১৩ মে ২০২৫, মঙ্গলবার, ০৬:২২:৫২ পূর্বাহ্ন


শরিয়া আইন চালুর আশঙ্কায় মুসলিম আবাসন প্রকল্প বন্ধের উদ্যোগ
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৩-০৪-২০২৫
শরিয়া আইন চালুর আশঙ্কায় মুসলিম আবাসন প্রকল্প বন্ধের উদ্যোগ টেক্সাসে ইস্ট প্লানো ইসলামিক সেন্টারের (ইপিক) উদ্যোগে মুসলিমদের জন্য পরিকল্পিত আবাসন প্রকল্প ইপিক সিটি


টেক্সাসে মুসলিমদের জন্য পরিকল্পিত আবাসন প্রকল্প ইপিক সিটি ঘিরে শুরু হয়েছে তীব্র রাজনৈতিক বিতর্ক ও আইনি তদন্ত। ইস্ট প্লানো ইসলামিক সেন্টারের (ইপিক) উদ্যোগে ডালাসের উপকণ্ঠে নির্মিতব্য এই বৃহৎ প্রকল্পটিতে হাজারেরও বেশি আবাসিক ইউনিট, একটি মসজিদ, ইসলামিক স্কুল, কমিউনিটি কলেজ, বৃদ্ধাশ্রম, চিকিৎসাকেন্দ্র এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট ও অ্যাটর্নি জেনারেল কেন প্যাক্সটন ইতিমধ্যে ইপিক সিটি প্রকল্পের বিরুদ্ধে একাধিক তদন্ত শুরু করেছেন। তাদের অভিযোগ- এই প্রকল্পের আড়ালে শরিয়া আইন চালুর চেষ্টা থাকতে পারে। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ইপিক সিটির বিরুদ্ধে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পরিচালনার লাইসেন্স না থাকার অভিযোগে নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধের নোটিশও পাঠানো হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পে অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান কমিউনিটি ক্যাপিটাল পার্টনার্সের বিরুদ্ধেও সিভিল ইনভেস্টিগেশন ডিমান্ড জারি করা হয়েছে।

গভর্নর অ্যাবট ইতিমধ্যে টেক্সাস অ্যাটর্নি জেনারেল, ওয়ার্কফোর্স কমিশন, স্টেট বোর্ড অব সিকিউরিটিজ, ফিউনারেল সার্ভিস কমিশন এবং টেক্সাস রেঞ্জার্সসহ রাজ্যের বেশ কয়েকটি সংস্থাকে ইপিক সিটি নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে, টেক্সাসের রিপাবলিকান সিনেটর জন থুন গত ১৮ এপ্রিল ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের সিভিল রাইটস বিভাগের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হারমিত ধিলনকে একটি চিঠি পাঠিয়ে ইপিক সিটি ও ইপিক র‍্যাঞ্চেস প্রকল্পে ফেডারেল তদন্তের দাবি জানান। চিঠিতে থুন উদ্বেগ প্রকাশ করেন, এই প্রকল্পের উদ্যোক্তারা ইহুদি ও খ্রিস্টান টেক্সাসবাসীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারেন এবং প্রকল্পে তাদের অংশগ্রহণে বাধা তৈরি হতে পারে। তিনি বলেন, এ ধরনের বৈষম্য সংবিধানের প্রথম ও চতুর্থ সংশোধনী লঙ্ঘনের শামিল। করনিন আরো দাবি করেন, কমিউনিটি ক্যাপিটাল পার্টনারস হয়তো ১৯৬৮ সালের ফেয়ার হাউজিং অ্যাক্ট লঙ্ঘন করছে।

প্রকল্পের উদ্যোক্তারা এই অভিযোগকে ‘অসত্য ও বিদ্বেষপ্রসূত’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। কমিউনিটি ক্যাপিটাল পার্টনারস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইপিক সিটি রাজনৈতিক খেলার অংশ হয়ে উঠেছে। এই আক্রমণ প্রকল্পের উদ্দেশ্য নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তারা বলেন, ‘আমরা সব ধর্ম, জাতি ও সংস্কৃতির মানুষের জন্য একটি নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সম্প্রদায় গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সিনেটর কর্নিনের চিঠির কড়া সমালোচনা করেছে মুসলিম নাগরিক অধিকার সংগঠন কেয়ার। তারা ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসকে গভর্নর অ্যাবট, অ্যাটর্নি জেনারেল প্যাক্সটন এবং অন্যান্য রাজ্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।

