২৬ অক্টোবর ২০২৫, রবিবার, ০৩:২২:৬ পূর্বাহ্ন


অতিবাহিত হলো ৬ মাস : অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা-প্রাপ্তি
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৫-০২-২০২৫
অতিবাহিত হলো ৬ মাস : অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা-প্রাপ্তি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস


আগস্ট ২০২৪ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৫, নতুন সরকারের ৬ মাস চলে গেল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফসল অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার আর পরিবর্তনের আকাশছোঁয়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়েছে, দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত দুর্নীতি, কুশাসন, স্বেচ্ছাচারিতা, দুষ্টু রাজনৈতিক এবং সামাজিক ব্যাধিমুক্ত সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ বহুমাত্রিক। তবুও দৃশ্যমান পরিবর্তন সূচনা করার জন্য ৬ মাস একেবারে কম সময় নয়। কিন্তু ছাত্র, যুবসমাজের একাংশ বিশেষত স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের দাপটে মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর মূলোৎপাটন করার মেয়াদি পরিকল্পনা করতে পারেনি সরকার। ঘুষ, দুর্নীতির পদ্ধতি পরিবর্তন হয়েছে, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট দৌরাত্ম্য চলছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা কমেনি। নদী, খাল, জলাশয় ভূমি দস্যুদের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হয়নি। মহানগরীগুলোর যানজট, জলজট, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ পরিস্থিতির আদৌ উন্নতি হয়নি। সিন্ডিকেট দৌরাত্ম্য চলতে থাকায় এবং সরকার শুল্ক করারোপ করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বেসামরিক প্রশাসন কার্যকর হয়নি। চলছে শুধু আওয়ামী ঘনিষ্ঠ বিবেচনায় চাকরিচ্যুতি এবং উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। 

ক্ষমতাচ্যুত সরকারের মতো বর্তমান সরকারের আমলেও চেষ্টা শুধু সরকারের সেবাদাস প্রশাসন গড়ে তোলার চেষ্টা। শুধু ব্যাংকিং খাতে কিছু সংস্কার দৃশ্যমান হয়েছে, অর্থ পাচার বন্ধ, অর্থনৈতিক খাতে সংস্কার হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা-স্বাস্থ্য, শিল্প-বাণিজ্য, কৃষি, পরিবেশ, যোগাযোগ খাতে নানা সংকটের কোনো শুভ পরিবর্তন হয়নি। নানা সংকটে দুলছে শিল্পখাত। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে এবং ব্যাংক ঋণের চাপে অনেক ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক বৃহৎ শিল্প বন্ধ হওয়ার পথে। হাহাকার করছে শিল্পমালিকরা। রফতানি কমেছে, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আশংকাজনকভাবে কমছে। তড়িঘড়ি করে কিছু চটকদার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে জ্বালানি-বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে নতুন বিনিয়োগে ঝুঁকি নিচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। এমতাবস্তায় অনেক মানুষ চাকরি হারাচ্ছে, বেকার সমস্যা প্রকট হচ্ছে। সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা, সরকারের মুখমাত্র প্রতিনিয়ত আওয়ামী লীগ এবং ভারতবিরোধী প্রচারণায় ব্যস্ত থাকায় স্বাভাবিক কারণেই সমাজে বিভক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলধারার রাজনৈতিক কয়েকটি দলের সঙ্গে সরকারের বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে। সংগত কারণেই ঘরে-বাইরে যথাশিগগির জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য চাপ বাড়ছে। 

