যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস গঠিত হয়েছে অভিবাসীদের শ্রম, প্রতিভা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে। এই দেশটি মূলত অভিবাসীদের কঠোর পরিশ্রম, উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও আত্মোৎসর্গের ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে। আজও অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি, সমাজ এবং জনসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। ২০২৩ সালের সর্বশেষ তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার ১৪.৩ শতাংশই অভিবাসী, যার সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৭৮ লাখ। এদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক ইতোমধ্যে নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন। অভিবাসীরা শুধু শ্রমশক্তি হিসেবেই নয়, উদ্যোক্তা, করদাতা এবং ভোক্তা হিসেবেও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখছেন।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মোট উদ্যোক্তার ২৩.৬ শতাংশই অভিবাসী, যাদের সম্মিলিত বার্ষিক ব্যবসায়িক আয় ১১৬.২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ফারচুন ৫০০ তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে ২৩০টি প্রতিষ্ঠানে অভিবাসী বা তাদের সন্তানেরা প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে রয়েছেন। অভিবাসীরা মার্কিন অর্থনীতিতে প্রতি বছর প্রায় ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্রয়ক্ষমতা রাখেন এবং তারা ফেডারেল, রাজ্য ও স্থানীয় কর হিসেবে মিলিয়ে ৬৫১.৯ বিলিয়ন ডলার প্রদান করেন। এর মধ্যে সোশ্যাল সিকিউরিটি প্রোগ্রামে অবদান ২১৫.৮ বিলিয়ন ডলার এবং মেডিকেয়ার প্রোগ্রামে ৫৮.৭ বিলিয়ন ডলার। অভিবাসীরা স্টেম খাতে (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত) কর্মীদের মধ্যে ২৩.৬ শতাংশ এবং নার্সদের মধ্যে ১৫.৯ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব করেন। শ্রমশক্তির ১৭.৭ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ কোটির বেশি কর্মী অভিবাসী, যারা কৃষি, নির্মাণ, পরিবহন, পরিষেবা এবং বিভিন্ন পেশাগত খাতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। কৃষিতে অভিবাসীদের অংশগ্রহণ ২৬.১ শতাংশ, নির্মাণে ২৫.৭ শতাংশ এবং পরিবহন ও গুদামজাত খাতে ২২.৪ শতাংশ।
শিক্ষার ক্ষেত্রেও অভিবাসীদের প্রভাব বিশাল। যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার জন্য অবস্থানরত আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১১ লাখ ২৬ হাজারের বেশি, যারা বছরে প্রায় ৪৩.৮ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক অবদান রাখেন এবং প্রায় ৩ লাখ ৭৮ হাজার চাকরি সমর্থন করেন। অবৈধ অভিবাসীরাও অর্থনীতির বাস্তব ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রায় ১ কোটি ১৮ লাখ অনিবন্ধিত অভিবাসীর মধ্যে ৮৯.৪ শতাংশ কর্মক্ষম বয়সে রয়েছেন। তারা বছরে ৮৯.৮ বিলিয়ন ডলার কর দেন এবং তাদের ব্যয়ক্ষমতা ২৯৯ বিলিয়ন ডলার। এদের মধ্যে প্রায় ১১ লাখ উদ্যোক্তা রয়েছেন।
স্বাস্থ্যসেবায় অভিবাসীদের অনুপস্থিতি ভাবাই কঠিন। নার্সদের মধ্যে ১৫.৯ শতাংশ এবং হেলথ এইড কর্মীদের মধ্যে ২৮.৪ শতাংশই অভিবাসী। তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন এবং স্বাস্থ্যখাতের ভিত্তি শক্তিশালী করছেন। আবাসন খাতেও অভিবাসীরা একটি প্রধান চালিকা শক্তি। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১ কোটি ১৬ লাখ অভিবাসী গৃহমালিক এবং তাদের আবাসন সম্পদের পরিমাণ ৬.৬ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। অভিবাসীরা বছরে প্রায় ১৬৭.২ বিলিয়ন ডলার ভাড়ার খাতে ব্যয় করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ আসেন মেক্সিকো থেকে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের মোট অভিবাসীর ২২.৮ শতাংশই মেক্সিকো থেকে আগত, যা এককভাবে যে কোনো দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ। এরপরই অবস্থান করছে ভারত, যেখান থেকে ৬.১ শতাংশ অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে চীন, ৪.৬ শতাংশ অভিবাসী নিয়ে। চতুর্থ স্থানে আছে ফিলিপাইন, যার ৪.৩ শতাংশ নাগরিক বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হিসেবে অবস্থান করছেন।
