হঠাৎ ঢাকার পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেলো? না-কি খারাপ করানো হলো? এভাবে কি সামনের দিনগুলি আরও খারাপের দিকে যাবে? এরই মধ্যে সতর্ক করা হচ্ছে, নিজেরা কাদা ছোঁড়াছুড়ি করলে সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে-সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের এমন পরিষ্কার সর্তক বার্তা রাজনৈতিক, সামাজিক সর্বক্ষেত্রে নতুন মাত্রা তৈরি করেছে। নানান ধরনের জল্পনা-কল্পনায় এখন ভাসছে দেশ।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলতি মাসের শুরুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্ট দেন। ওই পোস্টের মাধ্যমে তিনি জানান যে, তার দলের ভাতৃপ্রতীম সংগঠন বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখবেন। ওই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রচারের খবরেই সারা দেশ ফুসে উঠে। চলে প্রায় তিনদিন মহাতান্ডব। আর এমন তান্ডনে সারাদেশে যা যা হবার হয়ে গেলেও জনমনে প্রশ্ন জাগে আসলে হচ্ছে কি? কেননা এরপরই খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা সারাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা দেয়।
এরই মধ্যে সারাদেশ জুড়ে দেখা দেয় আইন শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ উৎকন্ঠা। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভয়াবহভাবে খবর বের হয় যে, মহাসড়কে বাসের ভেতরে অস্ত্র ঠেকিয়ে ধর্ষণ। খবর প্রকাশিত হয় মধ্যরাতে ব্যবসায়ীকে গুলি করে সোনাদানা ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা। এমনকি প্রকাশ্যেই দেখা যায় চলন্ত বাসে অস্ত্র ঠেকিয়ে লুটতরাজ, ঘটে যায় ট্রিপল মার্ডারের মতো ঘটনা। আবার দেখা যায় কিশোর গ্যাং এর দু:সাহসিক মহড়া। অথচ দেশ জুড়ে চলছে শয়তান পাকাড়াওকে টার্গেট করে ‘ডেভিল হান্ট’ নামে বিশেষ অভিযান। কিন্তু এত্তো-কিছুর মধ্যেও খুনোখুনি, মব ভায়োলেন্স চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণ থেমে থাকছে না। আর এসব ঘটনায় ভয়ার্ত দেশবাসী হত্যা, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, ছিনতাই, ডাকাতিসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির প্রতিবাদে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সোমবার দেশজুড়ে বিক্ষোভ হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক, নাগরিক ও সামাজিক সংগঠন দ্রুত জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার এমনকি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পদত্যাগ দাবি-ও করেছেন বিক্ষোভকারীরা।
গভীর রাতে সংবাদ সম্মেলন নিয়ে আরও আতঙ্ক
এদিকে ঘটনা প্রবাহের মধ্যে আরেকটি বিস্ময় হলো, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গভীর রাতে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকা নিয়ে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এই সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। রবিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর বারিধারায় ডিওএইচএসের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বাসভবনে এই সংবাদ সম্মেলন শেষ হতে না হতেই তার বাসায় আসেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। এরপরের দিনে বিকেলে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত কোর কমিটির সভা শেষে সাংবাদিকদের দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি করতে ওইদিন সন্ধ্যার পর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ শুরু করছে বলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান। এ বিষয়ে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘সন্ধ্যার পর থেকে পরিস্থিতি টের পাবেন।’ একের পর এক ঘটনায় যখন জনগণ যখন মহা উদ্বেগে ভাসছে তখন খবর আসে কক্সবাজারে অবস্থিত বিমান বাহিনী ঘাঁটি কক্সবাজার সংলগ্ন সমিতিপাড়ার কিছু স্থানীয় দুর্বৃত্ত সোমবার (২৪-২-২০২৫) তারিখে বিমান বাহিনী ঘাঁটি কক্সবাজারের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছে। যা নিয়ে জনমনে আরও টেনশন বাড়তে থাকে।
আসলে কী হচ্ছে?