কিছু কথা না বললেই নয়, সরকার পরিবেশ উন্নয়ন বিষয়ে কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল। পলিথিন ব্যবহার পরিহার, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ, নদী-খাল পুনরুদ্ধার করার ঘোষণায় জনগণ উৎসাহিত হয়েছিল। এগুলোর সাফল্য কতটুকু? বর্তমান অবস্থায় মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই, সরকার ভূমিদস্যুদের হাত থেকে নদী-খাল, জলাশয়মুক্ত করতে আদৌ সক্ষম হবে। এ কাজে কেন সংগঠিত যুবশক্তিকে ব্যবহার করা গেল না? কেন নগর-মহানগরগুলোর সড়ক যানজট, জলজট, শব্দদূষণ মুক্ত করা যাচ্ছে না। এগুলোর দৃশ্যমান পরিবর্তন না করে প্রবাল দ্বীপ, সেন্ট মার্টিন ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যটন সুবিধা বর্জন করে দ্বীপের প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের অর্থনৈতিক সংকটে ফেলা হঠকারিতা মনে হচ্ছে। সঠিক মনিটরিং করে কেন সেন্ট মার্টিনে পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না? অবশ্য খোদ ঢাকা এবং চট্টগ্রামেই যখন অবাধে উন্নয়নের নামে বৃক্ষনিধন হচ্ছে, সেখানে দুর্বল নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা দিয়ে প্রবাল দ্বীপ পরিবেশ রক্ষার প্রচেষ্টা দূরাশা হবে। 

আসুন, জ্বালানি-বিদ্যুৎ সংকট নিরসন পরিকল্পনায়। প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহ সংকটের কারণে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ সংকট চলমান। ভুল পরিকল্পনায় দেশের গ্যাস উৎপাদনে ধস নেমেছে, ডলার, টাকার অভাবে বিদেশ থেকে কয়লা, এলএনজি, তরল জ্বালানি আমদানি ক্ষমতা সীমিত। আসন্ন নিবিড় সেচ কাজ, রমজান এবং গ্রীষ্মকালে তীব্র বিদ্যুৎ সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। সরকার ক্ষমতায় এসে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে পর্যালোচনা না করেই বেশ কিছু চুক্তি বাতিল করেছে। নতুন করে সঠিক পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করে নতুন চুক্তি করতেই বর্তমান সরকারের মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে। আর বর্তমান সরকারের মেয়াদে এখন দেশ-বিদেশের বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ করতে উৎসাহ দেখাচ্ছে না। দেশের প্রাথমিক জ্বালানি আহরণ এবং উন্নয়ন পরিস্থিতি হতাশাজনক। অবৈধ ব্যবহার এবং অপচয় রোধ প্রচেষ্টায় অগ্রগতি সামান্য। ২০২৫, ২০২৬, ২০২৭ জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকট উত্তরণ বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। সরকার এমতাবস্তায় জ্বালানি-বিদ্যুৎ মূল্য যৌক্তিক উপায়ে সমন্বয় না করলে শুধু ভর্তুকি দিয়ে বিপিডিবি, পেট্রোবাংলার মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রাখতে পারবে না। সরকারের সুযোগ ছিল জ্বালানি-বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠাগুলো আমলাদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে সঠিক পেশাদারদের দিয়ে সাজানোর। কিন্তু যা করেছে সেটাকে পুরোনো বোতলে নতুন মদের মতো। কয়লা আহরণের চিন্তা সুদূর পরাহত, গ্যাস অনুসন্ধান, উন্নয়নের আকাশকুসুম পরিকল্পনা কতটুকু সফল হয় সময় বলে দেবে। জ্বালানি-বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের মহাদুর্নীতিবাজরা এখনো রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সেক্টরে কাজ করা মেধাবী, তরুণ প্রজন্ম বৈষম্যের শিকার হয়ে হতাশ দ্বিধাগ্রস্ত। 

শিক্ষাঙ্গনে চলছে অস্থিরতা। ঢাকার সাত কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বন্দ্ব সংঘাতে রূপ নেওয়ায় পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে নেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজেও বিভেদ দৃশ্যমান। ইবতেদায়ি মাদরাসাগুলোর বঞ্চিত শিক্ষক সমাজের দাবিগুলো সুরাহা হওয়া জরুরি। ছাত্রসমাজের একটি অংশ পড়ালেখা ছেড়ে সরকারকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় শিক্ষাঙ্গনে অরাজকতা এবং অস্থিরতা বিরাজ করছে। স্কুলের কোমলমতি শিশুদের পড়ার বইগুলো থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পরিবর্তন করে উপস্থাপন করা হয়েছে। বছরের শুরুতে বই শিষ্যের হাতে পৌঁছানো হয়নি। 

