শিকাগোর প্লেইনফিল্ডের ভ্যান হর্ন উডস ইস্ট পার্কে এক আবেগঘন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উন্মোচন করা হলো ছয় বছর বয়সী ফিলিস্তিনি-আমেরিকান শিশু ওয়াদি আল ফায়উমির স্মরণে নির্মিত এক মনুমেন্ট। ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসলামবিদ্বেষমূলক ও ফিলিস্তিনবিরোধী ঘৃণাজনিত হামলায় নিজ বাসার ভেতর তাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে বাড়ির মালিক জোসেফ চুবা। গত ২৮ জুন সকালে এই মনুমেন্ট উন্মোচন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শতাধিক মানুষ অংশ নেন। অংশগ্রহণকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ওয়াদির বাবা ওদাই আল ফায়উমি বলেন, আজ আর আমি একা নই। আপনারা সবাই যেন আমার পরিবারের অংশ হয়ে গেছেন। আপনারা আমাকে একা থাকতে দেননি। এখন মনে হয়, ওয়াদি কেবল আমার ছেলে নয়, আপনাদের সবার।
এই মনুমেন্ট কেবল একটি স্মৃতিচিহ্ন নয় বরং এটি একটি সামাজিক বার্তা বহন করে। এতে ওয়াদির একটি বহুল প্রচারিত ছবির ছায়াচিত্র (সিলুয়েট) দেখা যায়, যেখানে সে ডান হাতে অর্ধেক হৃদয়ের আকার দেখাচ্ছে। মনুমেন্টটিতে সেই হৃদয়চিহ্নটি লাল রঙে পূর্ণ করে ভালোবাসার এক শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এ প্রকল্পের পরিকল্পনা ও অর্থায়নের উদ্যোগ নেয় স্থানীয় ‘স্কোয়াটিং আমেরিকা’ গ্রুপ। এর অন্যতম সংগঠক মীর আলী বলেন, এই মনুমেন্ট নির্মাণের জন্য অর্থ সংগ্রহে আমাদের সময় লেগেছে মাত্র কয়েক মিনিট।
ঘাতক জোসেফ চুবা ২০২৩ সালের ১৪ অক্টোবর হামলা চালায়। তার বিরুদ্ধে ইসলামবিদ্বেষমূলক ঘৃণাজনিত হত্যা ও হামলার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। মাত্র এক ঘণ্টার জুরি পর্যালোচনায় তার বিরুদ্ধে রায় প্রদান করা হয় এবং চলতি বছরের ২ মে তাকে ৫৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। চুবা আদালতে জানায়, গাজা যুদ্ধ সংক্রান্ত একটি উগ্র রেডিও অনুষ্ঠান শুনে সে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে, যা পরে ঘৃণায় রূপ নেয় এবং তাকে হত্যার পথে ঠেলে দেয়।
এই হামলা ও হত্যাকাণ্ড বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় তোলে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম ও ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে অধিকারকর্মী সোহার খতিব বলেন, ওয়াদির মৃত্যু কেবল একজন ঘাতকের হাতে নয়। এটি ঘৃণা ছড়ানো মিডিয়া ও রাষ্ট্রীয় নীতির ফলাফলও। আমাদের ট্যাক্স ডলার যেখানে গাজায় শিশু হত্যা করছে, সেখানে কীভাবে আমরা বলি ঘৃণার ঠাঁই নেই? ওয়াদির স্কুলবাস সঙ্গী ডেক্সটার ফ্রাকাসিও সেদিন উপস্থিত ছিল। ডেক্সটারের মা সিন্ডি গ্লাস বলেন, আমার হৃদয় ভেঙে গেছে। তবে আশা দেখছি যেভাবে আমাদের চার্চ, ইহুদি ও ফিলিস্তিনি সম্প্রদায় একসঙ্গে এগিয়ে এসেছে, তা আশাজাগানিয়া। আগে প্লেইনফিল্ডে নীরব বর্ণবাদ ছিল, কিন্তু ওয়াদীর হত্যাকাণ্ডের পর মানুষ তা প্রশ্নবিদ্ধ করছে, এখন অনেকেই সোচ্চার।
ভ্যান হর্ন উডস ইস্ট পার্কে স্থাপিত এই মনুমেন্ট এখন কেবল একজন শিশুর নয়, বরং ভালোবাসা, প্রতিবাদ ও ন্যায়বিচারের এক স্থায়ী প্রতীক হয়ে উঠেছে। ওয়াদি আল ফায়উমির স্মরণে নির্মিত এই মনুমেন্ট আমাদের শুধু একটি নিষ্পাপ শিশুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নয়, বরং ইসলামবিদ্বেষ ও ধর্মীয় ঘৃণার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে আহ্বান জানায়। এই মনুমেন্ট প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে ভালোবাসা, সংহতি ও মানবিক মূল্যবোধের পক্ষে। একটি শিশু ঘৃণার বলি হলে, পুরো সমাজের আত্মা ক্ষতবিক্ষত হয়। ওয়াদির হত্যাকাণ্ড আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কীভাবে ভয়, বিভ্রান্তি ও বিদ্বেষ একত্রে মিলে ভয়ংকর অপরাধে রূপ নিতে পারে। আর তাই এই মনুমেন্ট যেন কেবল শোক নয়, বরং প্রতিজ্ঞার স্থান হয় যেখানে আমরা একত্রে বলি, ‘ঘৃণার ঠাঁই নেই।’
আমাদের দায়িত্ব, এমন সমাজ গড়ে তোলা যেখানে ধর্ম, জাতি কিংবা পরিচয়ের কারণে কেউ নিপীড়িত হবে না। ওয়াদির স্মৃতি সেই মানবিক সমাজ গঠনের জন্য আমাদের অন্তর্দৃষ্টি খুলে দিক যেখানে ভালোবাসা, সুবিচার ও সহনশীলতাই হবে একমাত্র উত্তরাধিকার।