মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে (হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস) গত ২২ মে ডোনাল্ড ট্রাম্প-সমর্থিত একটি বিতর্কিত বাজেট বিল এক ভোটের ব্যবধানে পাস হয়েছে। ২১৫-২১৪ ভোটে পাস হওয়া এই আইনটি ধনীদের জন্য বিপুল কর ছাড় এবং গরিব, শিশু ও প্রবীণদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্য সহায়তা কাটছাঁটের ব্যবস্থা করেছে। এইচআর-১, যা বিগ বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট নামক বিলটিকে অনেক ডেমোক্র্যাট ও বিশ্লেষক যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম ‘ভয়ংকর’ বাজেট আইন বলে অভিহিত করেছেন। বিল অনুযায়ী, ১৫ মিলিয়ন মানুষ তাদের মেডিকেইড স্বাস্থ্যসেবা হারাবেন এবং ২ মিলিয়নের বেশি শিশুখাদ্য সহায়তা থেকে বঞ্চিত হবেন। শুধু চাইল্ড ট্যাক্স ক্রেডিটও বাড়ানো হয়েছে, প্রতি সন্তানের জন্য ২ হাজার ডলার থেকে ২ হাজার ৫০০ ডলার। দুইজন রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান এই বিলে বিরোধিতা করেন এবং এক রিপাবলিকান সদস্য ‘প্রেজেন্ট’ ভোট দেন। এখন এটি সিনেটে বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়েছে।
কংগ্রেসের নিম্নকক্ষের স্পিকার মাইক জনসন ভোটের পর এক বিবৃতিতে এই বিলে ‘প্রজন্মগত, জাতি গঠনের আইন’ হিসেবে উল্লেখ করেন, যা ব্যয় কমায়, পরিবার এবং চাকরি সৃষ্টিকারীদের জন্য কর স্থায়ীভাবে কমাবে, সীমান্ত সুরক্ষা নিশ্চিত করে, আমেরিকান শক্তির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে এবং শক্তির মাধ্যমে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে বলে তিনি বলেন। তিনি আরো বলেন, আমরা সিনেটের সময়মতো এই একবারের জন্য প্রজন্মগত আইনের বিবেচনার জন্য অপেক্ষা করছি এবং একসঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে প্রস্তুত আছি যাতে ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’ প্রেসিডেন্টের টেবিলে পৌঁছাতে পারি।
এই বিলে মেডিকেইড অন্তত ৬০০ বিলিয়ন কাটা হয়েছে। এটি প্রোগ্রামের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কাটা। মেডিকেইড ৭০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জন্য একটি জীবনরক্ষাকারী প্রোগ্রাম, যার মধ্যে ১৫ মিলিয়নেরও বেশি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছেন। এই বিলে অনুমান করা হচ্ছে যে ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন মানুষ তাদের স্বাস্থ্যবীমা কভারেজ হারাতে পারে। মেডিকেইড মানসিক স্বাস্থ্য সেবা, অপিওইডস ব্যবহার ব্যাধির চিকিৎসা এবং প্রতিবন্ধী ও বৃদ্ধ প্রতিবেশীদের তাদের বাড়িতে এবং সম্প্রদায়ে বসবাস ও কাজ করার জন্য যত্নকর্মীদের সেবা প্রদান করে। বিলটি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক স্বাধীনতাকেও আক্রমণ করবে। যেমন- এটি অভিবাসন আটক এবং বহিষ্করণ ব্যবস্থার জন্য তহবিল বৃদ্ধি করবে , যা আইনি প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত এবং মানবাধিকার বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করছে। এটি প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার সীমিত করে, যেমন মেডিকেড রোগীদের প্ল্যানড প্যারেন্টহুড স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবা নেওয়া থেকে বাধা দেয় এবং বেসরকারি স্বাস্থ্যবীমা বাজারে গর্ভপাত সেবার কভারেজে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে প্রজনন স্বাধীনতা ক্ষত্নু করবে।
এই বিলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারার মধ্যে রয়েছে :