কারো কারো দেশে একটির পর একটি ইস্যু তৈরি করে নানান ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বা করানো হচ্ছে কারো নেপথ্য কলকাঠির ইশারায়। কখনো দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠ গরম, কখনো বিভিন্ন ইস্যুতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একের পর এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে বা ঘটানো হচ্ছে। যাতে পুরো দেশ বিষিয়ে উঠে। এর আগে বলা যায় অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল দু’টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে মারাত্মক তর্কযুদ্ধ। কোথাও কোথাও এই বাকযুদ্ধ সহিংসতায় রূপ নেয়। নির্বাচন আগে না সংস্কার আগে-এই ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে বলা চলে এখন মুখোমুখি অবস্থান। জামায়াতকে বিএনপি বলা চলে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি বলে তাদের সাথে সম্পর্ক না রাখার দিকে হাঁটতে থাকে। যদিও বহুদিন ধরে এই দলটির সাথে বিএনপি’র দহরম মহরম রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে দলের কারারুদ্ধ সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল (সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল) এ টি এম আজহারুল ইসলামের মুক্তির দাবিতে রাজপথে হঠাৎ করেই বেশ শক্ত অবস্থান নেয় জামায়াতে ইসলামী। অবিলম্বে তার মুক্তি নিশ্চিত করতে ঢাকাসহ সারাদেশে বিক্ষোভের পর এবার আরো জোরালে কর্মসূচি পালনের ডাক দেয় তারা। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান এ টি এম আজহারের মুক্তির দাবিতে আদালতে গিয়ে স্বেচ্ছায় কারাবরণের ঘোষণা দিলেও পরে নতুন এক কর্মসূচি দাঁড় করায়। এমনকি ২৫ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ঘিরে গণঅবস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে দলটি রাজধানীতে ব্যাপক শোডাউন করবে বলে জানিয়ে দেয়। এমন পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সোমবার বৈঠক করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।
জামায়াত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে জামায়াতের আমিরের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের নায়েবে আমির সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের। এরপরই সোমবার রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সামনে ঘোষিত অবস্থান কর্মসূচি আপাতত স্থগিত ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। কারো কারো মতে, পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে দেশের সার্বিক ঘটনা ও এর আগে বিএনপি-জামায়াতের বাক-যুদ্ধ ও সহিংসতার ঘটনা দেশে বিদেশে মারাত্মক নেতিবাচব প্রভাব ফেলেছে। এসব ঘটনার পাশাপাশি কয়েকটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে মারাত্মকভাবে ভারত বিরোধীতাকে পুঁজি করে পশ্চিমাদের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে খারাপ মেসেজ দেয়া হয়েছে।
তুলে ধরেছে বাংলাদেশে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার মৌলবাদি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির কাছে ধীরে ধীরে অনেকটা প্রকাশ্যেই নত হয়ে যাচ্ছে। কারো কারো আশঙ্কা এর দায়ভার গিয়ে পড়েছে পুরো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘাড়ে। শুধু তা-ই নয় এর দায়ভার গিয়ে পড়েছে পুরো প্রশাসনের স্পর্শকাতর সংস্থার ওপর। এমন পরিস্থিতি কতটা নাজুক হয়েছে তা বুঝা যায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের একটি মাত্র মন্তব্যে। নয়াদিল্লির প্রতি ঢাকার ক্রমাগত অবন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের অভিযোগ তুলে এস জয়শঙ্কর সতর্কবার্তা দেন। তিনি বলেন, ঢাকাকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা আমাদের সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক চায়। পাল্টা কথা বলেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, ভারতকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কোন ধরনের সম্পর্ক চায়। কারো মতে, সারাদেশে উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান এ টি এম আজহারের মুক্তির দাবিতে আদালতে গিয়ে স্বেচ্ছায় কারাবরণের ঘোষণার পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সামনে ঘোষিত অবস্থান কর্মসূচি দেশে বিদেশে ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।
এক দিকে জামায়াতের সংস্কার নিয়ে বিএনপি’র সাথে বাড়াবাড়ি যেমন রাজনৈতিক অঙ্গনে ভয়াবজ তিক্ত পরিবেশের তৈরি করেছে অন্যদিকে সারাদেশে এই মাসে বিভিন্ন স্থানে সহিংস ঘটনা খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ ঠেকেছে অনেকের কাছে । আবার এ টি এম আজহারের মুক্তির দাবিতে এই মাসেই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সামনে ঘোষিত অবস্থান কর্মসূচিকে-ও অনেকে সন্দেহের চোখে দেখছে, যদিও এটি স্থগিত করা হয়েছে। কারো কারো মতে, এ টি এম আজহারের মুক্তির দাবিতে জামায়াতের এমন কমসূচি স্থগিত করতে হয়তবা বড়ো ধরনের চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। কেননা আশঙ্কা করা হয় জামায়াতের এমন কর্মসূচি বজায় থাকলে দেশ মারাত্মক এক পরিস্থিতি দিকে ধাবিত হতে পারে।
এমন কর্মসূচি ঠেকাতে বা জামায়াতের লাফালাফি বন্ধ করতে হঠ্যাৎ একটি পরিস্থিতি তৈরি করা হয়ে থাকতে পারে বলেও কারো অনুমান। কারো কারো মতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মধ্যে নানান ধরনের বিরোধ দেখা দেয়া বা তাদের নিয়ে একটা সন্দেহের জালও ইতোমধ্যে তৈরি করা হয়েছে। তবে সার্বিক বিষয়গুলি দ্রুত থামিয়ে দিতে রাজনৈতিক মাঠে কোনো ধরণের রাজনৈতিক চালের অংশই এমন অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে কি-না তা সময় বলে দেবে।