নির্বাচনী রোডম্যাপ ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল বৈঠক হয় গত সপ্তাহে। বৈঠকের পর পরই নানা কানা ঘুষা চলে রাজনৈতিক অঙ্গনে। কারণ ওই বৈঠক থেকে বেড়িয়ে এসে বিএনপি নেতারদের দেখা গেল- যেনো তারা সব হারিয়ে ফেলেছেন। বলা চলে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। গণমাধ্যমে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঝাড়লেন এই বলে যে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলোচনায় নির্বাচনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না পাওয়ায় বিএনপি সন্তুষ্ট না।
হঠাৎ করেই রাজনীতিতে গুঞ্জন বাড়লো
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এমন উষ্মা প্রকাশের পরপরই রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জনের ডালপালা বাড়তে থাকে। কারো কারো আশঙ্কা থেকে বলতে শোনা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মাঠে বর্তমানে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি’র দূরত্ব বাড়ছে।
ঘি ঢেলে দিলেন মান্না
রাজনৈতিক অঙ্গনে যখন এমন টান টান উত্তেজনা ঠিক এমন সময়ে আগুনে ঘি ঢেলে ঢেলে দেয়ার মতো বক্তব্য দিলেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মতপার্থক্য স্পষ্ট হতে শুরু করেছে বলে মন্তব্য করে দিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না। ওই সময়ে একটি আলোচনা সভায় আরও বললেন, গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশের আকাশে নতুন করে মেঘের আবির্ভাব হয়েছে। যে রকম করে দেশের বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের মতপার্থক্য প্রকাশিত হয়েছে, এটি আমাদের সবার জন্য দুশ্চিন্তার।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক নিয়েও সন্দেহ
এদিকে গত সপ্তাহে ১৬ এপ্রিল বুধবার নির্বাচনী রোডম্যাপ ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল বৈঠকটি নিয়ে যখন নানান কানা-ঘুষা তখন তার পরের দিনই ছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক। বৈঠককে সামনে রেখে এমন বক্তব্য আসলে কতাটা বিএনপি ভূমিকা রাখবে বা সন্তুষ্ট হবে তা-নিয়ে চলে নানান ধরনের জল্পনা কল্পনা চলতেই থাকে। এবং দেখা গেলো তা-ই হলো। ভাষা ভাষা কন্ঠে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গণমাধ্যম বললেন, সংবিধান সংস্কার সুপারিশের প্রস্তাবনা, প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্রের মূলনীতি, রাষ্ট্র পরিচালনায় মূলনীতি, মৌলিক অধিকার এবং আইন বিভাগ পর্যন্ত আলোচনা হয়েছে। বিচার বিভাগ নিয়ে আলাদা আলোচনা করেছি। জানিয়ে দিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে প্রশ্ন রয়েছে যে, কিছু বিষয় এমন আছে, যেগুলো আবার আমাদের দলীয় ফোরামেও আলোচনা করতে হবে।
গুঞ্জন আরও বাড়লো
এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে সব মহলেও উঠে আসে যে, মাহমুদুর রহমান মান্না ঠিক ধরেছেন যে, দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মতপার্থক্য স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। কারো কারো ধারণা জন্মে যে, কঠোর মারদাঙ্গা কর্মসূচি নিয়ে বিএনপি মাঠে নামবে। কেননা ইতোমধ্যেই বিএনপি দ্রুত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাবিতে দেশের প্রায় সবদলকে এক কাতারে নিয়ে চলে আসে। দলটির সাথে অতীতে ফ্যাসিবাদ পতনের আন্দোলনে যুগপৎ-এ না থাকলেও দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে তারাও মাঠে নামতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হয়। বলা চলে দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে জামায়াত ছাড়া বিএনপি’র সাথে একাকাতারে চলে আসে মাঠের সব রাজনৈতিক দল।
হুংকার ছাড়লেন দুদু