এই বিলটি প্রায় ১ হাজার পৃষ্ঠার দীর্ঘ এবং মূলত ২০১৭ সালের ট্যাক্স কাটস অ্যান্ড জবস অ্যাক্টের অধীন প্রস্তাবিত কর হ্রাসগুলোকে স্থায়ী করার লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি এটি স্বাস্থ্যসেবা, অভিবাসন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে। কর-সংক্রান্ত দিক থেকে বিলটি বেশ কিছু বড় পরিবর্তন এনেছে। স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন বাড়ানো হয়েছে। এক ব্যক্তিদের জন্য ১৫ হাজার থেকে ১৬ হাজার ডলার এবং বিবাহিত দম্পতিদের জন্য ৩০ হাজার থেকে ৩২ হাজার ডলার। চাইল্ড ট্যাক্স ক্রেডিটও বাড়ানো হয়েছে, প্রতি সন্তানের জন্য ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ ডলার। টিপস ও ওভারটাইম আয়ের ওপর করারোপ বন্ধ করা হয়েছে এবং বয়স্ক নাগরিকদের সোশ্যাল সিকিউরিটি সুবিধায় কর হ্রাস দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ২ মিলিয়ন পারিবারিক খামারকে ‘ডেথ ট্যাক্স’-এর আওতার বাইরে রাখা হয়েছে এবং কৃষকদের জন্য ১০ বিলিয়ন ডলারের করছাড়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্টেট অ্যান্ড লোকাল ট্যাক্স ডিডাকশন ক্যাপ ১০ হাজার থেকে বাড়িয়ে প্রায় ৪০ হাজার ডলার করা হয়েছে, তবে শুধু যাদের বার্ষিক আয় ৫ লাখ ডলারের নিচে। নবজাতকদের জন্য সঞ্চয় অ্যাকাউন্ট চালু করা হয়েছে এবং দত্তক গ্রহণ সংক্রান্ত ট্যাক্স ক্রেডিট আংশিকভাবে ফেরতযোগ্য করে ৫ হাজার ডলার পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, এই বিলটি বিদ্যমান ট্যাক্স কাটস অ্যান্ড জবস অ্যাক্ট করের অধীনে ছাড়গুলোকে উন্নত করবে এবং ট্যাক্স কাটস অ্যান্ড জবস অ্যাক্টের মেয়াদ শেষ হলে যেসব পরিবারে ট্যাক্সের বোঝা ৭ হাজার ৮০০ থেকে ১৩ হাজার ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারতো, তা এড়ানো সম্ভব হবে। বছরে ৩০ হাজার থেকে ৮০ হাজার ডলার উপার্জনকারীরা গড়ে প্রায় ১৫ ভাগ করছাড় পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্যসেবা ও অভিবাসন নীতিতেও বিলটি বড় পরিবর্তন এনেছে। মেডিকেড সুবিধাভোগীদের জন্য কাজের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। বর্তমানে কয়েকটি স্টেটে এই সুবিধা সীমিত করতে পারে। অভিবাসন খাতে ১৫০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অন্তত এক মিলিয়ন অবৈধ অভিবাসীকে দেশে ফেরত পাঠানো, হাজার হাজার মাইল সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণ, ১৮ হাজার নতুন অভিবাসন কর্মকর্তা নিয়োগ এবং ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফেসমেন্ট এজেন্ট ও বর্ডার প্যাট্রোল এজেন্টদের বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। এই বিলিটিতে অন্তত ১.৪ মিলিয়ন অবৈধ অভিবাসীর জন্য মেডিকেড সুবিধাও বন্ধ করা হয়েছে।
বিলে আরো উল্লেখযোগ্যভাবে, মেডিকেড, চিলড্রেনস হেলথ ইন্স্যুরেন্স প্রোগ্রাম (সিএইচআইপি) ও অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট (এসিএ)-এর অধীনে ট্রান্সজেন্ডার মেডিক্যাল ট্রিটমেন্টের জন্য ফেডারেল ফান্ডিং বন্ধ করা হয়েছে। শুরুতে এই বিধিনিষেধ কেবল ১৮ বছরের নিচের ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য ছিল, তবে পরবর্তী সময়ে এটি প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়েছে। এছাড়া প্লানড পারেন্টহুডের মতো গর্ভপাত প্রদানকারী সংস্থাগুলোর জন্যও ফেডারেল ফান্ডিং ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণে একটি ১০ বছরের মোরেটোরিয়াম প্রস্তাব করা হয়েছে, যা রাষ্ট্র পর্যায়ে প্রয়োগ করা হবে। এ বিলটি এখন সিনেটে পাঠানো হয়েছে এবং সেখানে এটি পর্যালোচনা ও সম্ভাব্য সংশোধনের মুখোমুখি হবে। বিলটি পাস করতে সিনেটে অন্তত ৫১টি ভোট প্রয়োজন, যেহেতু এটি বাজেট পুনর্মিলন প্রক্রিয়ার আওতায় আনা হয়েছে, যেখানে ৬০ ভোটের পরিবর্তে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যথেষ্ট।
স্ন্যাপ-এ বাজেট কর্তন
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনে গৃহীত কংগ্রেসের সদ্য পাস হওয়া বিতর্কিত বাজেট বিল (এইচআর-১)যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি স্ন্যাপের জন্য সবচেয়ে বড় বাজেট ছাঁটাইয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। এই বিলটি আগামী ১০ বছরে প্রায় ২৩০ বিলিয়ন ডলার বাজেট কমানোর পরিকল্পনা করেছে। এটি স্ন্যাপের মোট সম্ভাব্য ব্যয়ের ২০ শতাংশেরও বেশি। এটি কার্যকর হলে এটি হবে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে স্ন্যাপের ওপর সবচেয়ে বড় আর্থিক আঘাত।
