বর্ণাঢ্য আয়োজন আর উৎসবমুখর পরিবেশে ‘যত বই তত প্রাণ’ স্লোগানে শেষ হলো চার দিনব্যাপী ‘নিউইয়র্ক আন্তর্জাতিক বাংলা বইমেলা ২০২৫’। ৩৪তম আন্তর্জাতিক বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় জামাইকা পারফর্মিং আর্টস সেন্টারে। বইমেলার আয়োজক মুক্তধারা ফাউন্ডেশন। শুক্রবার ২৩ মে অতিথিদের সঙ্গে নিয়ে ফিতা কেটে মেলার উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় কবি ও ঔপন্যাসিক সাদাত হোসাইন। বইমেলার উদ্বোধক উপন্যাসিক সাদাত হোসাইন বলেছেন, আমার জন্ম বাংলাদেশের মাদারীপুরে। মাদারীপুর থেকে ঢাকায় আসি। স্বপ্ন ছিল পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হবে। পত্রিকায় লেখাও ছাপা হলো। বাংলা ভাষার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। বাংলা ভাষায় লেখি বলেই আজকে আমি মাদারীপুর থেকে আমেরিকায়। এই বইমেলার পাশে আপনারা থাকবেন। তিনি আরো বলেন, এসব আয়োজনের মাধ্যমেই বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতি সারা বিশ্বে বেঁচে থাকবে এবং ছড়িয়ে পড়বে। চার দিনব্যাপী বইমেলায় বিপুলসংখ্যক সাহিত্য বা বইপ্রেমী এসেছিলেন। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন এবং আড্ডায় সময় কাটিয়েছেন। এবারের বইমেলা নিয়ে সাধারণ প্রবাসীদের মধ্যে সংশয় ছিল। রাজনীতির রেখা টেনে ড. নূরুন নবীর নেতৃত্বে একটি অংশ রাজনৈতিক বইমেলার আয়োজন করে। রাজনীতির সঙ্গে বইমেলার সম্পর্ক কী? সব জায়গায় কেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে টেনে আনতে হবে। সামান্য একটা বইমেলাও তা-ও তার নামে করতে হবে? বিভক্তি সৃষ্টি করতে হবে? জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান থেকেও তারা কোনো শিক্ষা নেয়নি। সেই যাই হোক, রাজনীতির স্লোগানে বইমেলাকে এবার বিভক্ত করা গেলেও মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের বইমেলার সাফল্যকে মলিন করতে পারেনি। চারদিনে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ প্রমাণ করেছেন মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের আয়োজনের সঙ্গেই মানুষ রয়েছেন। মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের বইমেলাই মূল বইমেলা। বাঙালির ঐতিহ্যের বইমেলার অংশ হচ্ছে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের বইমেলা। মাঝেমধ্যে বৃষ্টির হামলা এবং ঠান্ডার মধ্যেও মুক্তধারার বইমেলা ছিল বাঙালির গর্বিত বইমেলা। ধন্যবাদ পেতে পারেন বইমেলার আহ্বায়ক সাংবাদিক রোকেয়া হায়দার, মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ, বিশ্বজিৎ সাহাসহ সংশ্লিষ্ট সবাই।
এবারের বইমেলার প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন আমেরিকান বন্ধু ফিলিস টেইলর এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব সিপিডির চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহান, ক্যাপ্টেন (অব.) সিতারা বেগম (বীরপ্রতীক), কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক এবং অধ্যাপক রওনক জাহান, ড. শামীম রেজা, বিরূপক্ষ পাল, আবু সাঈদ খান, মনিরুল হক, হুমায়ুন কবীর ঢালি, আলমগীর শিকদার লোটন, রেদওয়ানুর রহমান জুয়েল, জসিম উদ্দিন, সজল আহমেদ, দীপঙ্কর দাস, মাহবুবুল হাসান ফয়সাল, মুস্তাফিজ সফিক, ফারুক আহমেদ, জসিম মল্লিক, অভীক সারওয়ার রহমান, নজরুল মিন্টো, আবদুল্লাহ জাহিদ জাফর আহমেদ রাশেদ, মঈনউদ্দিন মুনশী, কবি জীবন চৌধুরী, আশিক মুস্তফা, পারমিতা হিম, নাজনীন আহমেদ, ফেরদৌস সাজেদীন, সউদ চৌধুরী, গোলাম ফারুক ভুইয়া, ফাতেমা আহমেদ প্রমুখ।
