০৩ অক্টোবর ২০২৫, শুক্রবার, ০২:৪৯:০০ পূর্বাহ্ন


নিউইয়র্ক সিটি মেয়র নির্বাচন
মুসলিম প্রার্থী মামদানির ঐতিহাসিক জয়
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৫-০৬-২০২৫
মুসলিম প্রার্থী মামদানির ঐতিহাসিক জয় জোহরান মামদানি


নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনের ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারিতে জয়ী হয়ে ইতিহাস গড়লেন কুইন্সের মুসলিম এসেম্বলীম্যান জোহরান মামদানি। গত ২৪ জুন মঙ্গলবারের নির্বাচনে তিনি সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে চমক সৃষ্টি করে হারিয়ে দেন। জন্ম দেন নয়া ইতিহাসের, যার ফলে কুমো রাতেই পরাজয় স্বীকার করে জোহরান মামদানিকে অভিনন্দন জানান। তবে নির্বাচর কমিশনের পক্ষ থেকে এখনো চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হয়নি। জোহরান মামদানি যেহেতু এখনো ৫০% এর উপরে ভোট পাননি, সেহেতু র‌্যাকিং চয়েসের জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হবে। এটা শুধু আনুষ্ঠানিকতা। কারণ জোহরান মামদানি যে ইতিহাস রচনা করেছেন- তা নিউইয়র্কের রাজনীতির ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ঘটনা। যেখানে নিউইয়র্কের কোন এলাকা থেকে মুসলিম কাউন্সিলম্যান নির্বাচন করা যায় না, সেখানে মুসলিম মেয়র! ভাবতেই অবাক লাগে। এই জয় কারো কাছে বিস্ময়, কারো কাছে উচ্ছ্বাস, কারো কাছে স্বপ্ন, কারো কাছে দু:স্বপ্ন। তবে স্বপ্নের স্বপ্নিল ডানা উড়িয়েছেন মুসলিম ইমিগ্র্যান্ট জোহরান মামদানি। বাবা- মা দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারতের। জোহরান মামদানির জন্ম উগান্ডায়। ছোট বয়সে চলে আসেন আমেরিকায়। কে জানতো মুসলিম ইমিগ্র্যান্ট জোহরান মামদানির বক্তব্যে আশ্বস্ত হবেন নিউইয়র্ক সিটির বাসিন্দারা। যার কারণে মনে খুলে ভোট দিয়েছেন তাকে। বিশেষ করে তরুণ সমাজ। এটাই ছিলো তার জয়ের মূল শক্তি। ৩৩ বছর বয়সী একজন প্রার্থীর জন্য কাজ করেছেন প্রায় ৫০ হাজার ভলেন্টিয়ার। তাদের কারণেই সব সম্ভব হয়েছে। তা নাহলে যেভাবে জোহরান মামদানিকে কথিত সন্ত্রাসী বানানোর ষড়যন্ত্র করা হয়েছিলো, সেই ষড়যন্ত্র চিহ্ন করা সম্ভব ছিলো না।

জোহরান মামদানির সাথে আরো জয়ী হয়েছেন ডিস্ট্রিক্ট -৩৯ থেকে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মুসলিম কাউন্সিল ওম্যান শাহানা হানিফ, জ্যাকসন হাইটসের কাউন্সিলম্যান শেখর কৃষ্ণান, পাবলিক এডভোকেট পদে জুমানি উইলয়াম এবং সিটি কম্পট্রোলার পদে মার্ক ক্যাভিন।

