিজাব খুলে নেওয়া শুধু ব্যক্তিগত অপমান নয়, বরং গোটা মুসলিম সম্প্রদায়কে হেয় করার শামিল। ঘটনার পরপরই মার্কিন বিচার বিভাগ (ডিওজে) ধর্মীয় বৈষম্যের অভিযোগে একটি তদন্ত শুরু করলেও বাদীপক্ষের দাবি, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই তদন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার আরো দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে। চামির মন্তব্য, যদি সরকারি সংস্থাগুলো বারবার এমন ঘটনা ঘটিয়েও প্রকৃত আর্থিক জরিমানা বা শাস্তি না পায়, তবে তারা কখনোই শিক্ষা নেবে না।

আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যুক্তি দেখায় যে, হিজাব বা ধর্মীয় পোশাক খুলে দেখা হয় অস্ত্র বা বিপজ্জনক বস্তু লুকানো আছে কি না তা নিশ্চিত করতে। কিন্তু সমালোচকদের মতে, এ ধরনের যুক্তি আসলে নিরাপত্তার অজুহাতে মৌলিক মানবাধিকারের ওপর হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা। এ বিষয়ে ডিপিএস কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এএসইউ কর্তৃপক্ষও সাংবাদিকদের কেবল একটি ওয়েবসাইটের সাধারণ তথ্যের লিঙ্ক দিয়েছে। তবে এমসিএসও নতুন নীতিমালার কপি সরবরাহ করেছে।

এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে নতুন করে ভয়ের জন্ম দিয়েছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, ভবিষ্যতে ধর্মীয় পোশাক পরিধান করাকেও আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি শুধু ধর্মীয় স্বাধীনতার নয়, বরং নাগরিক স্বাধীনতা ও সাংবিধানিক অধিকার রক্ষারও একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অ্যারিজোনার রাজনৈতিক অঙ্গনেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। সমালোচকরা মনে করছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং স্থানীয় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কেবল একটি বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সাংবিধানিক অধিকার পদদলিত করেছে। অন্যদিকে, সমর্থকরা দাবি করছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি ছিল।

অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের এ মামলাটি শুধু চার মুসলিম নারীর ন্যায়বিচারের প্রশ্ন নয়, বরং এটি যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সীমা নিয়ে চলমান বিতর্কের একটি বড় উদাহরণ হয়ে উঠেছে। আদালতের রায় বা সমঝোতা যাই হোক না কেন, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই মামলা ভবিষ্যতে মার্কিন সমাজে ধর্মীয় সংবেদনশীলতা ও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে নতুন মানদণ্ড তৈরি করবে।

শেয়ার করুন