উদ্বোধনী পর্বে অতিথি ছাড়াও অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- বইমেলার আহ্বায়ক সাংবাদিক রোকেয়া হায়দার, ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দীন আহমেদ এবং মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের সিইও বিশ্বজিৎ সাহা। এ সময় ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা গোলাম ফারুক ভূঁইয়া, সউদ চৌধুরী ও ওবায়দুল্লাহ মামুনসহ দেশ-বিদেশের কবি-লেখক-প্রকাশকসহ বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধনের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যাঞ্জলি এবং সংগীত পরিবেশন করেন শাহীন হোসেন।
বৃষ্টিস্নাত শুক্রবার বিকালে মনোজ্ঞ সংগীত আর নৃত্য দিয়ে বইমেলার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। প্রবাসে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের দলীয় নৃত্য উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। এরপর মূল মঞ্চের বাইরে বইমেলার উদ্বোধনের পর জামাইকা পারফর্মিং আর্টস সেন্টার মিলনায়তনে ৩৪টি মোমবাতি জ্বালিয়ে মেলার আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়। আমন্ত্রিত অতিথি, কবি-লেখক, প্রকাশক ও কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিরা মোমবাতি প্রজ্বালন করেন। এ সময় অতিথিদের উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া হয়। এই পর্বে সভাপতিত্ব করেন বইমেলার আহ্বায়ক রোকেয়া হায়দার। জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া এই পর্বে অতিথিরাসহ কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তি বক্তব্য রাখেন। পরে প্রবাসের জনপ্রিয় শিল্পীরা সংগীত ও নৃত্য পরিবেশন করেন।
উদ্বোধনী বক্তব্যে সাদাত হোসাইন তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, নিউইয়র্ক বইমেলা দেশের বাইরে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা অব্যাহত রাখবে। আমি আশা করবো, প্রবাসীরা এই অগ্রযাত্রার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে আগামী দিনে বইমেলাকে আরো সমৃদ্ধ করবেন। তিনি বাংলা ভাষার প্রতি যারা নিবেদিত প্রাণ রয়েছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বইমেলার উদ্বোধন করেন। উল্লেখ্য, বিগত ৩৪ বছর ধরে আয়োজিত প্রতিটি বইমেলার উদ্বোধক ছিলেন একজন লেখক এবং এবারের মেলার উদ্বোধক সাদাত হোসাইনকে ঘিরে মেলায় আগতদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল লক্ষণীয়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের আকর্ষণ ছিলেন সাদাত হোসাইন।
নিউইয়র্ক বইমেলাকে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রাণের মেলা হিসেবে আখ্যায়িত করে বিশ্বজিত সাহা মেলা আগম সব দর্শক-শ্রোতাসহ সব অংশগ্রহণকারীকে ধন্যবাদ জানান।
