ভালো মন্দ, সাফল্য ব্যর্থতার মিশেলে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সময় কেটেছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ২০২৪। জাতীয় দলের সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লা ভারী হলেও বয়সভিত্তিক দল, নারী দল সাফল্য পেয়েছে। দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পথ ধরে ক্রিকেট প্রশাসনেও প্রান্তিক পরিবর্তন এসেছে। ২০২৪ বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাফল্য ব্যর্থতার খতিয়ান খুঁজলে দেখা যাবে তিন ফরম্যাট টেস্ট, ওডিআই এবং টি২০ বাংলাদেশের র্যাংকিং ৯ম। দুই দশকের বেশি সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিচরণ করেও কেন বাংলাদেশ বিশ্ব ক্রিকেট অঙ্গনে তলানিতে পড়ে আছে সেটি নিয়ে কিন্তু বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন নেই। ক্রিকেট প্রশাসনের জবাবদিহির অভাবে বিসিবিতে রাম রাজত্ব চলছে। যেই যেভাবে সেখানে যাক না কেন দেশের ক্রিকেট ব্যবস্থাপনায় কোন মৌলিক পরিবর্তন আসছে না। দেশীয় ক্রিকেট অবকাঠামো, প্রতিভা অন্বেষণ, উন্নত পরিবেশ (খেলার মাঠ, স্পোর্টিং উইকেট, মানসম্পন্ন টুর্নামেন্ট, লিগ) সৃষ্টির লাগসই উদ্যোগ বা পরিকল্পনা নেই।
অথবা বলতে পারি, এ কাজগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা বা মানসিকতা নেই ক্রিকেট ব্যবস্থাপনার। আর তাই তরুণদের প্রতিভার উজ্জ্বলতায় কালেভদ্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বয়সভিত্তিক দল সাফল্য পেলেও জাতীয় দলের পারফরম্যান্স ধারাবাহিক নয়। ইদানীং আবার দেখলাম, বিসিবির শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হয়েছে। কিছু কনটেন্ট ক্রিয়েটর বিভেদ বিভাজন উসকে দিচ্ছে। কিছু সিনিয়র ক্রিকেটার হয়তো দায়িত্ব ঠিক মতো পালন করছে না। সাকিবের মতো বিশ্বমানের ক্রিকেটারকে রাজনৈতিক কারণে দেশের হয়ে খেলতে দেওয়া হচ্ছে না। রাজনীতিকে খেলার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে।
যদি টেস্ট ক্রিকেট বলি পাকিস্তানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ধবল ধোলাই করে সিরিজ জয় নিঃসন্দেহে বিশাল অর্জন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ১-১ সিরিজ সমতাকেও খাটো করে দেখবো না। কিন্তু ভারতের কাছে ভারতে এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে বাংলাদেশে ধবল ধোলাই প্রমাণ করে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের পায়ের নিচে মাটি এখন জমাট বাধেনি। ক্রিকেট বিশ্বে দুই স্তরবিশিষ্ট পদ্ধতি শুরুর কথা ভাবা হচ্ছে মূলত বাংলাদেশের মতো নিচের সারির দলগুলোর ক্রমাগত ব্যর্থতার কারণেই। শীর্ষস্থানে থাকা ৫-৬ দলের কথা নাইবা বললাম। দেখুন আফগানিস্তানের মত নবীন দল সীমিত সুযোগে প্রমাণ করছে বাংলাদেশ থেকেও টেস্ট ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলার যোগ্যতা আছে ওদের। অথচ যুদ্ধ সংঘাত বিপর্যস্ত দেশটির ক্রিকেট অনুশীলন করতে হয় ভারতে অথবা সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
টেস্ট ক্রিকেট না হয় বাদ রাখলাম নিজেদের শক্তি মত্তার স্থান ওডিআই ক্রিকেটেও বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলোতে ধারবাহিক পারফরম্যান্স করতে পারেনি ২০২৪-এ। পঞ্চ পাণ্ডবদের গোধূলি বেলায় তাদের স্থানে মানসম্পন্ন নতুন খেলোয়াড় উঠে আসেনি। যাদের ওপর নির্ভর করে বিসিবি তাদের খেলায় ধারাবাহিকতা নেই। খেলোয়াড়দের নির্বাচন নিয়েও কথা আছে। বেশ কয়েকজন উঁচু মানের পেস বোলার বিকশিত হতে থাকার কারণে বাংলাদেশ প্রতিপক্ষকে সীমিত টার্গেটে বেঁধে ফেললেও ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার কারণে ম্যাচ জয় করতে পারছে না। আর তাই আইসিসি র্যাংকিংয়ে ৯ম স্থান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