এদিকে রাজধানীতে এক সমাবেশে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এই অভিযোগ করে বলেন, এই সরকারের কাজ-কামে দেশবাসী খুবই উদ্বিগ্ন। তারা (সরকার) কি চায়- সেটাও আমরা বুঝি না। বিএনপিকে পাশ কাটানোর জন্য যাতে বিএনপি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, মানুষের সমর্থন আদায়ের মধ্য দিয়ে, ভোটের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করতে না পারে সেজন্য নির্বাচনকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে আমরা মনে করি। সরকারের উদ্দেশ্যে দুদু হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, আপনাকে আগেও বলেছি, হাসিনাকে যখন তাড়াতে পেরেছি, অন্য ফ্যাসিবাদের যদি উদ্ভব ঘটে তাদের তাড়ানো বাংলাদেশের মানুষের ‘ওয়ান-টু’র ব্যাপার।
হুংকার থেকে বিএনপি’র সরে দাঁড়ানো এবং নরম করলো সুর
রাজনৈতিক অঙ্গনে যখন চাওড় হয়ে গেছে যে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে নামছে বিএনপি। মাঠ আবার গরম হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ বাড়ছে। আর ঠিক তখনই গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন আলোচনা উঠে এলো সরকারকে চাপে রাখার কৌশল নিচ্ছে বিএনপি। সে-চাপ যে খুব জোরালো হবে বলে মনে হচ্ছে না। অনেকটা ধরি মাছ না ছুই পানির মতো। প্রশ্ন হচ্ছে কেনো এমন হলো। হঠাৎ কিসে বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের দাবিকে শক্ত আন্দোলন বাদ দিয়ে কৌশলী আওয়ার আওয়াজ দিচ্ছে।
এদিকে বিএনপি’র পক্ষ থেকে আরও সুর নরম হলো যা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের বক্তব্য থেকে উঠে আসে। তিনি বলেছেন, নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। কারণ, এই সরকারকে তো আমরাই সমর্থন দিয়ে বসিয়েছি। ১৯ এপ্রিল শনিবার বিকালে রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ১২ দলীয় জোটের সঙ্গে বিএনপির লিয়াঁজো কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি একথা বলেন।
ড. ইউনূসের পাল্লা ভারি তাই
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এমনতিইে বিএনপি দ্রুত নির্বাচন অর্থাৎ ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চাওয়া নিয়ে উচ্চবাচ্য কমিয়ে দেয়নি। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। রাজনৈতিক সূত্র থেকে জানা গেছে, ড. ইউনূসের সাথে বৈঠকে আগে দেশে যখন বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের আওয়াজে প্রকম্পিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে ঠিক তখনই এখানে দেখা গেছে ঢাকা সফর করছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রভাবশালী প্রতিনিধিদল। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে ঢাকা সফররত যুক্তরাষ্ট্রের উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোল এ চুলিক ও অ্যান্ড্রু হেরাপের নেতৃত্বে দেশটির ওই প্রতিনিধিদল। তারা প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন গত ১৭ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায়। সে-ই বৈঠকে সংস্কার কর্মসূচির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের কথা জানিয়ে দেন সফররত যুক্তরাষ্ট্রের উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোল এ চুলিক ও অ্যান্ড্রু হেরাপের নেতৃত্বে দেশটির ওই প্রতিনিধিদল। এর পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের দিকে ইঙ্গিত করে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা আঞ্চলিক সহযোগিতা, যোগাযোগ ও জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন, এবিষয়গুলি বিএনপি’র নীতিনির্ধারক পর্যায়ে বেশ প্রভাব ফেলেছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ঠিক ওই সময় থেকে বিএনপি ধীরে ধীরে সংস্কার বিরোধী বক্তব্য থেকে আস্তে আস্তে সুর নামিয়েই কথা বলে যাচ্ছে।
জামায়াতও দ্রুত নির্বাচনের পথে