জামাল উদ্দিন হলে চেয়ারপারসন ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদের সঞ্চালনায় শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন- প্রধান অতিথি ফিলিস টেইলর, বিশেষ অতিথি অধ্যাপক রেহমান সোবহান, প্রফেসর গায়েত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, অধ্যাপক রওনক জাহান, ক্যাপ্টেন (অব.) সেতারা বেগম, প্রকাশত মনিরুল হক ও উদ্বোধন সাদাত হোসাইন। কবি জসীম উদ্দীনের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ছিল মুক্তধারার শ্রদ্ধার্ঘ। অংশগ্রহণে ছিলেন দেবারতী চৌধুরী ও শ্রুতি দাস। উদ্বোধনী দিনে আরো ছিল আলোকচিত্র প্রদর্শনী।
দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানমালার মধ্যে ছিল নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আলোচনায় মেলার উদ্বোধক এই সময়ের জনপ্রিয় তরুণ লেখক সাদাত হোসাইনসহ আমন্ত্রিত অতিথি ও প্রবাসের লেখকগণ আলোচনায় অংশ নেন। অংশগ্রহণে ছিলেন- শেলি জামান খান, জেবুন্নেছা, সুমন শামসুদ্দীন, পলি শাহীনা, ফারুক আহমেদ, সজল আহমেদ, মুস্তাফিজ শফি, জাফর আহমেদ, আশিক মুস্তফা, হুমায়ুন কবীর ঢালি, ড. শামীম আরা, দিমা নিফারতিতি, সোনিয়া কাদের, শাহীন ইবনে দিলওয়ার ও আব্দুল কাইয়ুম। লেখকের চোখে লেখকের বই নিয়ে আলোচনায় ছিলেন সাদাত হোসাইন, শামসুন ফৌজিয়া, মনিজা রহমান, প্রণব কান্তি চৌধুরী, জসিম মল্লিক, নন্দিনী মুস্তাফী, আব্দুল কাইয়ুম, এইচ বি রিতা, অনুপমা বড়ুয়া, পারমিতা হিম। দেশে ও প্রবাসে তথ্যমাধ্যম কেন গুরুত্বপূর্ণ অধ্যাপক শামীম রেজার সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মনজুর আহমেদ, আবু সাঈদ খান, ইব্রাহিম চৌধুরী, মুস্তাফিক শফি। বই এবং মুক্তযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা শেষে ছিল ফাহমিদা নবীর সংগীত পরিবেশন।
তৃতীয় দিনে বইমেলার শুরু শিশু-কিশোরদের অনুষ্ঠান দিয়ে। ছিল লেখকদের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন। স্বরচিত কবিতা পাঠ। অংশগ্রহণে ছিলেন- আশিক মুস্তফা, সাংবাদিক ফারুক আহমেদ, সৈয়দ মামুনুর রশীদ, খিজির হায়াত, বিমল সরকার, বেনজির শিকদার, ফারুক আজম, মহিবুর রহমান, রানু ফেরদৌস, মাসুম আহমেদ, আহমেদ ছহুর, মিয়া মোহাম্মদ, স্বপ্ন কুমার, মামুন জামিল, দেওয়ান নাসের রাজা। জসিম মল্লিকের পরিচালনয় নতুন নিয়ে আলোচনায় ছিলেন- সাদাত হোসাইন, শরীফুল আলম, দর্পণ কবীর, শামসুদ্দীন মাহমুদ, নাসরীন জাহান চাদনী, আকবর হায়দার কিরণ, লিপি আলম, জহান্নাতুল ফেওদৌস, মৈত্রেয়ী দেবী, বিমল সরকার ও বেনজির শিকদার। ফারুক আজমের পরিচালায় কবিতা আবৃত্তিতে অংশ নেন জেবুন্নেছা, বাহাউদ্দিন পিয়াল, সুমন শামসুদ্দিন, শারমির রেজা ইভা, খালিদ মিঠু। ছড়ার আসর পরিচালনা করেন হুমায়ুন কবীর ঢালি। অংশগ্রহণে ছিলেন আশিক মুস্তফা, শামস চৌধুরী রুশো। প্রবাসে সাহিত্যচর্চা নিয়ে আলোচনায় ছিলেন- আবেদীন কাদের, ড. শামীম আরা, ইব্রাহিম চৌধুরী। নতুন প্রজন্ম নিয়ে ছিল চতুর্থ দিন। চার দিনব্যাপী বইমেলার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় আগামীর প্রত্যাশায়।