শিল্পক্ষেত্রে প্রায়শই শ্রমিক বিক্ষোভ ও ভাঙচুর হচ্ছে। বেক্সিমকোর মতো একটি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা দীর্ঘদিন বেতনহীন থাকায় শিল্পাঞ্চলে অরাজকতা চলছে। সরকারের ব্যর্থতার কারণে পূর্ববর্তী সরকারের সময়ের লুটেরা শিল্পপতিরা শিল্প অঞ্চলকে অস্থির করার সুযোগ পাচ্ছে। শিল্পকারখানাগুলোতে অরাজকতা বিরাজ করায় রফতানিমুখী শিল্পকারখানাগুলো সংকটে পড়েছে। বাংলাদেশের শিল্পপণ্য বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা হারাচ্ছে, এভাবে চললে বাংলাদেশের রফতানি খাত দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পড়বে। 

সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেও বাজার সিন্ডেকেটগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। আর বাজারে পণ্য সরবরাহে সংকট না থাকলেও সিন্ডিকেটের কারণে উৎপাদন স্তরে কৃষক এবং অন্যপ্রান্তে গ্রাহক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। মোটকথা, অরাজনৈতিক সরকার বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে। সরকার এবং প্রশাসন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সংযুক্ত করে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। 

সমাজে বিরাজমান বহুমাত্রিক সংকটের মধ্যে সরকারের ওপর দ্রুত নির্বাচনের চাপ বাড়ছে। দু-একটি রাজনৈতিক দল ভেবেই নিয়েছে নির্বাচন হলেই সরকার গঠন করবে। মাঠ পর্যায়ে তাদের নেতা, পাতি নেতারা ইতিমধ্যেই চাঁদাবাজি, দখলদারি শুরু করেছে। হামলা মামলার হুমকি দিয়ে জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলো তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সম্মত সংকারগুলোর তালিকা প্রণয়ন করবে। বলাবাহুল্য, অনির্বাচিত সরকার অধিকাংশ সংস্কার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। অধিকন্তু সরকার আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ মূলধারার বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে আলোচনার বাইরে রেখে আলোচনা করায় এক্ষেত্রেও বিভাজন থাকবে। সরকারপ্রধান নিজেই ছাত্রদের পৃথক রাজনৈতিক দল গঠনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে মূলধারার অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বর্তমান পরিস্থিতি বিরাজ করলে নির্বাচন নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে। 

প্রসঙ্গে ফিরে আসি। অন্য সময়ের মতো আর্বার প্রমাণ হয়েছে প্রথাগত রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া বাংলাদেশের সমস্যা এবং সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তবে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদেরও গণতন্ত্রায়নসহ নানা সংস্কারের প্রয়োজন আছে। এখন যে কথাগুলো ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিএনপি বলছে, নিজেরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার সময় সেগুলো করেনি। প্রত্যাশী জনগণ কিন্তু ৬ মাসে শুভ পরিবর্তনের ছিটেফোঁটাও দেখতে পায়নি। বিশ্বরাজনীতি কিন্তু জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। প্রভাবশালী প্রতিবেশীর সঙ্গে সার্বভৌম সমতারভিত্তিতে সুসম্পর্ক বজায় না রাখলে বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা আসবে না। আর স্থিস্তিশীলতা না থাকলে কোনো সরকার বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রা অব্যাহত রাখতে পারবে না। আশা করি, দেশপ্রেমিক জনসাধারণ আগামী নির্বাচনে সৎ দেশপ্রেমিক প্রতিনিধিদের নির্বাচন করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় গুণগত পরিবর্তন আনবে। 

শেয়ার করুন