কেয়ার টেক্সাসের নির্বাহী পরিচালক মুস্তাফা ক্যারল এক বিবৃতিতে বলেন, ইপিক র‍্যাঞ্চেস একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্যোগ। এটি লজ্জার বিষয় যে সিনেটর করনিন মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অপপ্রচার চালাচ্ছেন। ইপিক র‍্যাঞ্চেস প্রকল্পটি জোসেফাইন এলাকায়, টেক্সাসের ডালাস থেকে ৩০ মাইল উত্তর-পূর্বে গড়ে তোলা হচ্ছে। এর লক্ষ্য হলো সাশ্রয়ী আবাসন, সম্প্রদায়িক সহায়তা এবং পরিবেশবান্ধব টেকসই বসবাসের সুযোগ তৈরি করা। এতে থাকবে একক পরিবার, টাউনহাউস, অ্যাপার্টমেন্ট, ইসলামিক কে -১২ স্কুল, মসজিদ, বৃদ্ধাশ্রম, চিকিৎসাকেন্দ্র, খুচরা দোকান, ক্রীড়া মাঠ ও কমিউনিটি স্পেস।প্রকল্পটি মুসলিম নেতৃত্বাধীন হলেও এটি সকল ধর্ম, জাতি ও সংস্কৃতির মানুষের জন্য উন্মুক্ত বলে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন। এটি যুক্তরাষ্ট্রে অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর পরিচালিত আবাসন প্রকল্পগুলোর মতোই একটি মডেল কমিউনিটি হিসেবে কাজ করতে চায়।

গত ১৮ এপ্রিল টেক্সাসের আর্ভিং শহরের উইন্ডহ্যাম ডিএফডব্লিউ এয়ারপোর্ট হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিস্টান ধর্মীয় নেতারা একত্রিত হয়ে ‘ইপিক সিটি’ নামক মুসলিম-প্রধান আবাসন প্রকল্পের বিরুদ্ধে চালানো চলমান রাজনৈতিক হামলার তীব্র প্রতিবাদ জানান। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনসের ডালাস-ফোর্ট ওয়ার্থ শাখার নির্বাহী পরিচালক মুস্তাফা ক্যারল, জিউইশ ভয়েস ফর পিসের ডিএফডাব্লিউ শাখার মুখপাত্র ডেব আর্মিনটর এবং ইভাঞ্জেলিক্যাল লুথারান চার্চ ইন আমেরিকার স্বীকৃত মন্ত্রী রবার্ট স্মিথ। তারা বলেন, টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট এবং অ্যাটর্নি জেনারেল কেন প্যাক্সটন ইপিক সিটি ও এর সংশ্লিষ্ট ইস্ট প্লানো ইসলামিক সেন্টারের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক তদন্ত পরিচালনা করছেন, যা ধর্মীয় নিপীড়নের শামিল।

মুস্তাফা ক্যারল বলেন, টেক্সাসের নেতারা মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ মিথ্যাচার প্রচার করছেন, যা আমাদের জীবন ও নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি। তিনি আরো জানান, রাজ্য কর্তৃপক্ষের এই ধরনের কার্যকলাপ মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও সহিংসতা উসকে দিচ্ছে। ডেব আর্মিনটর বলেন, আমাদের সম্প্রদায়ের জন্য আজকের পরিস্থিতি এক অতি গুরুতর সংকট। আমরা এমন সহিংসতা ও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছি, যা আমাদের ধর্মীয় ও জাতিগত বৈচিত্র্যের সমাজকে বিভক্ত করতে চায়। সংবাদ সম্মেলনে আরো বলা হয়, এই ধরনের আক্রমণের শিকার শুধু মুসলিমরাই নন, বরং অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও সাম্প্রতিক সময়ে সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় নেতারা একত্রিত হয়ে মুসলিমদের মানবাধিকার রক্ষায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

এই মুহূর্তে টেক্সাসে ইপিক সিটি ও ইপিক র‍্যাঞ্চেস প্রকল্পকে ঘিরে যে রাজনৈতিক উত্তেজনা, আইনি তৎপরতা ও ধর্মীয় বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তা শুধু এই একটি প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য উন্নয়নমূলক উদ্যোগ গ্রহণের অধিকারের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। একদিকে যখন মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতারা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বহুমাত্রিক আবাসিক কমিউনিটি গড়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, অন্যদিকে রাজ্য ও ফেডারেল পর্যায়ের রাজনীতিক ও কর্মকর্তারা এই উদ্যোগের পেছনে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিভাজনের আশঙ্কা করছেন। বিষয়টি এখন কেবল একটি আবাসন প্রকল্পের সীমায় সীমাবদ্ধ না থেকে, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান, নাগরিক অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক পক্ষপাতের জটিল সমীকরণে রূপ নিচ্ছে। এই অবস্থায় প্রয়োজন ন্যায়সংগত, স্বচ্ছ ও অসাম্প্রদায়িক তদন্ত এবং সংবিধানসম্মত মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ যাতে উন্নয়ন ও বৈচিত্র্যের সহাবস্থান একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠতে পারে।

শেয়ার করুন