১৩ মে ২০২৫, মঙ্গলবার, ০৮:৬:৫৯ পূর্বাহ্ন


দক্ষিণ এশিয়া যুদ্ধ আতঙ্ক
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-০৫-২০২৫
দক্ষিণ এশিয়া যুদ্ধ আতঙ্ক


আঞ্চলিক এবং গ্লোবাল ভূরাজনৈতিক কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় এখন যুদ্ধ আতঙ্ক। পারমাণবিক শক্তির অধিকারী দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্তান সীমান্তে এখন মুখোমুখি। যে কোনো সময় যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। ছোট-বড় যে পরিসরেই যুদ্ধ হোক তার উত্তাপ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে পাক-ভারত উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ভারত ইতিমধ্যে সিন্ধু নদীর পানিচুক্তি বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছে। পাকিস্তান ঘোষণা দিয়েছে ১৯৭২ সিমলা চুক্তি থেকে সরে আসার। দুই দেশে একের ওপরের আকাশসীমা ব্যবহার করে বিমান চলাচল স্থগিত ঘোষণা করেছে। 

বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন মায়ানমারে চলছে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। আরাকান প্রদেশের অধিকাংশ এলাকা এখন বিদ্রোহী বাহিনীর দখলে। পারস্পরিক বাণিজ্য সংকুচিত হয়েছে। বিদ্যমান অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে উন্নয়নশীল দুটি দেশের অর্থনীতি দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে সন্দেহ নেই। পরিস্থিতি নিয়ে নানা ষড়যন্ত্রের থিওরি আছে। বাংলাদেশের এক প্রাক্তন সেনা নায়ক আহ্বান জানিয়েছে পাক-ভারত যুদ্ধ বাঁধলে বাংলাদেশ যেন চীনকে সাথি করে ভারতের সাতটি পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য দখল করে নেয়। ভারত আঞ্চলিক পরাশক্তি। বাংলাদেশের সাবেক সেনা নায়কের দায়িত্বহীন অতিশয় উক্তি শুনে মনে হয় বিষয়টি যেন ছেলের হাতের মোয়া। যাহোক সরকার ওই ব্যক্তির উক্তি ব্যক্তিগত বলে বাতিল করেছে। জুলাই-আগস্ট পটপরিবর্তনের পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক শীতল হয়ে আছে। ভারত-পাকিস্তানের বর্তমান সংঘাতময় পরিবেশে বাংলাদেশের উচিত কথায় কাজে সংযুক্ত থাকা। বাংলাদেশ ২.৭৫ দিক ভারতবেষ্টিত বাকি ০.২৫ সীমান্ত মায়ানমারের সঙ্গে। সেখানেও স্বস্তি নেই। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী বিষফোড়া হয়ে আছে। আরো কয়েক লাখ শরণার্থী যে কোনো সময় ঢুকে পড়তে পারে। 

ভারতের শঙ্কা চিকেন নেক নিয়ে। বাংলাদেশের সঙ্গে বৈরী সম্পর্কের কারণে পূর্ব-পশ্চিম ট্রানজিট পুরো মাত্রায় চালু না থাকায় পূর্বের সাত প্রদেশের সঙ্গে একমাত্র সংযোগ চিকেন নেকের মাধ্যমে। অদূরে আছে শক্তিধর চীন। ভারতের ভয় চীনকে নিয়ে। 

১৯৭১ বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে ভারতের সক্রিয় সহযোগিতা, সর্বাত্মক সমর্থন স্বীকার করেই বলছি ৫৪ বছরে দুই নিকট প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক নানা কারণে সৎ প্রতিবেশী মনোভাবের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি, দায় আছে উভয় দেশের। কার বেশি, কার কম-সেই বিতর্কে যাবো না। তবে বলা যায়, পানি বণ্টনে অনীহা, বাণিজ্যে ভারসাম্য সৃষ্টিতে অসহযোগিতা অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে দাদাগিরির অভিযোগ একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বাংলাদেশ কিন্তু এর মধ্যেও ভারত, চীন, কোরিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়াসহ অধিকাংশ আগ্রহী দেশকে বাংলাদেশের উন্নয়নে সম্পৃক্ত রেখে অর্থনীতিকে প্রসারিত রেখেছিল। কিন্তু জুলাই-আগস্ট ২০২৪ থেকে ভারত বাংলাদেশের বৈরী সম্পর্কের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন পাহাড়ি এলাকায় বাংলাদেশ-ভারত-মায়ানমার সীমান্ত এলাকা এখন অশান্ত। স্বাধীনতা পূর্বকাল থেকেই অভিযোগ ছিল ভারত সন্ত্রাসীদের লালন করে এলাকাটি অশান্ত করে রাখে। একসময় শান্তি বাহিনীর সঙ্গে শান্তিচুক্তি হয়েছিল। এখন কিন্তু আবার এলাকাটি অশান্ত। একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী এখানে যুদ্ধ করার হুমকি দিচ্ছে। অন্যদিকে টেকনাফ এলাকার নাফ নদের ওপারে আরাকান রাজ্যের বিষয়ে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গা শিবির ঘুরে যাওয়ার পর আরাকানে মানবিক সাহায্য প্রেরণের জন্য বাংলাদেশ করিডোর প্রদান করবে- এই মর্মে প্রকাশিত সংবাদ চাউর হয়েছে। মায়ানমারের জ্বালানি সমৃদ্ধ এলাকায় চীন, ভারত ও রাশিয়ার স্বার্থ জড়িত আছে। যুক্তরাষ্ট্র চায় বে অব বেঙ্গল এলাকায় চীনের একাধিপত্যে ভাগ বসাতে। অনেকে আবার এই এলাকায় মায়ানমার বাংলাদেশ এবং ভারতের একটি অংশ নিয়ে খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথাও বলছে। বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দল আরাকানে একটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের দাবি তুলেছে। যা কিছু ঘটুক মায়ানমার এখনো একটি সেনাশাসিত স্বাধীন দেশ। আরাকান এলাকায় একটি বিদ্রোহী বাহিনী বিশাল এলাকা দখল করে নিলেও বৈধ সরকার নেই। এমতাবস্তায় বাংলাদেশ করিডোর দিতে চাইলে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে। বিষয়টি মায়ানমারসহ চীন, ভারত, রাশিয়া, ইসলামিক দেশগুলো কীভাবে নেবে সেটিও দেখার বিষয়। 

অন্তর্বর্তী সরকার অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করার মূল ম্যান্ডেট নিয়ে সীমিত সময়ের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন আছে। দেশ নানান অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত। একটি অনির্বাচিত অস্থায়ী সরকার আঞ্চলিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি নিতে পারে না। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের উচিত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অবিলম্বে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে জনপ্রতিনিধিত্বশীল দায়িত্বপূর্ণ সরকার।

শেয়ার করুন