পঞ্চম স্থানে রয়েছে এল সালভাদর, যেখান থেকে ৩.১ শতাংশ অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন। এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের একটি বড় অংশ লাতিন আমেরিকা এবং এশিয়া মহাদেশ থেকে আগত। এসব অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজার, প্রযুক্তি খাত, স্বাস্থ্যসেবা এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তাদের আগমন শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নে নয়, বরং বহু সাংস্কৃতিক সমাজ গঠনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
প্রাকৃতিকীকরণ ও ভোটাধিকার অর্জনের মাধ্যমে অভিবাসীরা রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছেন। বর্তমানে ২ কোটি ৩৬ লাখ অভিবাসী নাগরিকত্ব পেয়েছেন এবং আরো ৭৩ লাখ নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য। এর মধ্যে প্রায় ২ কোটি ২৮ লাখ ইতোমধ্যে ভোটাধিকারপ্রাপ্ত।
ডাকা প্রোগ্রামের আওতায় প্রায় ১১ লাখ তরুণ অভিবাসী রয়েছেন, যাদের মধ্যে ৯৭ শতাংশ কর্মরত এবং ৭৬ হাজারের বেশি উদ্যোক্তা। তাদের বার্ষিক আয় প্রায় ৪৬.৫ বিলিয়ন ডলার এবং কর প্রদান প্রায় ১১.৫ বিলিয়ন ডলার।
শরণার্থী এবং সাময়িক সুরক্ষাধিকার (টিপিএস) প্রাপ্ত অভিবাসীরাও সমাজে বিশাল অবদান রাখছেন। প্রায় ২২ লাখ সম্ভাব্য শরণার্থীর মধ্যে ৯৬.৫ শতাংশ কর্মরত এবং ৮৫.৫ শতাংশ নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন। টিপিএসহোল্ডারদের সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ, যাদের ৯৬ শতাংশ কর্মজীবী এবং তারা প্রতি বছর ৫.২ বিলিয়ন ডলার কর দেন।
এ পরিসংখ্যানগুলো স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি, সমাজ এবং ভবিষ্যৎ গঠনে অভিবাসীদের অবদান অপরিহার্য। তারা শুধু শ্রমিক বা শিক্ষার্থী নন, তারা হলেন ‘নতুন আমেরিকান’, যাদের স্বপ্ন, শ্রম ও সংগ্রামের ভিত্তিতে আধুনিক যুক্তরাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তা ও সামাজিক কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং তাদের অবদান দেশটির নৈতিক, সাংবিধানিক ও মানবিক মূল্যবোধকে দৃঢ় ভিত্তি প্রদান করে।
অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো বোঝা নয়, বরং তারা এই দেশের জন্য একটি আশীর্বাদ। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র গড়ে উঠেছে বিভিন্ন জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের মিলনস্থল হিসেবে। অভিবাসীরা শুধু শ্রমশক্তি নয়, তারা প্রযুক্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আজকের সিলিকন ভ্যালি থেকে শুরু করে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ পর্যন্ত সর্বত্রই অভিবাসীদের নিষ্ঠা ও পরিশ্রম চোখে পড়ার মতো। তারা কর প্রদান করে অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখে, নতুন ব্যবসা গড়ে তোলে এবং সমাজের বৈচিত্র্য ও সহনশীলতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। এক কথায়, অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি ও সাফল্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের অবদান ছাড়া একটি পূর্ণাঙ্গ, প্রগতিশীল এবং উদার আমেরিকা কল্পনা করা যায় না।
যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি তার বৈচিত্র্যেই নিহিত এবং সেই বৈচিত্র্যের সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত্তি হলো অভিবাসীরা। তারা কেবল অর্থনীতির চালিকাশক্তি নন, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরে-শ্রমবাজার, উদ্যোক্তা ক্ষেত্র, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও নাগরিক অংশগ্রহণে গভীর ও স্থায়ী প্রভাব রেখেছেন। অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রকে আরো উদ্ভাবনী, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সহনশীল করে তুলেছেন। নতুন আমেরিকানরা তাদের শ্রম, মেধা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ দিয়ে প্রমাণ করেছেন-তারা বোঝা নন, বরং জাতির অগ্রগতির অন্যতম ভিত্তি। সুতরাং অভিবাসীদের অবদান শুধু স্বীকৃতিই নয়, সম্মান ও রক্ষাও প্রাপ্য। যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ গঠনে তাদের অন্তর্ভুক্তি ও সুরক্ষা অপরিহার্য।