নিউইয়র্ক সিটি বোর্ড অফ ইলেকশনের দেওয়া প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যায়, (রাত ১২ টা পর্যন্ত) ৯৩% ব্যালট গণনা শেষে জোহরান মামদানি প্রায় ৪৪%-৩৬% ব্যবধানে কুমোর চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। যদিও এ গণনায় কেবলমাত্র ভোটারদের প্রথম পছন্দ বিবেচনা করা হয়েছে এবং চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য র‍্যাংকড-চয়েস ভোটিংয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পছন্দের গণনা আগামী সপ্তাহে শুরু হবে। এদিন নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক ভোট পড়েছে। ২০২৫ সালের নিউইয়র্ক সিটি মেয়র নির্বাচনের ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে ভোটারদের অংশগ্রহণ রেকর্ড গড়েছে। এবারের নির্বাচনে মোট প্রায় ৯,৪২,০৩১টি ব্যালট গণনা করা হয়েছে, যা সাম্প্রতিক ইতিহাসে অন্যতম সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আগাম ভোটে অংশ নেন প্রায় ৩,৮৪,২৫১ জন, যা ২০২১ সালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। এছাড়া মেইল-ইন ব্যালটের মাধ্যমে জমা পড়ে ৪৫,৫৯৭টি বৈধ ভোট।

নির্বাচন দিবসে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের মধ্যেও সরাসরি ভোট দিয়েছেন আনুমানিক ৫,৪৬,০০০ থেকে ৬,০৫,০০০ জন ভোটার। এই বিপুলসংখ্যক ভোটার অংশগ্রহণ নিউইয়র্ক সিটির রাজনৈতিক সচেতনতা এবং নতুন নেতৃত্বের প্রতি আগ্রহের স্পষ্ট প্রতিফলন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এত উচ্চ টার্নআউট সাম্প্রতিক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী একটি নগর নির্বাচনকে চিহ্নিত করছে।

তবে ২৪ জুন মঙ্গলবার রাতেই কুমো তার ম্যানহাটনের নির্বাচনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বলেন, তিনি (মামদানি) জিতেছেন, আমি তাকে অভিনন্দন জানিয়েছি। তিনি তার প্রাপ্য সম্মান অর্জন করেছেন। কুমোর পাশে ছিলেন তার কন্যারা, যাদের অনেককে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়। সমর্থকরা ছিলো হতাশ। অন্যদিকে, মামদানির নির্বাচনী শিবিরেও ছিল বিজয়ের উচ্ছ্বাস। লং আইল্যান্ড সিটির ‘গ্রেটস অফ ক্রাফট’ ব্রুয়ারিতে জড়ো হওয়া সমর্থকদের মাঝে মামদানির যোগাযোগ পরিচালক অ্যান্ড্রু এপস্টাইন বলেন, আমাদের বার্তা স্পষ্ট, আমাদের দল দৃঢ়, এবং আমরা রাতের বাকি অংশ নিয়ে আশাবাদী।

র‍্যাংকড-চয়েস রাউন্ডে মামদানি আরো এগিয়ে যেতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, কারণ তিনি নিউইয়র্ক সিটির কম্পট্রোলার ব্র‍্যাড ল্যান্ডারসহ একাধিক প্রগতিশীল প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছেন। ল্যান্ডার প্রাথমিকভাবে তৃতীয় স্থানে রয়েছেন, প্রায় ১১% ভোট পেয়ে। নিজের নির্বাচনী অনুষ্ঠানে ল্যান্ডার বলেন, আমরা জোহরানকে বিজয়ী করার পথে রয়েছি। ৩৩ বছর বয়সি মামদানি কুইন্স থেকে নির্বাচিত একজন অ্যাসেম্বলীম্যান এবং তার প্রচারণা ছিল শহরের বসবাসযোগ্যতা নিশ্চিত করা নিয়ে। তার নির্বাচনী অঙ্গীকারের মধ্যে আছে ধনীদের ওপর কর বৃদ্ধির মাধ্যমে রাজস্ব বাড়ানো, ভাড়াটিয়াদের জন্য ভাড়া স্থির রাখা, সাবসিডিযুক্ত চাইল্ড কেয়ার সম্প্রসারণ এবং গণপরিবহনে বিনামূল্যে বাস চালুর পরিকল্পনা। মামদানিকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন কংগ্রেসওম্যান আলেক্সজান্ডিয়া ওয়াসিও কর্টেজ। তিনি জোহরান মামদানিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং তার দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