বছরের শেষদিকে বাংলাদেশ শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ওদের মাটিতে ভালো খেলে ওদের ৩-০ ধবল ধোলাই করলেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অথবা দ্বিপাক্ষিক সিরিজে বছর জুড়ে সাফল্য সীমিত। হেরে গাছে আইসিসি সহযোগী দেশের বিরুদ্ধেও। আর তাই এখানেও আইসিসি র্যাংকিং ৯ম।
দেশে চলছে বিপিএল। ঢাকায় প্রথম পর্যায়ের খেলা শেষ হয়েছে, সিলেটে চলছে খেলা। উইকেটগুলো উন্নত হয়েছে। বাংলাদেশের তাসকিন, নাহিদ রানা ভালো বোলিং করছে। আনামুল, সাইফ, ইয়াসির ভালো ব্যাটিং করছে। কিন্তু সার্বিকভাবে খেলার মান বা টুর্নামেন্ট ব্যবস্থাপনা উন্নত হয়েছে বলা যাবে না।
ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানের আয়োজনে পাকিস্তান এবং আমিরাতে অনুষ্ঠিত হবে ৮ জাতির চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। বাংলাদেশকে খেলতে হবে ভারত, পাকিস্তানও নিউ জিল্যান্ডের বিরুদ্ধে গ্রুপ অফ ডেথে। দুই একদিনের মাঠে স্কোয়াড ঘোষণা করতে হবে। নির্বাচকমণ্ডলী স্কোয়াড বিষয়ে মোটামুটি মন স্থির করে ফেললেও সাকিব, তামিমকে নিয়ে সিদ্ধান্ত বিলম্বিত হচ্ছে। তামিম দীর্ঘদিন স্বেচ্ছায় নিজেকে সরিয়ে রাখার পর এখন বিপিএল খেলছে। যেহেতু দলে ওপেনিং ব্যাটিং এবং টপ অর্ডার ব্যাটিং নিয়ে সমস্যা আছে, তাই তামিম সম্মত থাকলে অটোমেটিক চয়েস থাকবে। সাম্প্রতিক ফর্মের কারণে সৌম্য সরকার দলে না থাকার কারণ দেখি না। সমস্যা লিটন এবং শান্তর ব্যাটে দীর্ঘ রান খরা। অথচ ওদের দুইজনের একজন অধিনায়ক হবে। লিটনকে হয়তো উইকেট কিপারের বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে হবে। ফর্ম ফিটনেস বিবেচনায় তানজিদ তামিম, পারভেজ ইমন এমনকি আনামুল হক এদের মাঝ থেকে একজনকে বেছে নিতে হবে।
সমস্যা ৩ নম্বর পসিশন নিয়ে শান্ত কিন্তু পারফরমেন্স দিয়ে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারছে না। জানিনা নির্বাচকরা সাইফ হাসানের ওপর ভরসা রাখতে চাইবে কি না। মুশফিকুর রাহীম, তাওহীদ হৃদয়, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, জাকের আলী মিডল অর্ডারে মোটামুটি নিশ্চিত। সোনায় সোহাগ হবে সাকিব যদি শেষ পর্যন্ত সমস্যা কাটিয়ে স্কোয়াড ভুক্ত হয়। বাংলাদেশের লেট অর্ডারে রিয়াদ, জাকের, অনিক এমনকি মেহেদী মিরাজ সাম্প্রতিক সময়ে ভালো খেলায় ভরসা করতে পারে বাংলাদেশ। এমনকি লেগ স্পিনার রিশাদ হোসেন স্ট্রোকস খেলতে পারে। বাংলাদেশ স্কোয়াডে ম্যান সম্পন্ন পেস বলার থাকবে। বর্তমান অবস্থায় তাসকিন, মুস্তাফিজ, নাহিদ রানা, হাসান মাহমুদ অটোমেটিক চয়েস। সাকিব খেললে বাংলাদেশ এমনকি পাঁচ জন পেসার স্কোয়াডে রাখতে পারবে। সাকিবকে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক কারণে বঞ্চিত করা হলে হয়তো নাসুম আহমেদ অথবা শেখ মাহেদিকে স্কোয়াডে নিতে হবে।
বাংলাদেশকে প্রথম ম্যাচে ভারতকে মোকাবেলা করতে হবে। বহুল আলোচিত বর্ডার গাভাস্কার সিরিজে ১-৩ হেরে আসা ভারত ক্রিকেট দল কিন্তু মরিয়া হয়ে থাকবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ঘুরে দাঁড়াতে। টুর্নামেন্টের আগে ভারত দেশে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সিরিজ খেলবে। বাংলাদেশ কিন্তু আগেও বিশ্ব পর্যায়ে ভারতকে হারিয়ে ওদের স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে।
সতর্কতার সঙ্গে পরিকল্পনা সাজিয়ে খেললে গ্রুপ পর্যায়ে বাংলাদেশ ভারত, পাকিস্তান এবং নিউজিল্যান্ডের মধ্যে অন্তত দুটি দলকে হারানোর যোগ্যতা রাখে। কিন্তু বাংলাদেশকে অবশ্যই সব বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে তামিম, সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাকে একসঙ্গে শেষবারের মতো দেশের হয়ে গর্জে ওঠার সুযোগ দিতে হবে।