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিএনপি দ্রুত নির্বাচন দাবি করে এখন একটু রেস্ট এ চলে আসার ব্যাপারে জামায়তের সর্বশেষ পদক্ষেপও কাজ করেছে। সম্প্রতি লন্ডনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ও নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের একটি বৈঠক হয়েছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে এই বৈঠকের পরপরই জামায়াত নেতারা নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে চাওয়া শুধু করেছে। দলটি বৈঠকের পরে এমন বক্তব্য দেয়ার পক্ষে সাফাই গেয়ে বক্তব্য দেন। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চাওয়ার যুক্তি তুলে ধরে দলের শীর্ষ নেতারা। এসব বক্তব্যে বলা হয় যে, আগামী নির্বাচনের জন্য ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করলে বর্ষা, বিভিন্ন ধরনের ঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। তাই আগামী রমজানের আগেই অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন চায় জামায়াতে ইসলামী। কারো কারো মতে, বিএনপি হাই কামান্ড মনে করেন দ্রুত নির্বাচনের দাবি ব্যাপারে এক্ষেত্রে মাঠে বিএনপি জামায়াতকে অবশেষে পেয়েই গেছে। তাই এখন অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে একটি কৌশলী হওয়াই বেশ সুবিধা।
ড. ইউনূসের ইমেজ এখন তুঙ্গে
কারো কারো মতে, বেশ কয়েকটি কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুসের ইমেজ তুঙ্গে। সম্প্রতি চীন সফরে গিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ‘সেভেন সিস্টার্স’ খ্যাত সাতটি রাজ্য নিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের করা মন্তব্যে ভারতজুড়ে যেমন তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে তেমনি বাংলাদেশে-ও এর ঢেউ এসে পড়ে। বাংলাদেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য সর্বস্তরের জনগণ বেশ ভালোভাবে একটি সাহসী বক্তব্য হিসাবে নিয়েছে। বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ স্পর্শকাতরও হয়ে উঠে। কেননা তবে এর বিপরীতে ড. ইউনূস ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে স্থলবেষ্টিত এবং বাংলাদেশকে এই অঞ্চলের সমুদ্র প্রবেশাধিকারের অভিভাবক হিসেবে উল্লেখ করলে-এমন বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। আর এরপরে মুখে অস্বীকার করলেও ভারত একধরনের বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে বাংলাদেশের সাথে। কারণ তারা ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে। ভারতের এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রায় পাঁচ বছর ধরে ভারতের ভূখন্ড ব্যবহার করে কলকাতা বা দিল্লির মতো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশি পণ্য পরিবহনের যে সুবিধা পাচ্ছিল বাংলাদেশ, তা বন্ধ হয়ে গেছে। সেই করিডোর এখন বন্ধ-এবং তার সঙ্গে বন্ধ কম খরচের গুরুত্বপূর্ণ একটি লজিস্টিক বিকল্পও। কারো কারো মতে, এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচনের দাবি বড়ো ধরনের মাঠ কর্মসূচি থাকলে এর সুযোগ কেউ কেউ নিয়ে নেবে। তাই কূটনীতি, রাজনৈতিক সামাজিক ও এর পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক দিক বিবেচনা করে বিএনপি কৌশলী হয়েছে। দ্রুত নির্বাচনের দাবি নিয়ে মাঠে হার্ড লাইনে যাওয়ার ব্যাপারে মতামত পাল্টে ফেলেছে। তবে আরেকটি সূত্র মনে করেন, বিএনপি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাবিতে সরকারকে সবসময় চাপেই রাখবে-এটাই যে কোনো রাজনৈতিক দলের বাস্তবতা। এটা না করা হলে দীর্ঘ রাজনৈতিক তৎপরতা না থাকার সুযোগ জনগণ বিশেষ করে বিএনপি সমর্থিত নেতাকর্মীদের মধ্যে স্থবিরতা কাজ করতে পারে। সে সুযোগেরও অপেক্ষায় আছে কেউ কেউ। এমন ধারণা থেকে বিএনপি মাঠে দ্রুত নির্বাচন দেয়ার আওয়াজ তুলেই যাচ্ছে, হয়তা আরও যাবেই।