নির্বাচনের শেষ দিকে কুমো মামদানির অল্প বয়স এবং অভিজ্ঞতার অভাব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, এমনকি তাকে মুসলিম পরিচয়ের কারণে ইহুদি বিদ্বেষী বলেও অভিযুক্ত করেন। মামদানি এর জবাবে কুমোর ধনী দাতাদের নিয়ে সমালোচনা করেন এবং বলেন নিউইয়র্ক শহরকে নতুন নেতৃত্ব প্রয়োজন। অন্যদিকে, বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস চলতি বছর ডেমোক্রেটিক প্রাইমারি থেকে সরে দাঁড়ান এবং এখন একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। কুমো আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তিনি তৃতীয় একটি রাজনৈতিক দলের ব্যানারে নভেম্বরেও লড়বেন, তবে ২৪ জুন মঙ্গলবার রাতে তিনি চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি। নিউইয়র্ক সিটির রাজনীতিতে এমন একটি পালাবদল অভাবনীয় ও ঐতিহাসিক হিসেবে দেখা হচ্ছে।

গত ২৪ জুন নিউইয়র্ক সিটির মেয়রসহ বেশ কয়েকটি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে পাবলিক এডভোকেট, সিটি কম্পট্রোলার, কাউন্সিলম্যান এবং বিচারপতি পদে। কাউন্সিলম্যান পদে বাংলাদেশী আমেরিকান শাহানা হানিফ নির্বাচন করেন। সকাল থেকে উৎসবমুখর পরিবেশে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে ভোটারদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিলো প্রচন্ড গরম। গত ২৪ জুন ছিলো এ বছরের সবচেয়ে বড় গরমের দিন। তাপমাত্রা ছিলো প্রায় ১০০ ডিগ্রির উপরে। তারপারেও প্রার্থীদের সমর্থকরা সকাল ৬টা থেকে প্রায় রাত ৯টা পর্যন্ত তাদের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে যান। বিভিন্ন কেন্দ্রের বাইরে দেখা যায় ভোটারদের হাতে তাদের পছন্দের প্রার্থীর প্ল্যায়ার ধরিয়ে দিতে। এর মধ্যে বাংলাদেশীরাও রয়েছেন। এবারের মেয়র নির্বাচনের ইতিহাস সৃষ্টিকারী প্রার্থী জোহরান মামদানি বাংলাদেশী, মুসলিম এবং ইমিগ্র্যান্ট কম্যুনিটির মন জয় করেছেন। বিশেষ করে তার প্রতিশ্রুতি এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা ভোটারদের দৃষ্টি কেড়েছে। নিউইয়র্ক সিটির মেয়র পদে ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রার্থীদের মধ্যে ১১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছেন অ্যাসেম্বলীম্যান জোহরান মামদানি ও নিউইয়র্কের সাবেক গভর্নর এন্ড্রু কুমোর মধ্যে।

আগামী ৪ নভেম্বর চূড়ান্ত নির্বাচনে জোহরান মামদানিকে রিপালিকান পার্টির প্রার্থী সিলও এবং বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামসের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন। জোহরান মামদানি তার বিজয়ী ভাষণে বলেন, আপনারাই আমার আশার আলো। ৫ বুরোতে আপনাদের অবস্থান। আপনাদের আশার আলোতেই আজকে আমি আলোকিত। তিনি বলেন, এতদিন পর্যন্ত আমাদের নিউইয়র্কবাসীকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমালোচনা করে বলেন, তিনি আমাদের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে চলেছেন। আমাদের সন্তানরা ক্ষুধার্থ। আজকে আমি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে চাই কেউ ক্ষুধার্থ থাকবে না। আমাদের দাবি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে মানতে হবে। তিনি বলেন, প্রচারণার সময়ও আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়েছে। প্রায় অধিকাংশ জরিপে আমাদের পেছনে রাখা হয়েছে। তবে দুই একটি ব্যতিক্রমও ছিলো। তিনি ধন্যবাদ জনান, কংগ্রেসম্যান, পাবলিক এডভোকেট, এটর্নী জেনারেলসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানান। তিনি সমর্থকদের ধন্যবাদ জানান তাকে বিশ্বাস করার জন্য। তার বাবা এবং মাকে ধন্যবাদ জানান তাকে জন্ম দেয়ার জন্য। ধন্যবাদ জানান স্ত্রীকেও।

শেয়ার করুন