এই বাজেট ছাঁটাইয়ের ফলে স্ন্যাপের উপকারভোগীদের একটি বড় অংশ খাদ্য সহায়তা হারানোর ঝুঁকিতে পড়বেন। বিশ্লেষকদের মতে, নতুন কঠোর শর্ত ও যোগ্যতা পরিবর্তনের কারণে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ এই কর্মসূচি থেকে বাদ পড়তে পারেন। এদের মধ্যে প্রায় ৪ মিলিয়নের বেশি শিশু রয়েছে, যারা স্কুল ও পরিবারের মাধ্যমে স্ন্যাপের আওতায় খাদ্য সহায়তা পেয়ে থাকে।
বিলটির আওতায় স্টেট সরকারগুলোর ওপরও অতিরিক্ত চাপ আরোপ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী, স্ন্যাপ সুবিধার ৫ শতাংশ খরচ এবং প্রশাসনিক ব্যয়ের ৭৫ শতাংশ স্টেট সরকারকে বহন করতে হবে। যদি কোনো রাজ্যে ভুল বা ত্রুটির হার ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, তাহলে তাদের ওপর ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত আর্থিক জরিমানা আরোপ করা হবে। এর ফলে স্টেট সরকারগুলো আর্থিক সংকটে পড়তে পারে এবং অনেক রাজ্য এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে হিমশিম খাবে।
এই বাজেট ছাঁটাই কেবল সামাজিক দিক থেকেই নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও বিপর্যয়কর হতে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন। তারা জানান, স্ন্যাপ বাজেট কাটার ফলে প্রায় ১০ লাখ চাকরি হুমকির মুখে পড়বে এবং মোট দেশীয় উৎপাদনে (জিডিপি) ১১৩ বিলিয়ন ডলারের মতো ক্ষতি হতে পারে। কৃষি, পরিবহন ও খুচরা পণ্যের বাজার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কারণ এই খাতগুলো স্ন্যাপ উপকারভোগীদের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে।
সেন্টার অন বাজেট অ্যান্ড পলিসি প্রায়োরিটিজ এই বিলের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। তাদের মতে, এই বিলটি কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের হার নাটকীয়ভাবে বাড়বে। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবার ও শিশুদের পুষ্টি নিরাপত্তা চরম ঝুঁকিতে পড়বে। স্ন্যাপের মাধ্যমে পরিবারগুলো যেভাবে বিনামূল্যে স্কুল খাবারের যোগ্যতা অর্জন করে, তা বিলুপ্ত হয়ে গেলে লক্ষ লক্ষ শিশু মধ্যাহ্নভোজ এবং প্রাতঃরাশ থেকে বঞ্চিত হবে।
ওয়াশিংটনের কংগ্রেস সদস্য প্রমিলা জয়াপাল এই বিলকে ‘ধনীদের জন্য উপহার এবং গরিবদের জন্য শাস্তি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, এই বাজেট সরাসরি কর্মজীবী ও দরিদ্র আমেরিকানদের খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা এবং ভবিষ্যতের ওপর আঘাত হানে, যাতে ধনীরা কর ছাড় পায় এবং আরো ধনী হয়ে উঠতে পারে।
এই বিল এখন সিনেটের বিবেচনার অপেক্ষায় রয়েছে। যদি এটি আইনে পরিণত হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়বে বলে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন। মার্কিন সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়ন (এসিএলইউ)-এর প্রধান রাজনৈতিক ও প্রচারণা কর্মকর্তা ডেইড্রে শিফেলিং এই বিলে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, আমি স্পষ্টভাবে বলি, প্রতিনিধি পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা একটি এমন বিলে ভোট দিয়েছে যা লাখ লাখ মানুষের, যার মধ্যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও রয়েছে, স্বাস্থ্যসেবা কেড়ে নেয় এবং প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার বন্ধ করে। তিনি আরো বলেন, এই বিলে মেডিকেডকে অসুস্থ মানুষ এবং নিম্নআয়ের পরিবার থেকে সরিয়ে নিয়ে বিলিয়নিয়ারদের জন্য কর কাটা এবং অভিবাসীদের বহিষ্কারের জন্য তহবিল প্রদান করা হচ্ছে।